পরী আসলে একটি ম্যানিকুইন। পুতুল। ছবি: নেটফ্লিক্স
এ এক প্রদীপের গল্প। আশ্চর্য প্রদীপ।
প্রদীপের বাড়ি মধ্যপ্রদেশের অজ গাঁয়ে। ভাগ্যাণ্বেষণে সে এসেছে মুম্বই। আলো ঝলমল মায়ানগরীর এক রেডিমেড পোশাকের শো রুমে মহিলাদের সেকশনে সেলস্ম্যানের চাকরি জুটেছে তার। সেই চাকরিতেই তার দিন কাটে। প্রদীপ কাজের ছেলে। চাকরি তার দরকার। সে মন দিয়ে চাকরিটি করেও। তার উপরেই রোজ রাতে শো রুম সাফসুতরো করে, শাটার নামিয়ে তালা বন্ধ করার দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে প্রদীপ নিবেদিতপ্রাণ। ফলে মালিক তার উপর দয়াপরবশ। অবরে-সবরে কিছু বখশিসও জুটে যায়।
কিন্তু প্রদীপের দিনরাত অন্ধকার। সে এক অদ্ভুত নিরাময়-রহিত নিঃসঙ্গতায় ভোগে। ভুগতেই থাকে। মুম্বইয়ের এঁদো বস্তির এঁদোতর ঘরে তার রুমমেট স্মার্টফোনে অবিশ্রান্ত ফ্লার্ট করে মহিলাদের সঙ্গে। প্রদীপ চেয়ে চেয়ে দেখে আর শোনে। প্রদীপের শো রুমের সহকর্মীটি একটি ক্যাসানোভা বিশেষ। সে দোকানের নতুন পোশাক গায়ে এঁটে, নতুন ট্রাউজার্স গলিয়ে রোজ মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে যায়। প্রদীপ হাঁ করে দেখে। কখনও সযত্নে তার আনকোরা পোশাকের ট্যাগ জামার ভিতর লুকিয়ে দেয়। যাতে কারও চোখে না পড়ে। কিন্তু তার নিজের নিঃসঙ্গ জীবন বয়ে চলে একই খাতে। তার দিন কাটে না। তার রাতও কাটতে চায় না। তার কথা বলার কেউ নেই। যেমন কেউ নেই তার কথা শোনার।
দিনের মতো দিন যাচ্ছিল। আচম্বিতে শো রুমে আগমন ঘটে পরীর। ছিপছিপে চেহারা। সরু কোমর। টিকোল নাক। পাতলা ঠোঁট। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। যত্নে আঁকা ভ্রূ। মাথায় রেশমের মতো চুল। স্বপ্নসুন্দরী। পরীর প্রেমে পড়ে প্রদীপ। তার সঙ্গে কথা বলতে থাকে অনবরত। বলতে থাকে তার গ্লানি, তার নিঃসঙ্গতার কথা। নিজের দৈনন্দিনতার কথা। ‘আপ’ বলে সম্ভ্রমসূচক সম্বোধন করে। কখনও পরীকে গান গেয়ে শোনায়। মুহূর্ত তৈরি হতে থাকে।
পরী চুপটি করে শোনে। কোনও কথা বলে না।
পরী শুনতে থাকে প্রদীপের অন্তহীন বাক্যস্রোত। শো রুম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রদীপ তাকে নিয়ে ‘ডেট’-এ বেরোয়। পরীকে নিয়ে যায় সমুদ্রের তীরে। সেখানে বালুতটে যুগলে হাঁটে তারা। হাল্কাফুল্কা পরীকে প্রদীপ বহন করে নিজের পাশে পাশে। কখনও ফাঁকা বালিয়াড়িতে প্রদীপের বুকে হেলান দিয়ে বসে থাকে পরী। প্রদীপ তার কাঁধে হাতজোড়া রেখে সামনে তাকিয়ে সমুদ্রের ঢেউ গোনে। মুহূর্তেরা তৈরি হয়। ফেরার পথে অটো রিকশায় পরীকে বসিয়ে নেয় পাশের সিটে। ‘ডেটিং’ শেষে পরীকে আবার শো উইন্ডোয় ফিরিয়ে দিয়ে প্রদীপ ফিরে যায় তার চিলতে ঘরে। রুমমেটের সীমাহীন ফোন-কথন তখন আর তাকে ততটা উচাটন করে না। কখনও প্রদীপ বান্ধবী পরীর জন্য ঝুটো গয়না কিনে আনে। পরীর গলায় নকল সোনার গয়না পরিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। প্রেমিকার মতো। মুহূর্তেরা বাড়তে থাকে।
পরী চুপটি করে শুধু শোনে। কোনও কথা বলে না।
কিন্তু প্রদীপের সুখের দিন ফুরোয়। সে ধরা পড়ে। শো রুমের সিসিটিভি-র ফুটেজে দেখা যায় পরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপরত প্রদীপকে। দেখা যায়, খালি শো রুমে প্রদীপ পরীকে প্রেম নিবেদন করছে। মালিককে সেই দৃশ্য দেখায় প্রদীপের সহকর্মী। মালিক অগ্নিশর্মা। প্রদীপের চাকরি প্রায় যায়-যায়! হাতে-পায়ে ধরে সে যাত্রা বাঁচে সে। কিছুদিন পর তার সহকর্মী একটি পুরুষকে এনে পরীর পাশে দাঁড় করায়। প্রদীপ বিরক্ত হয়। পুরুষের ‘নজর’ থেকে পরীকে আগলে আগলে রাখে। তার পর একদিন হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে সহকর্মীর সঙ্গে। কারণ, সহকর্মী পরীকে নিয়ে ট্রায়াল রুমের গোপনীয়তায় ঢুকেছিল। সালোয়ার-কুর্তার বদলে পরীকে খাটো পোশাক পরিয়েছিল। প্রদীপ মানবে কী করে! পরী তো প্রদীপের প্রেমিকা। সঙ্গিনী।
পরী চুপটি করে দেখে। চুপটি করে শোনে। তার চোখের পলক পড়ে না। সে কোনও কথা বলে না।
কারণ, পরী চোখের পলক ফেলতে পারে না। পরী কথাও বলতে পারে না। কারণ পরী আসলে একটি ম্যানিকুইন। পুতুল। শো রুমের শো উইন্ডোয় দাঁড়িয়ে মনমোহিনী সাজে সেজে রূপকথা হয়ে অদৃশ্য হাতছানিতে সে ডেকে আনে খদ্দেরদের। কিন্তু কোনও কথা বলে না। শুধু শোনে।
শো রুমের ভিতর মারপিট করায় এ বার আর চাকরিটি বাঁচে না প্রদীপের। মালিকের ঘাড়ধাক্কা খেয়ে প্রদীপ ফিরে যায় গ্রামের বাড়িতে। দিন যায়। পাশের পাড়ার এক তরুণীর সঙ্গে প্রদীপের বিয়ে দিতে উতলা হন মা। ‘পাকা দেখা’ও হয়। একান্ত আলাপে হবু স্ত্রী-কে প্রদীপ বলে, তার চাকরি গিয়েছে। কারণ, সে পুতুলের সঙ্গে কথা বলত। গান গাইত। পুতুলকে নিয়ে বেড়াতে যেত। লোকে ভাবত, সে মানসিক বিকারগ্রস্ত। তাই তাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রদীপ বলে, সে মা-কেও তার চাকরি যাওয়ার কথা বলেনি। কিন্তু ভাবী স্ত্রী-কে বলছে। কারণ সে চায় না, মিথ্যে দিয়ে কোনও সম্পর্ক শুরু হোক। তরুণী তার দিকে পেলব চোখে তাকায়। প্রদীপ বলে চলে, তার দাদুও রেডিওর সঙ্গে কথা বলত। রোজ অন্তত ১৫ মিনিট ধরে মখমলের কাপড় দিয়ে যত্ন করে মুছত সেই রেডিও। দাদু চলে গিয়েছে। রেডিও রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেউ আর তার সঙ্গে কথা বলে না। রেডিও-ও নির্বাক।
তরুণী মন দিয়ে শোনে। তার পর বলে, একসময়ে সে-ও একজনের জন্য পাগল ছিল। কখনও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কিন্তু তার সঙ্গে মনে মনে কথা বলেছে বিস্তর। তরুণী বলে, তার পাগলামি ছিল প্রদীপের চেয়েও বেশি। সেই রক্তমাংসের তরুণী প্রদীপের গালে আঁকে তার জীবনের প্রথম চুম্বন। অপ্রতিভ প্রদীপও তরুণীর গালে চুমো খায় আলগোছে। বুকে অনবরত ঢেউ ভাঙতে থাকে প্রদীপের। নতুন নতুন মুহূর্ত তৈরি হতে থাকে।
জীবন বদলে যায় প্রদীপের। সে ফোন করে শো রুমের মালিককে বলে, বিয়ে করছে। চাকরিটা তার দরকার। ততদিনে মালিকের রাগ কমেছে।
মুম্বইয়ের শো রুমে ঢুকে প্রদীপ স্তম্ভিত হয়। দেখে, শো উইন্ডোয় পরী নেই! সেখানে দাঁড় করানো শুধু পুরুষ ম্যানিকুইনটি। সহকর্মী বলে, পরীকে তাড়িয়ে দিয়েছে মালিক। অতঃপর প্রদীপের অন্তহীন খোঁজ শুরু হয় পরীর সন্ধানে। শো রুম থেকে শো রুমে, ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে, চোরবাজারে চলতে থাকে প্রদীপের অন্বেষণ। শেষমেশ শ্যুটিংয়ের সরঞ্জাম সরবরাহ করার গুদামের ঝিমঝিমে আলোয় পরীকে খুঁজে প্রায় প্রদীপ। তার মাথায় বাদামি চুলের গোছা। পরনে ঝপ্পরঝাঁই পোশাক।
সেই পুতুল পরীর সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ফেটে জল আসে প্রদীপের। পকেট থেকে রুমাল বার করে যত্নে মুছিয়ে দেয় ম্যানিকুইন পরীর মুখ। মলিন ব্যাকপ্যাক থেকে বার করে উজ্জ্বল হলুদ দোপাট্টা। পরীর উন্মুক্ত কাঁধ ঢেকে দেয়। তার পর স্মার্টফোনে হবু স্ত্রী-র ছবি দেখিয়ে বলে, ‘‘ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। তুমি সত্যিই পরী। তুমি আমার জীবনে এসে সবকিছু পাল্টে দিলে। তোমার মধ্যে সবচেয়ে ভাল কী জানো? তুমি অন্যের আনন্দের মধ্যে থেকে নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে পারো।’’ বেরিয়ে আসার আগে পুতুল পরীকে জড়িয়ে ধরে ধরাগলায় বলে, ‘‘আমার সব প্রলাপ শোনার জন্য, আমার সমস্ত একাকিত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য, আমায় পাগল হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ।’’
পরী তখনও চুপটি করে দেখে। তখনও চুপটি করে শোনে। চোখের পলক পড়ে না তার। কোনও কথা বলে না সে।
নেটফ্লিক্সে ‘আনকহি কহানিয়াঁ’ দেখতে দেখতে আশ্চর্য লাগছিল। ওয়েব মঞ্চের সাম্প্রতিকতম ‘অ্যান্থোলজি’-র প্রথমটিতে বঙ্গসন্তান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদীপের চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে জন্য নয়। রায়ান গসলিংয়ের ‘লার্স অ্যান্ড দ্য রিয়েল গার্ল’-এর সঙ্গে নাতিদীর্ঘ এই ছবিটির একটা ওপরসা মিল আছে। কিন্তু সে জন্যও নয়। প্রদীপের অনর্গল কথা আর পরীর চুপটি করে শোনা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, চারদিকে শোনার মানুষ বড় কমে গিয়েছে ইদানীং। সকলেই চিৎকার করে কিছু না কিছু বলতে চায়। শুনতে চায় না। অসহিষ্ণুতায় ভরপুর এই দুনিয়ায়, এই সমাজে ধৈর্যের মেয়াদ মেরেকেটে আড়াই সেকেন্ড!
পরামর্শ শুনতে চাই না। উপদেশ শুনতে চাই না। বিরোধীস্বর শুনতে চাই না। সমালোচনা শুনতে চাই না। ব্যাখ্যা শুনতে চাই না। শুধু একতরফা বলে যেতে চাই। বলতে চাই। শুধু বলতেই চাই।
মনে হচ্ছিল, চরিত্রের নাম ‘প্রদীপ’ হওয়া নেহাতই কাকতালীয়। এ আসলে এক আশ্চর্য প্রদীপের গল্প। যে প্রদীপের আলোয় তার তলায় থাকা আধুনিক জীবনের, চারপাশের সমাজের অন্ধকারটুকু ধরা পড়ল। ধরা পড়ল যে, আমাদের সকলের আসলে ধৈর্যশীল পুতুল দরকার। যে কথার মাঝখানে বাধা দেবে না। কথা কাটবে না। ধৈর্য ধরে শুনবে। প্রলাপ শুনবে। আলাপ শুনবে। বিলাপ শুনবে। নির্দ্বিধায় তাকে সব বলা যাবে। গ্লানি, দৈন্য, নিঃসঙ্গতা, সঙ্গলিপ্সা, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, রিরংসা— সব। সে শুনবে। চুপটি করে শুনবে। তড়িঘড়ি উল্টোদিকের মানুষটাকে বিচার করতে বসবে না। নিদান দেবে না। বরং তাকে বহন করবে নিজের নৈঃশব্দ্যে।
মানুষের ধৈর্য বড় কমে আসছে ইদানীং। ফুরিয়ে আসছে কান পেতে শোনার আয়ু। চিৎকৃত, উচ্চকিত পৃথিবীতে বড় দ্রুত সময় ঘনিয়ে আসছে সহিষ্ণুতার। তাই পুতুল দরকার। পুতুল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy