—প্রতীকী ছবি।
জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি) নামে প্রায় একটি কমলহিরের টুকরো আমাদের হাতে এসে পড়েছে; তার এক-এক দিকে আলো পড়ে এক-এক রকম তথ্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর আমাদের মনে নতুন নতুন চমক জাগাচ্ছে। এক দিকে ডারউইন (বিবর্তনবাদ) থেকে মেন্ডেলিভ (পর্যায় সারণি), আলোর বিচ্ছুরণ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, অনেক কিছুই ইস্কুলের বিজ্ঞান পাঠ্য থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে; অন্য দিকে ইস্কুল-কলেজের পড়াশোনা ও পরীক্ষার চালু ব্যবস্থাকে তছনছ করে বিচিত্র সব পদ্ধতির আমদানি হচ্ছে। পরিবর্তনকে কেন ‘তছনছ’ বলা হচ্ছে সে কথা আপাতত থাক, তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই কেমন তা বুঝতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এখন আমরা সবাই চন্দ্রাহত হয়ে আছি। তাই এর পাশাপাশি দেশের গবেষণার চালচিত্রেও যে বিরাট বদল ঘটে যেতে চলেছে, তা নিয়ে তত আলোচনা হচ্ছে না। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও কিন্তু আসলে তা নয়।
দেশের বিজ্ঞানচর্চার হালচাল অনেকটা নির্ভর করে জাতীয় বিজ্ঞাননীতির উপর। রাজনৈতিক ক্ষমতাবদলের সঙ্গে বিজ্ঞাননীতির সরাসরি যোগ না থাকলেও তার রূপায়ণের ক্ষেত্রে শাসক দলের পরোক্ষ একটা প্রভাব থাকেই। সেই কারণেই হয়তো স্বাধীনতার ৭৫ বছরের প্রাক্কালে কোভিড পর্বের মধ্যেই জাতীয় শিক্ষানীতির পাশাপাশি শাসক দলের ‘বিজ্ঞানদর্শন’-এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নতুন জাতীয় বিজ্ঞাননীতিরও খসড়া শুরু হয়েছিল যা ২০২১ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে। বিজ্ঞানকে দেশের মজবুত ভবিষ্যতের জন্য ব্যবহার করা, দেশের যাবতীয় সমস্যার সমাধান যেন দেশীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মাধ্যমেই হতে পারে, সে দিকে নজর রাখা, এক কথায় ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ে তোলা হল সাম্প্রতিক বিজ্ঞাননীতি। এই নীতিতে ইনোভেশন বা বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকের চর্চার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে ‘ইনভেনশন’ বা ‘ইনোভেশন’ লক্ষ্য যা-ই হোক, নতুন শিক্ষানীতি-বিজ্ঞাননীতিতে তার জন্য বরাদ্দ কিন্তু আশ্চর্য রকমের কম। বাজেটে শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ক্রমাগতই তলানিতে নেমে আসছে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৪৫,০৩,০৯৭ কোটির কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট ধার্য হয়েছে ১,১২,৮৯৯ কোটি টাকা (২.৫০৭%)। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ হয়েছে ১৬,৩৬১ কোটি (০.৩৬%), যেখানে এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ উন্নত ও উন্নতিশীল দেশ মোট বরাদ্দের ২.৮ থেকে ৩.৫ শতাংশ খরচ করে।
বদল আসছে অবশ্য অন্য জায়গায়। গবেষণা খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান এত দিন বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছত। বিজ্ঞানীরা কী কাজ করতে চান আর তার জন্য কোন খাতে কত খরচ হতে পারে তার হিসাব দিয়ে অনুদানের জন্য আবেদন করেন; সেই সব আবেদন খুঁটিয়ে দেখে অনুদান মঞ্জুর করা হয়। তাই গবেষণা-প্রকল্প মঞ্জুর হওয়া এক জন বিজ্ঞানীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০০৮ সাল থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ‘সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল’ নামক একটি সংস্থার মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার অনুদান পৌঁছে যায়; তা ছাড়াও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, পারমাণবিক শক্তি বিভাগ ইত্যাদি সংস্থাও কিছু বিশেষ ধরনের গবেষণার অনুদান মঞ্জুর করেন। সম্প্রতি এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে একটি ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (এনআরএফ) সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এখন থেকে সেটিই হবে গবেষণাক্ষেত্রে আর্থিক অনুদানের প্রধান উৎস। এই সংস্থার ষোলো সদস্যের পরিচালন কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ইত্যাদি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। এ ছাড়া দু’জন ডিএসটি-র সদস্য, এক জন সমাজবিদ্যার প্রতিনিধি, শিল্পমহলের পাঁচ জন সদস্য, বাকি ছ’জন ‘প্রোজেক্ট বিশেষজ্ঞ’ বা পরীক্ষক, যাঁরা একটি গবেষণা প্রকল্পের নির্দিষ্ট কাজের মূল্যায়ন করবেন। সুতরাং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কোন বিষয়ে সরকার কত অনুদান দেবে, কোন গবেষণা দরকারি আর কোথায় সরকারি টাকার ‘অপচয়’ হচ্ছে, তা ঠিক করবেন— বিজ্ঞানীরা নন, প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত একটি আধা বাণিজ্যিক, আধা রাজনৈতিক দল।
আগামী পাঁচ বছরে এই সংস্থা বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় মোট ৫০,০০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহের মতে এই জাতীয় সংস্থাটি বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে অনুদানের বৈষম্য দূর করবে; অনুদানের ‘গণতন্ত্রায়ন’ ঘটিয়ে আইআইটি ও সমতুল্য সংস্থার একাধিপত্য কমিয়ে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এমনকি দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তের গবেষকদের কাছেও যথেষ্ট অনুদান পৌঁছে দেবে, এখন যাঁরা সব মিলিয়ে মোট অনুদানের মাত্র ১১% পান।
কিন্তু প্রদীপের নীচে অনেক অন্ধকার, হিসাবের অনেক গরমিল। প্রথমত, এই সংস্থার ৫০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩৬ হাজার কোটি টাকাই (৭২%) আসবে শিল্প-বাণিজ্য মহল থেকে। ফলে খুবই স্বাভাবিক যে গবেষণা প্রকল্পের মঞ্জুরি/অনুদানের ক্ষেত্রেও তাঁদের মতামতই মুখ্য হয়ে উঠবে; সেই সব কাজই অনুদান পাবে যাদের সরাসরি প্রায়োগিক বা বাণিজ্যিক মূল্য আছে। দ্বিতীয়ত, পাঁচ বছরে সরকার মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে; অর্থাৎ চলতি অর্থবর্ষে যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি খাতে সামান্য টাকা ঢালা হয়েছে, সরকার পাঁচ বছরে তার চেয়েও কম ব্যয় করবে। এর মানে হল গবেষণাকে পুরোপুরি ‘প্রোজেক্ট-মুখী’ এবং ‘কর্পোরেট’ নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা। এর মধ্যে সমাজবিদ্যার গবেষণাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া হল, যদিও তার গুরুত্ব দৃশ্যতই অনেক কম, তাই সেখান থেকে মাত্র এক জন সদস্য।
আমাদের গবেষণার টাকা পাওয়ার পদ্ধতি মোটেই বৈষম্যহীন নয়, বরং কিছুটা তেলা মাথায় তেল পড়ার মতো। উন্নত পরিকাঠামো, উচ্চস্তরের ফলাফল যাঁদের আছে, সেই সব বিজ্ঞানীর কাছেই অনুদানের বেশির ভাগ টাকা পৌঁছয়। যাঁদের সে সব নেই, তাঁদের কাছে প্রায় কিছুই পৌঁছয় না, তাঁরা উন্নত হয়ে ওঠার সুযোগও পান না। তবে কিনা, একাধিক জায়গা থেকে অনুদান পাওয়ার সুযোগ থাকলে যে প্রোজেক্ট এক জায়গা থেকে অনুদান পায়নি, তাকে অন্য সংস্থার কাছে পাঠানো যায়। কিন্তু অনুদানের উৎস একটিমাত্র হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রবল হয়ে ওঠে এবং নানা অস্বচ্ছতার সম্ভাবনা বাড়ে। তার মধ্যে কোন বিচারে কী রকম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইআইটি, আইআইএসসি-র মতো উচ্চমানের গবেষণাকেন্দ্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মন্ত্রীর ভাষায় ‘প্রান্তিক, গ্রামীণ ও আধা-শহুরে’ অঞ্চলের গবেষণাগার প্রোজেক্টের অনুদান ‘জিতে নেবে’, সে গোপন কথাটি শুধু মন্ত্রীই জানেন।
সুতরাং, মিত্রোঁ, আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে! ব্যাপারটা বেশ কয়েক বছর ধরে পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। প্রথমে আপনার গবেষণার অনুদান কমিয়ে দেওয়া হল, তার পর ছোট-বড় অনুদানের উৎসগুলো বন্ধ করে সব কিছু ‘এক ছাতার তলায়’ আনার পদ্ধতি শুরু হল, তার পর আপনাকে ক্রমাগত কর্পোরেট দফতরের এক জন অংশীদার রাখতে (মানে সেখান থেকে গবেষণার টাকা জোগাড় করতে) বলা হল। এর মধ্যে আপনাকে পাখি পড়াবার মতো করে ভারতীয় জ্ঞানধারার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে; প্রাচীন ভারতে বিমান, দূরদর্শন, স্টেম-সেল গবেষণা, টেস্টটিউব বেবির জন্ম, ইত্যাদির অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করা হয়েছে। অন্য দিকে, দেশের ‘ভবিষ্যতের জন্য’ ‘দরকারি গবেষণার’ দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আপনার জন্য অন্য সব দরজা বন্ধ করে ‘এনআরএফ’ নামক একটিই দরজা খোলা রাখা হল, যেখানে কর্পো-কুবেররা বসে আছেন। তাঁদের পছন্দমতো কাজ না করে আপনার উপায় কী! এখানে মৌলিক বিজ্ঞান থেকে সমাজবিদ্যা অবধি বিষয়গুলো, যাদের সরাসরি ‘বাজার-মূল্য’ নেই, তারা কতটুকু সুযোগ পাবে সেটা একেবারে পরিষ্কার।
এক কথায় এনআরএফ গঠনের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান-গবেষণার উপর সরকারি এবং কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ কায়েম করারই পদ্ধতি সম্পন্ন হতে চলেছে। মাঝখান থেকে যে মেধাবী তরুণ-তরুণীরা দিনরাত এক করে গবেষণা করে চলেছেন, তাঁদের হাতে রইল শুধু টেস্টটিউব। গবেষকদের নিজস্ব বৃত্তি চূড়ান্ত অনিয়মিত। নিয়মের ফাঁদে শীর্ষস্থানীয় গবেষণাকেন্দ্রেও টাকা আসছে না। গবেষণার টাকা পেতে বিজ্ঞানীদেরও ‘জ়িরো ব্যালান্স’ অ্যাকাউন্ট খুলতে হচ্ছে, যেখানে খরচ হলে তবেই টাকা ঢুকবে। কিন্তু গবেষণা যে ঠিক লাভজনক ব্যবসা নয়, এই কথাটা সরকারকে বোঝাবার লোকও নেই। শুধুমাত্র চন্দ্রযানের আলোয় কিন্তু দেশের গবেষণার ভবিষ্যতের অন্ধকার দূর হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy