যন্ত্রকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তাকে দিয়ে মাথা খাটানোর এক আশ্চর্য উপায় বার করেছে মানুষ। সেই কৃত্রিম মেধা অতি দ্রুত এমন শিল্প সৃষ্টি করছে, যা মানুষেরই কল্পনাতীত। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে যে, এআই-নির্ভর শিল্প আসলে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত বা সৃষ্টিশীল, আর এর সৃষ্টিশীলতার পিছনে মানুষের ভূমিকা কী? এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিল্পী যখন কোনও মানুষ, তখন তাঁর স্থান, কাল, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান, চিন্তাশক্তি সবই এক সঙ্গে কাজ করে একটি সৃষ্টিশীল শিল্প ভাবনার পিছনে। অন্য দিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শিল্প সৃষ্টি, বা গাণিতিক সমস্যার সমাধান, বা যৌক্তিক কার্যকারণ সম্পর্কিত উত্তর খুঁজতে গেলে সেই বুদ্ধির বহর মানুষকেই তৈরি করতে হবে।
তার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বা বিষয়ের প্রচুর পরিমাণে তথ্য প্রয়োজন মতো গেলাতে হবে এই সিস্টেমকে। এই প্রশিক্ষণের পদ্ধতি পুরোপুরি তথ্যভিত্তিক। কোন প্রেক্ষাপটে কিসের অনুপ্রেরণায় একটি শিল্প জন্ম নেয়, তা বোঝার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিলেবাসের বাইরে। সে শুধু বোঝে শিল্পের নানা উপাদান এবং নানা শিল্পকর্মের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ককে। তার এই তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে মানুষ সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পরিচালিত করে। তবে কি আদৌ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সৃষ্টিশীলতার বিচার সম্ভব?
প্রথমত, বর্তমান এআই সিস্টেম কোনও বিশেষ শিল্প সৃষ্টি করতে গেলে সেই সংক্রান্ত কোনও পূর্বাপর চিন্তাভাবনা বা আবেগ-অনুভূতির দ্বারা চালিত হয় না। মানুষ তাকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী চালনা করে। এআই শিল্প সৃষ্টি করে মানুষেরই তৈরি করা প্রোগ্রাম মেনে, মানুষের নির্দেশে— নিজের ইচ্ছায় নয়। ফলে আমরা এটা বিচার করার কোনও জায়গাতেই নেই যে, কেন এআই একটা বিশেষ শিল্প সৃষ্টি করল, বা সেই শিল্প সৃষ্টির সময় সে কী ‘অনুভব’ করেছিল। ছবি, সঙ্গীত, ভিডিয়ো নির্বিশেষে এআই-উৎপাদিত শিল্পকর্মের একমাত্র যে দিকটি বিচারের আওতায় আসতে পারে, তা পূর্বাপর সম্বন্ধবিহীন— বিচ্ছিন্ন বা একক ভাবে শুধুমাত্র সেই শিল্পকর্মটিই।
কৃত্রিম মেধার ‘হ্যালুসিনেশন’ বা বিভ্রমের কথাও ভুললে চলবে না। ধরা যাক কোনও সময়ে ঘটা একটি বিশেষ ঘটনা প্রসঙ্গে কোনও চ্যাটবটের কাছে জানতে চাওয়া হল। যদি তার সিস্টেম সেই বিশেষ তথ্যে প্রশিক্ষিত না থাকে, তবে তার সংগ্রহে থাকা এমন ধরনের অন্য তথ্য অনুসরণ করে সে অবিকল অথচ ভুল কোনও উত্তর পরিবেশন করবে। দিনক্ষণ, খবরের কাগজের প্রতিবেদনের উল্লেখ-সহযোগে খুবই বাস্তবসম্মত মনে হবে উত্তর। কিন্তু, পুরোটাই তার ‘মনগড়া’। তথ্যভিত্তিক বা যুক্তিমূলক প্রশ্নের ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখে বোঝা সম্ভব যে, সেই উত্তর কতটা সরে যাচ্ছে মূল অনুরোধের থেকে। কিন্তু শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন কোনও রেফারেন্স পয়েন্ট থাকে না, যাতে এই বিচ্যুতি বোঝা সম্ভব। যেমন, ধরা যাক চ্যাটজিপিটি-কে কোনও বিমূর্ত ছবি আঁকার নির্দেশ দেওয়া হল। যে ছবি সে তৈরি করে দেখাবে, তা সত্যিই মননশীল একটি শিল্পকর্ম, না কি স্রেফ ‘মনগড়া’ হিজিবিজি আঁকিবুকি, তা বোঝার কোনও উপায় নেই। বলতে পারেন, এই বিচ্যুতিই তাকে এক রকম ভাবে সৃষ্টিশীল বা মৌলিক করে তোলে। তবে, একে শিল্প বলা যায় কি না, সেটা আলাদা প্রশ্ন। এই বিচ্যুতি বা হ্যালুসিনেশন এআইয়ের স্বতঃপ্রণোদিত উৎপাদন, না কি সিস্টেমের মধ্যেই অবস্থিত কোনও তথ্যের অনুকরণ, না কি অজানা কোনও চেষ্টার মাধ্যমে তার সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ, এই প্রশ্নের উত্তর এখনও গবেষণাধীন।
চার পাশে হয়ে চলা ঘটনাপ্রবাহ বা যে কোনও শিল্পকর্মকে আমরা যে যার নিজের অনুভূতি, মেধা দিয়ে বিচার করি। সেই ঘটনা বা শিল্পকে ‘এক থেকে দশ’-এর মাপকাঠিতে বিচার করি না, বা সেই ঘটনার পিছনে কত শতাংশ দুঃখের সঙ্গে কত শতাংশ রাগ মিশিয়ে কত শতাংশ হিংসার উপাদান ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ভাবতে বসি না। কাজের ভাবনার সময় শিল্পীও সে ভাবে ভাবেন না। এআইকে কিছু তৈরি করতে দেওয়ার সময় তাকে কিন্তু প্রতি পদে বলে দিতে হয়, কোন উপাদান আপনি কতটা মেশাতে চাইছেন। নিখাদ গাণিতিক হিসাব মেনে চলে তার সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা। ফলে এআই চ্যাটবটের সঙ্গে আমাদের কথোপকথনই হোক, বা এআইয়ের তৈরি করা কোনও শিল্পকর্ম, আমাদের চিরাচরিত স্বভাবগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার বিচার করলে তার সঠিক মূল্যায়ন হয় না।
শিল্প সম্বন্ধে এআই ততটুকুই জানে, একাধিক শিল্পী এবং তাঁদের শিল্পকর্ম সম্বন্ধে যতটা তথ্য তাকে শেখানো হয়েছে। ফলে এআইকে দিয়ে শেক্সপিয়রের স্টাইলে সনেট লেখাতে চাইলে সে হুবহু তাই লিখবে। কিন্তু কোনও নতুন শিল্পরূপ আবিষ্কার করার তার উপায় নেই। মানুষের যতটুকু জ্ঞান আর যেটুকু সৃষ্টি করার ক্ষমতা, এআই তার উপরেই নির্ভর করে শিল্প সৃষ্টি করছে। তবে কি মানুষের সীমিত কল্পনা এআইয়ের সৃষ্টিশীলতাকেও বেঁধে দেবে? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। অন্তত যত দিন অবধি অন্য সম্ভাবনার দরজা না খুলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy