শিশু দিবস, সকাল সাড়ে সাতটা। জুতোর বাক্সের মতো আকৃতির বাড়িটার দরজা এখনও খোলেনি। ওই হল ভারতের শিশুতীর্থ, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। রংচটা, শ্রীহীন ওই বাড়িকে যুদ্ধের বাঙ্কারও বলা চলে। অপুষ্টির বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ের ‘ফ্রন্টলাইন’ এই কেন্দ্রগুলোই। সরকারের নিয়ম, এখানে বসে তিন থেকে ছয় বছরের শিশুরা গরম ভাত বা খিচুড়ি খাবে। সঙ্গে তরকারি, ডিম। এমন ব্যবস্থা সত্ত্বেও এই বয়সের শিশুদের মধ্যে এমন অপুষ্টি, যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ক্রমশ নামছে। সূচকের অঙ্কে ভুল ধরে দায় এড়াতে চেয়েছে কেন্দ্র, কিন্তু সেই জারিজুরি ধোপে টেকে না (‘গরিব, তাই উচ্চতা কম’, অচিন চক্রবর্তী, ২৮-১০)। বরং প্রশ্ন উঠেছে, কেন অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে ক্রমাগত টাকা কমছে (‘শিশু অপুষ্ট, মা কি জানেন’, অরিজিতা দত্ত, ৮-১১)।
তার পরেও পশ্চিমবঙ্গের এক সীমান্ত জেলার, সীমান্ত-ঘেঁষা এক গ্রামে (বাঘমুণ্ডি ব্লকের তিনতুড়ি গ্রাম, পুরুলিয়া) এসে দাঁড়াতে হয়েছে কয়েকটি প্রশ্নের তাড়নায়। অভাব সত্ত্বেও এই প্রকল্প কম টাকা দেয় না। খাবারের বরাদ্দ মাথাপিছু দিনে ছ’টাকা, যা প্রাথমিক স্কুলে মিড-ডে মিলের চেয়ে বেশি। পুরুলিয়ার ১৯৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৩টিতে দিদিমণি আছেন। রাঁধুনিদিদি অবশ্য নেই ১০৬টিতে, তবে অনেক দিদিমণি নিজের মাইনে থেকে অল্প কিছু দিয়ে রাঁধুনি রাখেন। খাবার বিতরণ হয় না, এমন কেন্দ্র নেই বললেই চলে। যে শিশুরা রোজ খাবার পায়, তাদেরও অনেকের ওজন বাড়ছে না কেন?
অনেকে বলবেন, কেন্দ্রে তো শিশুরা এক বার খাবার পায়। তিন-চার বার খায় বাড়িতে। ঘাটতি নিশ্চয়ই সেখানে। তাই দ্বিতীয় প্রশ্ন, কতটুকুই বা খায় আড়াই-তিন বছরের একটি শিশু? তিনতুড়ির মাটির দেওয়াল, টালির চালের বাড়িতেও ডিশ অ্যান্টেনা দেখা যায়। তবু কেন রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ শিশু পুষ্টির অভাবে বেঁটে হয়ে যাচ্ছে? শিশুর মুখে তুলে দেওয়ার মতো খাদ্য জোটাতে পারে না, এতই কি দরিদ্র পশ্চিমবঙ্গের ৩৩ শতাংশ পরিবার? না কি, অভাব খাদ্যের নয়, অন্য কিছুর?
হেমন্তের নরম রোদে গ্রামের রাস্তার রাঙা ধুলোয় খেলছে শিশুরা। সাতটায় কেন্দ্র খোলার কথা, রাঁধুনিদিদি এলেন আটটা চল্লিশে, তারও পরে এলেন দিদিমণি। দু’জনের কেউ শিশুদের ভিতরে ডাকলেন না। তারা ধুলোয় তেমনই খেলতে লাগল। দশটা নাগাদ এলেন মায়েরা, হাতে ক্যান নিয়ে। সাড়ে দশটায় ক্যানে ভরা হল সাদা ভাত আর সেদ্ধ ডিম। যদিও কেন্দ্রের চটা-ওঠা মেঝেতে মুসুর ডাল ছড়াছড়ি — ইঁদুরে বস্তা ফুটো করেছে। একটা ছাতুর বস্তা কয়েক মাস পড়ে, বিলি হয়নি। অতি রোগা একটি মেয়েকে ওজন করে দেখা গেল, সে ‘লাল’ শিশু— অতি অপুষ্ট। কেন এই দশা? দিদিমণি আঙুল তুললেন মায়েদের দিকে। “ওরা বাচ্চাদের খাওয়ায় না, বাড়ি গিয়ে নিজেরা খায়।” কেন্দ্রে বসে কেন খায় না শিশুরা? মায়েরা বললেন, “আমাদেরই তো আনতে হবে, এক ঘণ্টা বসে থেকে আবার নিয়ে যেতে হবে। অত সময় কই?”
তীব্র অপুষ্টদের জন্য রয়েছে ব্লক হাসপাতাল-সংলগ্ন ‘নিউট্রিশন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’, সংক্ষেপে এনআরসি। পুরুলিয়ায় অমন শিশু প্রচুর, অথচ কেন্দ্রের বেড ২০-২৫ শতাংশ খালি থাকে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নালিশ, মায়েরা এনআরসি-তে যেতে চায় না। কেন? একাধিক তীব্র অপুষ্টি-আক্রান্ত শিশুর মা বললেন, “আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে অন্য বাচ্চাদের দেখবে কে?” পুষ্টি-বিশেষজ্ঞ শিল্পী রায়ের আক্ষেপ, এনআরসি-তে ওজন বাড়িয়ে ঘরে পাঠালেও ফের ভর্তি হয় অনেক শিশু। “মায়েরা সকালে ধান কাটতে চলে গেল, বাচ্চাকে কোনও মতে খাওয়াল কি খাওয়াল না।” সময় বাঁচাতে চটজলদি বিস্কুট, চিপসের প্যাকেট শিশুর হাতে ধরিয়ে দেন দরিদ্র মা-ও। “কেন্দ্রে ভর্তি হলে সব সময়ে নজর রাখি। না হলেই দোকান থেকে প্যাকেট এনে দেবে বাচ্চাকে।”
আর সরকারি খাবারের গতি কী হয়? দুলমি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে বছর পাঁচ-ছয়ের মেয়ে পারভিন দুটো খোলা পাত্রে আগুন-গরম খিচুড়ি কোমরের দু’দিকে ব্যালান্স করতে করতে প্রায় দু’শো মিটার হাঁটল। ফ্রকের কোনা ধরে খুদে ভাই। বাড়ি ঢুকতেই উঠোনে-বাঁধা সাদা ছাগলটা এসে একটা পাত্রে মুখ ডুবিয়ে দিল। ঘুরে ঢুকে আধখানা ডিম (খিচুড়ির দিন গোটা ডিম জোটে না) ভাগাভাগি করে খেল ভাই-বোন। খিচুড়িটা সামান্য মুখে দিয়ে আর খেল না। হয়তো গরম, হয়তো বিস্বাদ। একটু পরে ন’বছরের দাদা এসে খিচুড়িটা ফেলে-ছড়িয়ে খেল। পাশেই মা বসে, কোলে বিড়ির ডালা। হাজার বিড়ি বাঁধতে (মজুরি ১৪০ টাকা) দু’দিন লাগে, কচি ছেলেমেয়েকে বসিয়ে খাওয়ানোর সময় নেই।
যত কাছ থেকে দেখা যায়, তত স্পষ্ট হয় যে, শিশুর অপুষ্টির কারণ খাদ্যের অভাব অতটা নয়, যতটা মায়ের সময়ের অভাব। বহু গ্রামে পিক-আপ ভ্যান এসে সকালে পুরুষ-মেয়েদের নিয়ে যায়, বেলা চারটেয় ফেরে। খেতমজুর, দিনমজুর, বিড়ি শ্রমিক, ভাটা শ্রমিক মায়েরা দিনে তিন-চার বার সন্তানদের কাছে বসিয়ে ডাল-ভাত, রুটি-তরকারি খাওয়াবেন, এ এক অসম্ভব কল্পনা। মুখোমুখি সংলাপে আধিকারিকরাও স্বীকার করেন যে, আসল অভাব মায়ের সময়ের। তবু সরকারি প্রকল্পের নির্মাণ হয় এক ফুল-টাইম গৃহবধূকে কেন্দ্রে রেখে, যাঁর ধ্যানজ্ঞান সন্তানপালন। মানে, শহুরে মধ্যবিত্তের মডেল চাপানো হয় গ্রামের শ্রমজীবীর উপর। কোভিডে অপুষ্টি বাড়তে দেখে পুরুলিয়ায় জেলাশাসক অতি-অপুষ্ট শিশুর মায়েদের ফলের চারা, আনাজের বীজ, হাঁসের ছানা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ চাষ করে, প্রাণিপালন করে শিশুর খাবার উৎপাদন করার কাজটাও মায়ের। অথচ, আজ বাংলার গ্রামে এক বিপুলসংখ্যক মেয়ে কার্যত ‘সিঙ্গল মাদার’, কারণ তাঁদের স্বামী পরিযায়ী শ্রমিক। ঘরে-বাইরে এই মেয়েদের কাজের চাপ অকল্পনীয়।
এই বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করেছে বলেই তামিলনাড়ু, কর্নাটকে সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চালায় দিনে সাত-আট ঘণ্টা, প্রাক্-প্রাথমিক স্কুল তথা ‘ক্রেশ’ হিসাবে। দিনে দু’তিন বার খাবার পায় শিশুরা, অক্ষর পরিচয় হয়। ওড়িশা সরকার কন্ধমল জেলার খেজুরিপাড়া ব্লকে ক্রেশ খুলেছে। আদিবাসী মায়েরা মহুয়া কুড়োতে যায়, সুদৃশ্য ক্রেশে সারা দিন থাকে শিশুরা। তামিল, কন্নড়, ওড়িয়া মায়েরা যে সহায়তা পান, বাঙালি মা তা পাবেন না কেন? কেন তাঁর সন্তান সারা দিন ধুলোয় খেলবে, আর দু’হাতা হলুদ-গোলা খিচুড়ি নিয়ে ফিরবেন বাড়িতে? বৃদ্ধদের দেখভালের জন্য ‘সেবাসখী’ প্রকল্প যদি করা যায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের দিয়ে, শিশু পরিচর্যাও করা যাবে।
ভারতে রোজগেরে মেয়ে কমছে, শিশুদের অপুষ্টিও বাড়ছে। উন্নয়নের বিপরীতে এই যাত্রা কেবল চাল বিলিয়ে রোখা যাবে না। শ্রমজীবী মায়েদের চাই শিশুর দেখভালে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প সে কাজে বাংলার প্রায় সর্বত্র ব্যর্থ। হয় প্রকল্প কর্মীদের তৎপর ও দায়বদ্ধ করতে হবে, না হলে পঞ্চাশ বছরের ঘুণধরা প্রকল্পের বাইরে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। নিষ্ফল নিয়মরক্ষা যথেষ্ট হয়েছে। কেন আমাদের শিক্ষাহীন, পুষ্টিহীন শিশুরা রোজ লাইন দেবে দু’হাতা খিচুড়ির জন্য? এ কি শিশুর উন্নয়ন, না শৈশবের অপমান?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy