পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে রয়েছে একটি পাগ, পার্থই তার নাম রেখেছিলেন ‘কিউটি’। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দু’চার পশলা বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তা। পুরসভার ভেপার ল্যাম্পের আলো সেই রাস্তায় পড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিন্তু ভরসন্ধ্যায় সেই আলোর ছটা পৌঁছচ্ছে না গলির শেষ প্রান্তের ডান দিকের সাদা বাড়িটিতে। বাড়ির নাম ‘বিজয়কেতন’। মালিকের নাম পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক। গত বছর ২২ জুলাই সকালে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে ইডি আধিকারিকেরা ঢুকেছিলেন এই বাড়িতে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ২৩ জুলাই সকালে পার্থকে নিয়ে তাঁরা বেরিয়েছিলেন এই বাড়ি থেকে।
বছর ঘুরে গেল। পার্থ ঘরে ফেরেননি। তাঁর ‘বিজয়কেতন’ এখন পার্থের মতোই একলা।
গত এক বছরে বার বার তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করেছে আদালত। নিম্ন আদালতের বিচারকের উদ্দেশে মরিয়া পার্থ বলেছিলেন, ‘‘ধর্মাবতার, আমিই যদি বেঁচে না থাকি, তা হলে কার বিচার করবেন!’’ কিন্তু কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তীব্র আপত্তিতে পার্থের কাতর আর্জি ধোপে টেকেনি আদালতে। গ্রেফতারের পর প্রথম রাত কেটেছিল এসএসকেএমে। তার পর আদালতের নির্দেশে দেড় দিন ভুবনেশ্বর এমস। সেখান থেকে ফিরে সোজা সিজিও কমপ্লেক্সে ইডি হেফাজতে। তার পর থেকে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার। একটি সেলে একা।
মন্ত্রী থাকাকালীন দলের অন্দরে পার্থকে নিয়ে এমন একটা আলোচনা ছিল যে, তিনি খুব একটা দফতরে যান না। শিক্ষা দফতরের কত ঘোষণা যে পার্থ নাকতলার এই বাড়ি থেকে করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই! বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটি ছায়াচ্ছন্ন ‘শেড’। সেখানে বসে সাংবাদিক বৈঠক করতেন পার্থ। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। রয়েছে নানান অভিব্যক্তিতে পার্থের ছবিও। ঝুলছে ছ’টি সিলিং পাখা। ঘুরছে দু’টি। বাকি চারটি বন্ধ। পাখার নীচে বসে মোবাইল ঘাঁটছেন দু’জন হোমগার্ড। বারুইপুর পুলিশলাইন থেকে এমন তিন জন পালা করে পার্থের বাড়ির দুয়ারে পাহারা দেন। তাঁদেরই এক জন জানালেন, ‘‘সাহেবের (পার্থ) বাড়ির ডিউটি করছি অনেক দিন হল। এখন আর ভাল লাগে না।’’ কেন? অবসরের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া হোমগার্ড ফেসবুক দেখতে দেখতে বললেন, ‘‘ধুর ধুর! কী ছিল, কী হয়ে গেল! এই জায়গাটাকে এখন শ্মশান মনে হয়।’’ বাড়ির গেটের উপরের গাছটি অযত্নে নুইয়ে পড়ছিল। হোমগার্ড জানালেন, দিন কয়েক আগে তাঁরাই সাহেবের আদরের গাছকে পরিপাটি করে ‘ট্রিম’ করে দিয়েছেন।
পার্থ গ্রেফতার হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করে দল থেকে সাসপেন্ড করেছিলেন দলের মহাসচিব পার্থকে। তার পর থেকে পার্থের সেই পদে কাউকে আনা হয়নি। যেমন রাজ্য বিধানসভায় পার্থের ঘরটিও তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে গত এক বছর।
আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থের গ্রেফতারি আরও বেশি আলোচিত হয়েছিল তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের কারণে। ‘ম্যাডাম’ কি এই বাড়িতে আসতেন? জবাবে কর্তব্যরত পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘ম্যাডাম তো বাইরে থাকেন!’’ আসলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন পার্থ-কন্যার কথা ভেবে। কিন্তু অর্পিতা ম্যাডাম? পুলিশকর্মী হেসে বললেন, ‘‘ও সব ছাড়ুন।’’
ঘটনাচক্রে, গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়া অনুব্রত মণ্ডলের পাশে যে ভাবে দল দাঁড়িয়েছে, দলনেত্রী দাঁড়িয়েছেন, পার্থের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। জেলবন্দি অনুব্রত এখনও বীরভূমের জেলা সভাপতি। সেখানে পার্থ শুধুই তৃণমূলের এক জন বিধায়ক। অনেকে বলেন, পার্থের মহিলা-যোগ ও নগদ টাকার ছবিই দল থেকে তাঁকে যোজন দূরত্বে সরিয়ে দিয়েছে। দলের একাংশের মতে, আরও একটি কারণে পার্থের উপর রুষ্ট নেত্রী। ২২ জুলাই রাতে ইডি কর্তাদের সামনে থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে বার তিনেক ফোন করেছিলেন পার্থ। যা আদালতেও জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
‘বিজয়কেতন’-এর কলিং বেল বাজাতে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন চাপদাড়ি, সুঠাম চেহারার তরুণ। পরনে হাফ প্যান্ট, রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জি। যা থেকে স্পষ্ট যে, তিনি ওই বাড়িতে থাকেন। কিন্তু কে তিনি? জানা গেল না। কারণ, ‘এক বছর তো হয়ে গেল..?’ প্রশ্ন শেষ করার আগেই তরুণ বললেন, ‘‘এ সব নিয়ে কিছু বলব না।’’ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল দরজাও। ওই তরুণের সঙ্গেই ভিতর থেকে কলিং বেলের জবাব দিয়েছিল একটি মিহি গলার সারমেয়। হোমগার্ডদের এক জন বললেন, ‘‘ওটা তো সেই ভোডাফোনের কুকুর (পাগ)! ওর নাম ‘কিউটি’। সাহেবের খুব আদরের ছিল।’’ পার্থ পোষ্য পছন্দ করতেন। অর্পিতার ডায়মন্ড সিটির ফ্ল্যাটের একটি অংশে পোষ্যদের থাকার আলাদা বন্দোবস্তও ছিল। যা নিয়ে এক বার তাঁর পর্যবেক্ষণে মন্তব্যও করেছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাদের কী হল? হোমগার্ড জানেন না। অনেকে জানেন। আনন্দবাজার অনলাইনে তাদের নিয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যেরা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল।
গলির মুখের বাড়িটায় তারস্বরে টেলিভিশন চলছিল। বাড়ির দেওয়ালে ঝুলছে চে গ্যেভারার ছবি। বিছানায় গা এলিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন এক মধ্যবয়সি। পার্থ-গ্রেফতারির বর্ষপূর্তির কথা তুলতেই বলে দিলেন, ‘‘ও সব বাসি হয়ে গিয়েছে! আর ও নিয়ে কিছু বলার নেই।’’ দেখা গেল, নিজের নামও বলার নেই তাঁর। তবে স্থানীয় লোকজন জানালেন, তিনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারী। এলাকায় ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেই পরিচিত। তাঁর মতোই ‘দাদা’র ব্যাপারে কিছু বলতে চাইল না পার্থের নামে খ্যাত ক্লাব ‘নাকতলা উদয়ন সংঘ’-এর সামনে দাঁড়ানো তরুণের দলও। এই ক্লাবের পুজোতেই কেতাদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অর্পিতার সঙ্গে ফোটোশুট করেছিলেন পার্থ।
গত এক বছরে ঘটনার ঘনঘটা চলেছে পার্থকে ঘিরে। শারীরিক পরীক্ষা করাতে নিয়ে গিয়েছে ইডি। সেখানে হাসপাতালের বাইরে জনতা তাঁকে লক্ষ্য করে ‘চোর-চোর’ স্লোগান দিয়েছে। অপরিচিত মহিলা পায়ের চটি খুলে ছুড়ে মেরেছেন। একদা পরিচিতেরা দূরত্ব রচনা করেছেন।
দল তাঁর থেকে মুখ ফেরালেও পার্থ বার বার দল এবং দলনেত্রীর প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা জানিয়েছেন। আদালতে ঢোকা বা বেরোনোর সময়ে কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। কখনও আক্ষেপের সুরে বলেছেন, বিনা বিচারে তিনি জেলবন্দি! এখন বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সংগঠকেরা কোথায়? জেলজীবনে বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রীকে। বন্দি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর হাতে কী ভাবে গ্রহরত্ন শোভিত আংটি এল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আদালত। প্রেসিডেন্সি জেলের সুপারকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। পুলিশও এ ব্যাপারে নোটিস পাঠিয়েছে জেলসুপারকে।
গত এক বছরে প্রকাশ্যে এসেছে পার্থের বিপুল সম্পত্তির খতিয়ান। কসবা রাজডাঙার ‘ইচ্ছে’ অনুষ্ঠানবাড়ি থেকে শুরু করে বারুইপুরের বাগানবাড়ি, প্রয়াত স্ত্রী বাবলি চট্টোপাধ্যায়ের নামে পিংলায় প্রকাণ্ড স্কুল, বোলপুরের ‘অপা’ বাংলোর কথা জেনেছেন রাজ্যের মানুষ। তাঁরা জেনেছেন, মাঝেমাঝে অর্পিতার মামার বাড়ি হুগলির জাঙ্গিপাড়ায় গিয়ে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন পার্থ। গ্রেফতারির পর পার্থ-অর্পিতার সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও নানা মুখরোচক আলোচনা চলেছে। সেই আলোচনা আরও জলবাতাস পেয়েছে কয়েক মাস আগে মামলার ভার্চুয়াল শুনানিতে পার্থ-অর্পিতা হাতের মুদ্রায় পরস্পরকে কুশলপ্রশ্ন করায়। গত এক বছরের বন্দিজীবনে পার্থের ওজন কমেছে অনেকটা। থুতনিতে ফ্রেঞ্চকাট আগের মতোই রয়েছে। আগের মতোই রয়েছে তাঁর পরনের পোশাক। নাকতলার প্রতিবেশীদের অনেকে বলেছেন, তাঁরা দেখেন মাসে-দু’মাসে ‘বিজয়কেতন’ থেকে ধোপদুরস্ত সুতির হাতকাটা ফতুয়া আর ঢোলা পাজামা যায় প্রেসিডেন্সি জেলে।
কবে ফিরবেন পার্থ তাঁর ‘বিজয়কেতন’-এ?
বাড়ির সামনে কর্তব্যরত পুলিশের নিরাপত্তাকর্মীরা ‘সাহেব’ শীঘ্র ছাড়া পাবেন, এমন সম্ভাবনা দেখছেন না। এক জন বলছিলেন, ‘‘মনে হয় না, লোকসভা ভোটের আগে ছাড়বে!’’ কয়েক মাস আগে আদালত থেকে বেরোনোর সময় পার্থ বলেছিলেন, ‘‘এক দিন সত্যের জয় হবেই।’’
দিন গুনছে ‘বিজয়কেতন’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy