Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Politics

রাজনীতির সব সুরই নাগপুরের

শাহিন বাগে হামলার ঘটনায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকলেন কেজরীওয়াল। দিল্লির সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও তাঁর নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। ‘ঘুসপেটিয়া’ অপবাদ দিয়ে বাঙালি উৎখাত নিয়েও আপ চুপ।

তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও তেমন সংগঠিত প্রতিবাদ দেখা যায়নি।

তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও তেমন সংগঠিত প্রতিবাদ দেখা যায়নি। ফাইল চিত্র।

শেখ সাহেবুল হক
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:১১
Share: Save:

ভারতে যদি বিজেপি-বিরোধী রাজনীতি করতে হয়, তা হলে আঞ্চলিক ছোট দলগুলোই এখন ভরসা। প্রশ্ন হল, এতে কি কোনও লাভ হচ্ছে? অদূর ভবিষ্যতে বিজেপিকে সরানোয় এই দলগুলোর সম্মিলিত শক্তি কি বিশেষ ভূমিকা নেবে? অরবিন্দ কেজরীওয়ালের শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ও বিনামূল্যে পরিষেবার রাজনীতি, বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সব কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী’র রাজনীতি যথাক্রমে দিল্লি এবং বাংলায় পোক্ত জায়গায় রয়েছে। কিন্তু এই শক্তি নিয়ে তাঁরা কি সত্যিই বিজেপি-বিরোধিতায় মন দিচ্ছেন, না কি বিজেপিকে না চটিয়ে রাজ্যে ‘করে খাওয়া’র রাজনীতিই প্রধান হয়ে উঠছে? গত কয়েক বছরের ঘটনাক্রম কী ইঙ্গিত করছে?

শাহিন বাগে হামলার ঘটনায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকলেন কেজরীওয়াল। দিল্লির সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও তাঁর নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। ‘ঘুসপেটিয়া’ অপবাদ দিয়ে বাঙালি উৎখাত নিয়েও আপ চুপ। ঘটনা হল, সে বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও তেমন সংগঠিত প্রতিবাদ দেখা যায়নি। অন্য দিকে, বাংলায় সঙ্ঘ পরিবারের কার্যকলাপ এবং রামনবমীর অস্ত্র মিছিলের অভূতপূর্ব বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে তৃণমূল আমলে। মূলত হিন্দিভাষী এলাকায় হিন্দুত্ববাদী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রামনবমীর অনুষ্ঠান হয়। ধর্মীয় রীতি হিসেবে এই অনুষ্ঠান শুরু হলেও তা দিনের শেষে অস্ত্রের আস্ফালনে পর্যবসিত হয়। ক্যানিং-কুলতলি’সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ, বাংলা জুড়ে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলগুলির সংখ্যাবৃদ্ধির পরিসংখ্যানও ইঙ্গিত করছে যে, তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে এই রাজ্যে আরএসএস-এর প্রসার ঘটছে। সঙ্ঘের দাবি, বিগত বছরগুলির তুলনায় রাজ্যে তাদের প্রায় ২৫ শতাংশ শাখা বেড়েছে। অভিযোগ শোনা যায়, সেলফ ডিফেন্সের নামে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বিদ্বেষী আলোচনাসভা ইত্যাদি গ্রামে গ্রামে চলছে। পাশাপাশি, বিজেপির একাধিক প্রতিষ্ঠিত নেতার স্পষ্ট মুসলমান-বিদ্বেষী কথার পরও রাজ্য প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা করেনি।

দেশ জুড়ে বহু রাজনৈতিক কর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক দীর্ঘ দিন জেলবন্দি। প্রধান বিজেপি-বিরোধী মুখ হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে আগ্রহী আপ বা তৃণমূল কংগ্রেস সে বিষয়ে কার্যত নীরব। বাংলায় সাধারণ মুসলিম যুবকের কাছে ধর্মীয় বই থাকার ছুতোয় ধরে নিয়ে গেলে প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। মুর্শিদাবাদের বাড়িতে পয়ঃপ্রণালীর সুড়ঙ্গ ইসলামাবাদ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া বা সম্পূর্ণ তদন্তের আগেই জঙ্গিযোগ নিশ্চিত হওয়া, এই ন্যারেটিভের বিপরীতে পাল্টা সত্য বলার উদ্যোগ সংখ্যালঘু জনপ্রতিনিধিরাও নেন না।

সন্দেহ হয়, আঞ্চলিক দলগুলোকে যেন বলা আছে, “তোমরা নিজ রাজ্যে করে খাও, কিন্তু আমাদের মতবাদকে প্রাসঙ্গিক করো। ধীরে ধীরে সমাজের গভীরে শিকড় পোঁতার সুযোগ দাও। নিঃশব্দ পরিবর্তনের অনুকূল আবহাওয়া তৈরি করো।” সেই রাসায়নিক পরিবর্তন থেকে পূর্বের অবস্থায় ফেরার রাস্তা নেই। আশঙ্কা হয়, এত দিনের সামাজিক সুশিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা গোল্লায় যাবে। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলায় ক্রমে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিদ্বেষ-বিষ ‘স্বাভাবিক’ লাগবে। এই পরিবর্তন এত ধীর হবে যে, বুঝে ওঠার আগেই একটা বড় অংশের তথাকথিত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান অংশ পরিবর্তিত হবে ধর্মান্ধে। তখন শিক্ষক, অধ্যাপক, গবেষকরাও বোঝাবেন ‘মানুষের আগে ধর্ম’। এই অবক্ষয় রোধের কোনও সক্রিয় প্রয়াস চোখে পড়ছে কি?

জয় শ্রীরামের পাল্টা ‘ইনশাল্লা-সুভানাল্লা’র রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের হাতে রাখা যায়, কিন্তু ধর্মের লাইনে রাজনীতি হলে বিজেপির সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, আদৌ ‘পেরে ওঠা’র বাসনা আছে কি? গুজরাত নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে অরবিন্দ কেজরীওয়াল দাবি করলেন, টাকার নোটে মহাত্মা গান্ধীর বদলে হিন্দু দেবদেবীদের ছবি থাকুক। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠানের যোগ্য ছাত্রের মতোই দাবি নয়? তৃণমূলের সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার বাসনায় একাধিক পদক্ষেপও নরম হিন্দুত্বের রাজনীতির দিকে ঘেঁষার আভাস দেয়।

রাজ্যে লাখ লাখ বেকার চাকরিপ্রার্থী রাস্তায় আন্দোলন করছেন। সেখানে কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান না করেই পুরীর ধাঁচে মন্দির নির্মাণ করার রাজনীতি বাছছে সরকার। হতাশ যুব সমাজের একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকছে। মহার্ঘ ভাতা বকেয়া থাকায় সরকারি কর্মীরা বিজেপির পক্ষে সওয়াল করছেন। বিজেপির বড় ভরসা এই চাকুরে শ্রেণি। হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে তাঁরা বিজেপির বড় প্রচারক। এই ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা হলে বিজেপি সহজে জায়গা পেত না। স্মার্ট সিটি, বছরে দু’-কোটি চাকরি, ডলারের তুলনায় টাকার মান বৃদ্ধি, কৃষিঋণ মকুব ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে বিজেপি হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে স্থিত রয়েছে। তার পাল্টা রাজনীতি যদি মন্দির নির্মাণ আর গঙ্গার ঘাটে আরতির পথে হাঁটে, ইমাম ভাতা দেওয়া, পরে তাকে ব্যালান্স করতে পুরোহিত ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত, খোল-করতাল বিলি করে, তা কি বিজেপির চেয়ে ভিন্ন? তা যেন অনেকটা একই হেড অফিসের গাইডলাইন।

ধর্মের রাজনীতি ভবিতব্য হলে ক্ষুধা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, সরকারি অব্যবস্থা ব্যাকফুটে চলে যাবে। খেতে না পেলেও ধর্মরক্ষার দোহাইয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা দলে ভিড়তে হবে। নইলে জুটবে নিজ ধর্মীয় সমাজ থেকে একঘরে হওয়ার নিদান। দেশে ভোট হয়, কোনও কোনও রাজ্যে বিজেপি হারে। কিন্তু, জয়ী আঞ্চলিক শক্তির রাজনীতিও যদি মূলত নাগপুরের সুরেই বাঁধা থাকে, তা হলে নিস্তার কোথায়?

অন্য বিষয়গুলি:

Politics BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy