রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেন। ছবি: রয়টার্স।
যুদ্ধ কখনই কোনও সুসংবাদ নয়। সেই সঙ্গে যে দেশের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৮৫ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তার জন্য তেলের দামের বৃদ্ধিকেও সুখবর বলা চলে না কোনও মতেই। গত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ আমেরিকান ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখন যা ঘটে চলেছে, তাকে ‘তৈলসঙ্কট’ বলাই ভাল। সেই সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠেছে ‘গ্যাসসঙ্কট’-ও, যেখানে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ আমদানিকৃত। কয়লার বিষয়টিকেও এমতাবস্থায় মাথায় রাখতে হবে। কারণ, তেলের পাশাপাশি কয়লার ক্ষেত্রেও ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ।
গত নভেম্বর থেকে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়েনি। কিন্তু সে তুলনায় গত দু’মাসে অপরিশোধিত তেলের দামের ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। সুতরাং অনুমান করা যাচ্ছে যে, রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচনপর্ব মিটলেই মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে পণ্যের খুচরো মূল্যে একটি বড় রকমের উল্লম্ফন দেখা দেবে। রান্নার গ্যাসের দামও সমান তালে বাড়বে।
এই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুঝতে এবং পেট্রল পাম্প বা গ্যাসস্টেশনগুলিতে বিরক্তি রুখতে সরকারকে আবার কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকতে হবে। ২০১৪ সালে যখন তেলের দাম কমতে শুরু করে, তখন সরকার করের পরিমাণও কমিয়েছিল। কিন্তু এখন করের পুনর্বিবর্ধনের দিকেই তাকাতে হবে। এর ফল দাঁড়াবে কিছু পরিমাণ রাজস্বহানি। কিন্তু আগামী বছরের বাজেটে ইতিমধ্যেই কিছু স্বস্তির জায়গা রাখা হয়েছে, যাতে সরকার এই সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। বিগত বছরগুলিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ উঠে এসেছিল যে, তেলের দাম কমার কোনও সুফলই তাঁরা দেখতে পাননি। পণ্যের খুচরো মূল্য অপরিবর্তিত রাখার পরিকল্পনার যথার্থতা তাঁরা বুঝতে পারবেন এবং এ থেকে উদ্ভূত চাপ যে রাজকোষেই গিয়ে পড়বে, সে কথাও তাঁরা বুঝতে সমর্থ হবেন। স্বচ্ছল বছরগুলিতে দুঃসময়ের জন্য স্বস্তির ব্যবস্থা করে রাখার বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসার্হ।
এর পরেও বেশ কিছু বৃহত্তর প্রভাব থেকে যাচ্ছে। শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম অবশ্যম্ভাবী ভাবে বাড়বে, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাগুলির প্রয়োজনীয় জ্বালানির খরচ বাড়বে। প্রথমোক্তরা ঠিক কী ভাবে সমস্যাটি তাদের ভোক্তাদের উপর চাপাবে, তা নির্ভর করবে বাজারের গতিপ্রকৃতির উপর। অন্য দিকে, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাগুলি (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারগুলি দ্বারা পরিচালিত) পরম্পরাগত ভাবে ভর্তুকি দিয়ে সমস্যা সামলানোকেই সমস্যা সমাধানের পন্থা বলে মনে করে। আর প্রকৃতই এই মুহূর্তে ঘটে চলা নির্বাচনে বিনামূল্যে বিদ্যুতের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি বেশ লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু যে হেতু বিদ্যুৎ ইতিমধ্যেই গড়ে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রাপ্ত, সে হেতু শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে রাজস্ব বৃদ্ধি অনিবার্য বলেই মনে হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বাজেটের অন্তর্নিহিত বৃহৎ পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে, আগামী অর্থবর্ষে ৩ শতাংশের মতো পরিমাণে মুদ্রাস্ফীতির একটি ক্ষীণতর সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সুতরাং যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক শীঘ্রই মুদ্রাস্ফীতি কমবে ভেবে সুদের হার সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের বিষয়ে যে শৈথিল্য প্রদর্শন করে এসেছে, সে তার অবস্থান বদল করতেই পারে। বৃহত্তর অর্থনীতির সাপেক্ষে সুদের হারে সামান্য বৃদ্ধি অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোনও প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ঋণগ্রহীতা (মূলত সরকার) এবং ঋণদাতা, উভয়েই এ বিষয়ে ইঙ্গিত পেয়ে হিসেব-নিকেশ কষতে শুরু করবে। এ সমস্ত কিছুর প্রভাবে বাজেটের এক মাস আগে যে পরিস্থিতি বহাল ছিল, তার তুলনায় যে খানিক অস্বস্তিকর দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
গুরুত্বপুর্ণ বিষয় এই যে, অর্থনীতি কিন্তু তেমন ‘ক্ষণভঙ্গুর’ অবস্থায় নেই। ২০১২-’১৩ সালে যখন এই বিশেষ অভিধাটি ভারত-সহ অন্যান্য কিছু দেশের অর্থনীতির উপর প্রুযুক্ত হয়েছিল, সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, বাণিজ্য-ঘাটতি এবং বৈদেশিক বিনিময়ের তহবিলের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে আজকের পরিস্থিতি অনেকখানি সহনীয় এবং স্বস্তিদায়ক।
এমন পরিস্থিতি থেকে কী অনুমিত হয়? ভোক্তারা তাঁদের খোপ থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘ সময় নেবেন এবং বৃদ্ধির হার হবে মধ্যম মানের। সেই সঙ্গে অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আরও বেশি সময় লাগবে। কিন্তু এ-ও মানতে হবে যে, অতীতের সঙ্গে তুলনা করতে বসলে দুর্ভাবনার মাত্রাটি অনেকখানি কম বলেই এই মুহূর্তে মনে হয়। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে খনিজ তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ব্যারেল প্রতি ১০০ আমেরিকান ডলার, যা ২০১৩-’১৪ সালে ছিল সেই ১০০ ডলারই। ফলে সেই সময়ের নিরিখে দেখলে তেলের দাম যে বিপুল মাত্রায় বেড়েছে, এমনও নয়।
এখন প্রশ্ন হল, তেলের দাম কত দিন এমন উচ্চতায় অবস্থান করবে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কড়া বার্তা (চোখ কুঁচকে এবং দাঁতে দাঁত চেপে, আক্ষরিক অর্থেই) সত্ত্বেও পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলি রাশিয়াকে ছাড় দিয়ে শক্তিক্ষেত্রের সমস্যাগুলি এড়িয়ে গিয়েছে। এখান থেকে ইউরোপ তার প্রয়োজনীয় খনিজ তেলের এক-চতুর্থাংশ এবং রাশিয়া থেকে তার প্রয়োজনীয় গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ পাচ্ছে। এই ছবি অতলান্তিকের দুই তীরেই সত্য। এবং এই সব দেশের সরকার এই ছাড়ের পরে শক্তি সঙ্কটের মতো উল্টো আবর্তে পড়তে আদপেও রাজি নয়। এই প্রক্রিয়ার ফল হিসেবেই রশিয়া উচ্চমূল্যে শক্তি রফতানির সুবিধা ভোগ করতে পারছে, যেখানে ভারতের মতো শক্তি আমদানিকারক দেশগুলির তরফে নিজেদের বেঁধে রাখা ছাড়া আর কিছু করার থাকছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy