Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Rishi Sunak

ঋষির প্রধানমন্ত্রিত্ব নতুন ইতিহাস গড়লেও তাঁর সামনে এখন এক কঠিন যাত্রাপথ

ব্রিটিশ রাজনীতিতে ঋষি সুনকের উত্থান কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। এর পিছনে রয়েছে কিছু দীর্ঘমেয়াদি কারণ।

কতটা কঠিন হবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষির পথচলা?

কতটা কঠিন হবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষির পথচলা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়
রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২২ ১১:০৪
Share: Save:

স্বীকার করতেই হবে যে, ব্রিটেনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খানিক প্রেমের আর খানিক অপ্রেমের। প্রেমের বা পছন্দের অংশটি অনেকখানি ব্যক্তিগত আর আবেগমাখা। আর অপ্রেমের বা বলা ভাল অপছন্দের অংশের বেশির ভাগই উঠে এসেছে আমার ইতিহাসবোধ থেকে। যেখানে ব্রিটেন হিংসা আর জাতিবৈষম্যকে হাতিয়ার করে ভারতীয়দের শাসন করেছে, ভারতের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়েছে। আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখায় আমার যুক্তিবিন্যাসের সমর্থনে উপরোক্ত দু’টি বিষয়কেই কিছুটা খুলে বলা প্রয়োজন।

১৯৭৭-এর অক্টোবরে আমার বিলেত তথা ব্রিটেনযাত্রা ছিল এক ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণ। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই পড়ুয়া হিসেবে ইংল্যান্ড আমাকে মোহিত করে রেখেছিল। তেমন ভাবে দেখতে বসলে বুঝতে পারি, সেই বিলেতপ্রীতির পিছনে ছিল ছেলেবেলায় পড়া বিলি বান্টার সিরিজের বই। বয়ঃসন্ধিতে এসে নেভিল কার্ডাসের লেখা প্রত্যক্ষ ভাবেই আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, যেখানে তিনি ইংরেজদের ‘সামার গেম’ ক্রিকেটকে অতুলনীয় এবং অভূতপূর্ব ভাবে তুলে ধরেছিলেন। আমার স্বপনে-জাগরণে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট খেলার মাঠ (অবশ্যই লর্ডস) তীর্থবিশেষ হয়ে দাঁড়াল। স্কুলের উঁচু ক্লাসে এবং কলেজে পড়ার সময়ে আমি আবিষ্কার করলাম যে, ক্রিকেট মাঠের বাইরেও এক বিরাট জগৎ রয়েছে। এই বৌদ্ধিক পরিবর্তনই আমাকে অক্সফোর্ড যেতে প্রেরণা দিয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমার শিক্ষক এবং উপদেষ্টারা আমাকে অক্সফোর্ড সম্পর্কে এতখানিই জানিয়ে ফেলেছিলেন যে, তখন থেকেই সেই চিত্ররূপময় প্রাসাদনগরীর স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, যাকে কবি ম্যাথিউ আর্নল্ডের ভাষায় ‘সিটি অফ ড্রিমিং স্পায়ার্স’ বলা যায় বা সাহিত্যিক ইভলিন ওয়াঘ তাঁর ‘ব্রাইডসহেড রিভিজিটেড’ উপন্যাসে ‘সিটি অফ অ্যাকোয়াটিন্টস’ বলেছিলেন। আমার সেই বৌদ্ধিক যাত্রায় আমি আমার সব থেকে পছন্দের ইতিহাসবিদকে আবিষ্কার করি। তিনি ক্রিস্টোফার হিল, যিনি অবশ্যই একজন অক্সফোর্ড পুরুষ— ‘মাস্টার অফ বেলিওল’ বা সোজা কথায়, বেলিওল কলেজের প্রধান। অক্সফোর্ড গিয়ে সেখানকার বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে ডুব দেওয়া এবং সেই অবগাহনের জাদুকে অন্তরে-অন্দরে উপলব্ধি করাই আমার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, সেখানকার পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটছি, সেখানকার অগণিত গির্জা থেকে ভেসে আসা প্রার্থনাসঙ্গীত আমার মর্মে এসে পৌঁছাচ্ছে, অক্সফোর্ড পার্কে ক্রিকেট খেলা দেখছি, যেখানে আমার হিরো টাইগার পটৌডি এক সময়ে খেলেছেন এবং অবশ্যই ক্রিস্টোফার হিলকে দেখছি, যাঁর সান্নিধ্য আমি ঐকান্তিক ভাবে পেতে চাইছি।

ঋষি ব্রেক্সিট আন্দোলনের অন্যতম উদ্যমী পুরুষ।

ঋষি ব্রেক্সিট আন্দোলনের অন্যতম উদ্যমী পুরুষ। ছবি: রয়টার্স।

১৯৭৭-এর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বা সেখানকার লব্জ অনুযায়ী ‘মাইকেলমাস টার্ম’-এ যখন পড়তে গেলাম, আক্ষরিক অর্থেই তখন আমার স্বপ্নপূরণ হল। এখন হয়তো বলতে গেলে কেউ পাগলামি ভাবতে পারেন বা কারও কারও হাসিও পেতে পারে, কিন্তু সত্যিই শেষ শরতের এক গোধূলিতে অক্সফোর্ডে পৌঁছে আমার মনে হয়েছিল, ঘরে ফিরলাম।

সেটাই ছিল আমার প্রথম অক্সফোর্ডযাত্রা। একই সঙ্গে আমার প্রথম ব্রিটেনযাত্রা বা আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, প্রথম বিদেশযাত্রা। প্রথম বারের সেই সফরের মেয়াদ ছিল তিন বছরের কিছু বেশি। তার পর সফরের সংখ্যা আর গুনিনি। কত দিন থাকলাম, তা-ও আর ভেবে দেখিনি।

সেই প্রথম অক্সফোর্ড সফর আমার সামনে বৌদ্ধিকচর্চার এক দিগন্তকে মেলে ধরেছিল। অক্সফোর্ড আর লন্ডনের সঙ্গে আমার প্রাণের টান তৈরি করে দিয়েছিল। অক্সফোর্ডের অলিগলিকে আমি ভালবাসতে শুরু করি, সেখানকার গ্রন্থাগারের অতুল সম্পদ, সেই শহরের অনায়াস সৌন্দর্য, তার একান্ত নিজস্ব উপচারগুলিকে এবং তার বিচার-বিশ্লেষণশক্তির ক্রমপরিণতির প্রক্রিয়াকেও ভালবাসতে শুরু করি। একমাত্র এক বার এক ‘গাই ফক্স ডে’-তে একদল হুজ্জুতে ছোকরার সঙ্গে ঝঞ্ঝাট ছাড়া ব্রিটেনে কখনও প্রকাশ্য কোনও জাতিবৈষম্যের উদাহরণ আমি দেখিনি। অবশ্যই জানতাম যে, ব্রিটেনের সমাজে ফল্গুধারায় তেমন এক সংস্কার বয়ে চলেছে। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালেও তার অস্তিত্বকে কেউ অস্বীকারও করতে পারবেন না। সুতরাং, কয়েক মাস আগেও যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতেন যে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আসনে কোনও অন্য বর্ণের মানুষ বসতে পারেন কি না, আমার দৃঢ় এবং দ্বিধাহীন উত্তর হত— না!

ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে ঋষির সৌজন্য বিনিময়।

ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে ঋষির সৌজন্য বিনিময়। ছবি: পিটিআই।

এ বার আমি ব্রিটিশ জাত এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমার অপছন্দের তথা ঘৃণার জায়গাটা খুলে বলতে পারি। অক্সফোর্ড এবং লন্ডনের গ্রন্থাগারগুলিতে পড়তে পড়তে ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে আমি বুঝতে শিখি যে, ব্রিটেনের সমৃদ্ধি আর ‘বৈভব’-এর পিছনে কাজ করছে ঔপনিবেশিক শোষণ। বিশেষত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটে শোভিত সব থেকে উজ্জ্বল রত্ন ভারতের উপর তার চূড়ান্ত শোষণ।

ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিই ছিল চাতুর্যের সঙ্গে নির্মিত জাতিবৈষম্যের নীতি, ভারতবাসীকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার নীতি এবং অবশ্যই ভেদমূলক শাসনের নীতি। ভারতে ব্রিটিশ শাসন আসলে ব্রিটিশ রাজনীতিক, রাষ্ট্রনেতা, বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাস প্রণেতাদের দ্বারা সযত্নে ধামাচাপা দেওয়া এক স্বৈরতন্ত্র। যার পিছনে তাঁরা যুক্তি দিতেন এই বলে যে, ভারতকে সভ্য হয়ে উঠতে গেলে, আধুনিক হয়ে উঠতে গেলে ব্রিটিশ অভিভাবকত্বের প্রয়োজন রয়েছে। উইনস্টন চার্চিলের মতো প্রথম সারির অনেক ব্রিটিশ রাজনীতিক আবার ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পিছনে কোনও কারণ প্রদর্শনের তোয়াক্কাও করতেন না। চার্চিলের মতো সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বাস করতেন যে, ভারতীয়-সহ অন্যান্য ‘নেটিভ’রা বস্তুত নিকৃষ্ট শ্রেণির মানুষ এবং ব্রিটিশদের মতো ‘উন্নততর’ জাতের অধীনে থাকাই তাদের ভবিতব্য। ব্রিটিশ জনজীবনে এমন বোধ যে বেশ পাকাপোক্ত, তা বলাই বাহুল্য। আর ঠিক এখান থেকে দেখলে ঋষি সুনকের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভ অনেক বেশি মনোযোগের দাবি রাখে।

গাত্রবর্ণ এবং বংশপরিচয়ের দিক থেকে অনেকেই ঋষিকে ‘ব্রিটিশ’ বলে মানতে চাইবেন না।

গাত্রবর্ণ এবং বংশপরিচয়ের দিক থেকে অনেকেই ঋষিকে ‘ব্রিটিশ’ বলে মানতে চাইবেন না। ছবি: রয়টার্স।

জাতিবৈষম্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও ব্রিটিশ সমাজ কিছু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সম্মুখীন। সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জন্মকৌলীন্যের উপরে মেধা বা যোগ্যতাকে স্থান দেওয়ার বিষয়টি। এই প্রক্রিয়া কার্যত ভৌমিক আভিজাত্য বা সোজা কথায় জমিদারি সংস্কৃতির পতনের প্রভাবের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই প্রক্রিয়াই ক্লিমেন্ট অ্যাটলি বা মার্গারেট থ্যাচারকে সেই বিশেষ আসনে নিয়ে এসেছিল। সেই সঙ্গে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রাক্তন উপনিবেশগুলি থেকে মানুষের আগমন— এই প্রক্রিয়াকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটেনের বিভিন্ন সরকার উৎসাহিত করেছে। এর পিছনে অবশ্য সস্তায় শ্রমিক আমদানির মতো এক অর্থনৈতিক ভাবনাও কাজ করেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত মানুষের স্রোত ব্রিটেনের সমাজকে এক বহুসাংস্কৃতিক চরিত্র দিয়েছে। যে সব পরিবারকে এক সময়ে অভিবাসী বলে গণ্য করা হত, তারাই আজ ব্রিটিশ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই সব পরিবার বিবিধ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ও অবদানের পরিচয় রেখেছে।

ঋষি সুনকের উত্থানের পিছনে দু’রকমের প্রক্রিয়াই কাজ করেছে। গাত্রবর্ণ এবং বংশপরিচয়ের দিক থেকে অনেকেই তাঁকে ‘ব্রিটিশ’ বলে মানতে চাইবেন না। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, তিনি ব্রিটিশ প্রাতিষ্ঠানিকতার হৃদয়ের উৎসস্রোত থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর পড়াশোনা উইনচেস্টার ও লিঙ্কন কলেজে, অক্সফোর্ডে এবং তার পরে স্ট্যানফোর্ডে। ব্রিটেনের ধনীতম ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম এবং টোরি দলের এক স্তম্ভ বিশেষ। সংস্কারের উপর ইতিহাস এবং জন্মকৌলীন্যের উপর যোগ্যতার বিজয়কে চিহ্নিত করছে ঋষির এই উত্থান।

তাঁর যাত্রাপথ খুব মসৃণ ছিল না। ব্রিটেনের অর্থনীতি এই মুহূর্তে সঙ্কটাপন্ন। ব্রিটেন এখন বিশ্বসভায় অনেকের কাছেই পরিহাসের পাত্র। ঋষি ব্রেক্সিট আন্দোলনের অন্যতম উদ্যমী পুরুষ। তাঁর পূর্বসূরি অতি অল্প কার্যকালের ভিতরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়ে একটি বিল উত্থাপন করে রেখেছেন। ঋষি কি সেই পথেই হাঁটবেন এবং এক ‘লিটল ইংল্যান্ডার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন, না কি ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য-অংশীদার হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার নতুন কোনও রাস্তা খুঁজে বার করবেন? যে সব সমস্যা তাঁর সামনে এই মুহূর্তে রয়েছে, তার কাছে তাঁর গাত্রবর্ণ বা জাতিপরিচয় ঘটিত বিষয়গুলি অতি তুচ্ছ। ঋষির আদর্শ বা রাজনীতিকে কোনও ভাবে সমর্থন না করলেও আমি আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করব এই দেখতে যে, ঋষি কী উপায়ে এই বিপদসঙ্কুল পথ পার হন।

(লেখক অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং ইতিহাসের অধ্যাপক। মতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

Rishi Sunak Britain Britain PM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy