সতর্কবার্তা: রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন চলাকালীন এক প্রতিবাদীর তুলে ধরা ব্যানার। ১৩ নভেম্বর ২০২১, গ্লাসগো। রয়টার্স।
সদ্য সমাপ্ত গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনের সঙ্গে প্রায় এক যুগ আগে হওয়া কোপেনহাগেন জলবায়ু সম্মেলনের বেশ খানিকটা মিল আছে। সম্মেলন উপলক্ষে গোটা কোপেনহাগেন ঢেকে গিয়েছিল ‘হোপেনহাগেন’ বিজ্ঞাপনে। আশা করা হয়েছিল, ওবামা থেকে মনমোহন সিংহ, পৃথিবীর তাবড় নেতার উপস্থিতিতে জলবায়ু সঙ্কট থেকে বেরোবার রাস্তা পৃথিবী সহজেই খুঁজে পাবে। যেমন একই ভাবে মনে করা হচ্ছিল, বিশ্বের বিজ্ঞানীদের নিয়ে তৈরি ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘লাল সঙ্কেত’ দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গ্লাসগো সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধানরা পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর নিদান দিতে পারবেন। হোপেনহাগেনের মতোই আর একটা শব্দবন্ধের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকেছিল এডিনবরা আর গ্লাসগোর প্রতিটি রেলস্টেশন থেকে রাস্তার মোড়, ‘নেট জ়িরো’। সোজা কথায়, বিভিন্ন দেশ কবে তাদের কার্বন নিঃসরণ শূন্য করবে তার অঙ্গীকার। মনে হচ্ছিল ‘নেট জ়িরো’ই পৃথিবীকে বাঁচানোর জিয়নকাঠি।
নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকাকে বিশ্ব জলবায়ু কূটনীতিতে ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ‘নেট জ়িরো’ শব্দবন্ধটিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। পরবর্তী কালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ‘নেট জ়িরো’র ব্যাটন নিয়ে নেন হগওয়ার্টস-এর দেশে জলবায়ু সম্মেলনকে সফল করার ম্যাজিক মন্ত্র হিসাবে। ‘নেট জ়িরো’ নিয়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন এতটাই কূটনৈতিক চাপ বাড়ায় যে, ঘোষিত বিরোধিতা সত্ত্বেও, গ্লাসগোয় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও ২০৭০ সালে ভারতের নেট জ়িরোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু নেট জ়িরোর মধুচন্দ্রিমা কাটতে বেশি সময় লাগেনি। দ্রুতই বোঝা গিয়েছিল, এ যেন কাল যে কী খাবে জানে না, তাকে আগামী বছর বিরিয়ানি খাওয়ার স্বপ্ন দেখানো। একের পর এক বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে স্পষ্ট হচ্ছিল, জলবায়ু বিপর্যয় দোরগোড়ায়; আগামী দু’দশকের মধ্যেই উন্নত দেশগুলির কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দু’দশক বা আরও পরে ঘোষিত ‘নেট জ়িরো’র অঙ্গীকার, সার্বিক ভাবে সমর্থনযোগ্য হলেও, এতে প্রায় আইসিসিইউ-তে ঢুকে পড়া রোগী বাঁচবে না।
নেট জ়িরো আসলে উন্নত দেশগুলির কাছে জলবায়ুর দর কষাকষির ঘুঁটি ছাড়া কিছু নয়, যাকে সামনে রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য থেকে শুরু করে ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করার মতো এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়গুলিকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সম্মেলনের প্রধান ব্রিটিশমন্ত্রী আলোক শর্মা প্রথম সপ্তাহের শেষে আলোচনার যে রূপরেখা প্রকাশ করলেন, তাতেই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল! দেখা গেল, প্রায় এক যুগ আগে কানকুন জলবায়ু সম্মেলনে দাঁড়িয়ে উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিকে ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার রূপায়ণের কোনও নির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই। স্পষ্ট হল, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় ঘরছাড়া, জীবিকা হারানো মানুষগুলির জন্য যে ক্ষতিপূরণের কথা উঠছে, যার পোশাকি নাম ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’, তা নিয়ে তেমন কোনও অঙ্গীকার নেই। কয়লা-সহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি মাটির নীচ থেকে তোলা ও ব্যবহার কমানো নিয়ে আদৌ কোনও শব্দই নেই। মনে রাখতে হবে, ঠিক একই ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন সামলানোর মূল দাবিগুলিকে জোর করে পিছোনোর কারণেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল কোপেনহাগেন সম্মেলন। কিন্তু ইতিমধ্যে এক যুগ সময় পেরিয়ে গিয়েছে; জলবায়ু রাজনীতি ও কূটনীতি পাল্টিয়েছে অনেকখানিই। যেমন উন্নত দেশগুলি বুঝেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার হাত থেকে তারাও রক্ষা পাবে না এবং উষ্ণায়ন কমানোই ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অন্যতম চাবিকাঠি, তেমনই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিও বুঝছে যে, উন্নত দেশগুলিকে বাদ দিয়ে জলবায়ু সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাশাপাশি প্রবল হয়েছে জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে পৃথিবীব্যাপী সামাজিক আন্দোলন, বিশেষ করে সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে অল্পবয়সিদের আন্দোলন। গ্লাসগোতেও একের পর এক বিশাল জনসমাবেশে জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে বিশ্বনেতাদের সিদ্ধান্তহীনতা তীব্র ভাবে সমালোচিত হয়েছে।
এই সম্মিলিত চাপকে উপেক্ষা করতে পারেনি গ্লাসগোও। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক দিন পর যে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটা দুর্বল, রাষ্ট্রপুঞ্জের ভাষাতেই এক আপস চুক্তি। তা সত্ত্বেও বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে গোড়ার তুলনায় খানিকটা হলেও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে উন্নত দেশগুলি। হয়তো এক্ষুনি আর্থিক সাহায্য নিয়ে খুব বড় কোনও অঙ্গীকার নেই; কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশ অ্যাডপটেশন ফান্ড-এ বাড়তি আর্থিক সাহায্য করার কথা জানিয়েছে। উন্নত দেশগুলি ২০২৩ সাল থেকে মোটামুটি ভাবে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছে এবং এ-ও মেনেছে যে, ২০২৫ সালে আরও কতটা বাড়ানো যায় তার সিদ্ধান্ত হবে। সবচেয়ে বড় পাওয়া, গত কয়েক বছরে উন্নত দেশগুলির চাপে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’-এর প্রায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্টাইলে কামব্যাক। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফল ও বিশ্বব্যাপী একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জোড়া চাপ উন্নত দেশগুলিকে বাধ্য করেছে আপাতত আগামী এক বছর এ বিষয়ে একটি সার্বিক আলোচনা মেনে নিতে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, মিশরে আগামী বছরের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এ বিষয়ে আর্থিক সাহায্য ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। পাশাপাশি এই প্রথম কয়লার ব্যবহার কমানোর বিষয়টিও সিদ্ধান্তে ঢুকেছে।
অনেকের মতে এই সিদ্ধান্তগুলি সঠিক পথে হলেও তা খানিকটা দুধের বদলে পিটুলিগোলার শামিল, আবার অনেকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো আর সৌরশক্তির রমরমার উদাহরণ দিয়ে বলছেন, শেষে জলবায়ু সঙ্কটের সমাধান রাজনীতি নয়, বাজার অর্থনীতিই করবে। ভয়টা এখানেই। যে মুহূর্তে জলবায়ু সঙ্কট মেটাতে বাজার অবতীর্ণ হবে মসিহার ভূমিকায়, তখন হয়তো নিউ ইয়র্ক, দিল্লি বা কলকাতার মতো বড় শহরে জলবায়ু সঙ্কটের তীব্রতা কমাতে কিছু ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের জন্য কিছুই হবে না, কেননা সেখানে বাজারের লাভ নেই। আরও বেশি করে গরিব মানুষ জলবায়ু সমস্যার জাঁতাকলে পড়বেন।
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ইতিমধ্যেই জলবায়ু সঙ্কটে পড়া গরিব মানুষের সংখ্যা প্রচুর। এক দিকে হিমালয় এবং অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর থাকার দরুন এ রাজ্যের জলবায়ু বিপন্নতা অত্যন্ত বেশি। সুতরাং এই রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের নিজেদের বিপন্নতার কথা বলা ও সাহায্যের জন্য দাবি তোলার সময় এসেছে। বিশেষ করে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ও অনন্য জীববৈচিত্র ভরা সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য, যে অঞ্চল এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম ক্লাইমেট হটস্পট। গ্লাসগো সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে আগামী কাল থেকেই সুন্দরবন ও বাকি রাজ্যে সেই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy