Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Economic Growth

আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় অর্থনীতির চেহারাটি কি বহুলাংশে বাড়িয়ে বলা? প্রকৃত ছবিটি কেমন?

বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের স্থান কি সত্যিই খুব আশাব্যঞ্জক? নাকি কোনও ভুল ব্যাখ্যা এক মিথ্যে আশা তৈরি করছে?

প্রতীকী ছবি।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ১০:১৯
Share: Save:

ভারতের অর্থনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গুঞ্জন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই গুঞ্জনের সারমর্ম হল, ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছু কালের মধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে চলেছে। এই বিশেষ বক্তব্যের পক্ষে সর্বাগ্রে আর্থিক দুনিয়ায় ভারতের সাফল্যগুলি তুলে ধরা হয়। কিন্তু কার্যত এটা ভুল জায়গায় আলো ফেলার শামিল। ভারতীয় অর্থনীতির ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনার দিক নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না।

এই মুহূর্তে ভারত কিন্তু বিশ্বের দ্রুততম গতিছন্দের বৃহৎ অর্থনীতির দেশ নয়। ২০২২ সালে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৭ শতাংশ। তার পরের স্থানটিতেই ছিল ভিয়েতনাম। সেখানে বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ফিলিপিন্স ৬.৪ শতাংশ বৃদ্ধির হার অর্জন করে ভারতকে অতিক্রম করে গিয়েছে। আয়তনের দিক থেকে এই সব দেশের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে অনেকটাই ছোট। কিন্তু সৌদি আরব এখন ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এবং পরের দু’টি দেশ ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্স বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, মিশর এবং দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চিনের গুরুত্বকে স্বীকার করে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ তত্ত্ব যারা তুলে ধরে, তাদের ‘প্লাস ওয়ান’-এর হিসেবে কিন্তু ভারত পড়ছে না। বরং সেই জায়গা দখল করছে ভিয়েতনাম। সত্যি বলতে, পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ভারতের সংযুক্তি তেমন নিবিড় নয়। সেই সঙ্গে ভারত রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ (আরসিইপি)-এর অংশও নয়। এই প্রেক্ষিত থেকে দেখলেতাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া (যারা ‘ব্যাঘ্রশাবক’ বলে পরিচিত)-র মতো দেশের সঙ্গে ভারতকে এক পঙক্তিতেফেলাও হয় না। পশ্চিম গোলার্ধে রফতানির নিরিখে দেখলেভিয়েতনাম এই মুহূর্তে চিনের প্রায় সমপরিমাণ বস্ত্র আমেরিকায় সরবরাহ করে। আবার অন্য দিকে, উঠতি খেলোয়াড় হিসেবে ভারত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যদের তুলনায় বাজার হিসেবেও তার আয়তন বড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ‘ব্যাঘ্রশাবক’দের দলকে অতিক্রম করে উঠতে পারেনি। বৃদ্ধির নিরিখে পয়লা নম্বরে উঠে আসতে গেলে তার অনেক কিছু করার বাকি।

দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিতে দেখলে ভারতের প্রকৃত সাফল্য বৃহদায়তন আর্থিক ক্ষেত্রে তার ব্যবস্থাপনার তীব্র উন্নতির মধ্যেই লক্ষ করা যায়। পাইকারি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সত্তরের দশকে গড়ে ছিল ৯ শতাংশ। আশির দশকে তা ৮ শতাংশে নেমে আসে। পরবর্তী দু’দশকে তা আরও কমে ৬ শতাংশের কিছু বেশি ছিল। গত দশকে তা ৪ শতাংশের কম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কনজিউমার প্রাইস (অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাপেক্ষে ভোক্তা যে মূল্য প্রদান করেন)-এর মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে। বিগত দশকে তা ৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার আগের দুই দশকে তা ছিল ৭.৫ শতাংশ।

যে সময়ে রাজস্ব ঘাটতি (কেন্দ্র ও রাজ্যউভয় তরফেই) চোখে পড়ার মতো বেশি, সেখানে কী কারণে মুদ্রস্ফীতি উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে এল, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জরুরি। ১৯৯১-পরবর্তী আর্থিক সংস্কারের সময় কেন্দ্র সরকারের রাজকোষের ঘাটতি মেটানোর জন্য নোট ছাপিয়ে ফেলেনি। তার বদলে সরকার টাকার বাজার থেকে ঋণ নিয়েছিল। এতে আখেরে লাভই হয়। সরকারের ব্যাঙ্ক-নির্ভরতা কমে আসে। মনে হয়মুদ্রাস্ফীতি কমে আসার পিছনে এটি একটি বড় কারণ। এবং এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসারও বিষয়।

বাইরের দিক থেকে দেখলেওউন্নতি যে ঘটেছে, তাতে সন্দেহ নেই। নব্বইয়ের দশকে ডলার-ঘাটতির যুগ শেষ হয়। ১৯৯২-২০০২ পর্বে ব্যালান্স অফ পেমেন্টস (কারেন্ট এবং ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টকে একসঙ্গে ধরেই) থেকে ৫২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছিল। পরেরদশকেতাচারগুণবেড়ে২১২ বিলিয়নডলারেদাঁড়ায়এবংসাম্প্রতিকদশকে তা ফুলেফেঁপে ৩৫৪ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। আরও একটি বিষয়, এই কালপর্বে বিদেশি সাহায্য এবং ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। এই সব কিছুর সম্মিলিত ফল প্রতিফলিত হয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বৈদেশিক বিনিময় তহবিলে।

মনে রাখা দরকার, এই সময়ে পণ্যবাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমেছে। সাম্প্রতিক দশকে বাৎসরিক গড় ঘাটতি ১৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। ১৯৯২-২০০২ দশকে এই ঘাটতি ছিল মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলার। তবে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে, দেশের অর্থনীতির আয়তনও তখন এত বড় আকার নেয়নি। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-র নিরিখে পণ্যবাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ এই মুহূর্তে ৫-৬ শতাংশ। আগের দশকগুলির তুলনায় যা রীতিমতো বেশি। কিন্তু এই ঘাটতির বড় অংশই পূরণ হয়ে যাচ্ছে পরিষেবা রফতানি দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগের ক্রমবৃদ্ধি (গত তিন দশকে প্রায় ৯৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার)।

দেশের অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি এক স্থিতিশীল মুদ্রাব্যবস্থাকে সম্ভব করে তুলেছে। আমেরিকান ডলারের নিরিখে এক সময় ভারতীয় টাকার দর হু হু করে পড়ছিল। ১৯৬৬ সালের টাকার বিমূল্যায়ন থেকে ১৯৯১-৯৩ কালপর্বের ‘সংস্কারমূলক বিমূল্যায়ন’-এর সময়পর্বে টাকার দর গড়ে প্রতি বছর ৫.৫ শতাংশ কমেছে। সংস্কারের পরে তা গড় বার্ষিক ৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। গত দু’দশকে তা ২.৪-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

দশকের পর দশক ধরে এই সব পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফল আরও বেশি স্থিতিশীল অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও সম্ভব হয়েছে। যা বাকি রয়ে গিয়েছে, তা হল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য এক দ্রুতগতির পথ নির্ণয়। যা সম্ভব হলে ক্রমাগত ঢক্কানিনাদের প্রয়োজন পড়বে না। বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এই কাঙ্ক্ষিত গতির অভাবই ভারতকে পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের অর্থনীতির পাশে দাঁড়াতে দেয়নি। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা এক প্রকার আত্মবিশ্লেষণ। কোনও শূন্যগর্ভ আত্মপ্রচার নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Economic Growth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy