এ বার লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশিত ইস্তাহারে পরিবেশ একেবারে উপেক্ষিত হয়নি। তবে প্রাধান্য পেয়েছে অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, দূষণ নিয়ন্ত্রণের নানা নীতির প্রতি সমর্থন। পরিবেশ ও জীবিকার জন্য হানিকারক যে বিষয়গুলি মানুষের চোখের সামনে রয়েছে, সেগুলি নিয়ে তেমন কথা নেই। খোলামুখ কয়লা খাদান, বায়ু দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, দাবানলের আশঙ্কা, হিমালয় নীতি, গঙ্গার দূষণমুক্তির জন্য আইন (‘গঙ্গা আইন’ নামে যা সংসদে ঝুলে আছে), ছোট নদীগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা, জলে আর্সেনিক দূষণ, স্বচ্ছ পানীয় জল— এই ধরনের বিষয়গুলো নির্বাচনী চর্চার বিষয় হয়ে ওঠা দরকার ছিল। কিছু পরিবেশ সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া রাজনৈতিক দলের কাছে জানিয়েছে, কিন্তু দলগুলির প্রচারে সে সবের প্রভাব পড়েনি। কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে— যাদবপুর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীর ইস্তাহারে এলাকা-ভিত্তিক ‘ক্লাইমেট মডেল’ তৈরি হবে বলে আশ্বাস ছিল। যদিও পরিবেশ-কর্মীদের আশঙ্কা, মডেল তৈরি হলেও কলকাতায় তার প্রয়োগ হবে না।
অথচ, সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে। যেমন, চাষের জলের আকাল। প্রখর গ্রীষ্মে নদী-নালা, খাল-বিল, জলাভূমি শুকিয়েছে। নদীর জলস্তরও নেমে গিয়েছে, ‘রিভার লিফটিং পাম্প’ অধিকাংশই অকেজো। এ ছবি উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, সর্বত্র। ভরসা কেবল ভূগর্ভের জল, কিন্তু তা-ও ফুরোচ্ছে। ‘ন্যাশনাল কমপাইলেশন অন ডাইনামিক গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস অব ইন্ডিয়া, ২০২৩’ রিপোর্ট বলছে, রাজ্যের ভূগর্ভের জল-ভান্ডার সঙ্কটে।
কী ভাবে সুজলা বাংলা তার জলসম্পদ হারাচ্ছে, তার উদাহরণ নদিয়া জেলা। এখানে ভাগীরথী, জলঙ্গী, চূর্ণী, মাথাভাঙা, ইছামতীর মতো বড় নদী তো ছিলই। পাশাপাশি কলিঙ্গ, পলদা, পাগলাচণ্ডী, কুজলা, কুমারী প্রভৃতি ছোট-বড় অনেক নদী ছিল। আজ অন্তত তেত্রিশটি নদী হারিয়ে গিয়েছে। কেবল কৃষ্ণনগর পুরসভা এলাকায় সত্তরটি পুকুর ছিল, আজ বড়জোর পঁচিশটি খুঁজে পাওয়া যাবে। এই নদী, পুকুর, জলাভূমিই বৃষ্টির জলকে ধরে ভূগর্ভের জল-ভান্ডার সমৃদ্ধ করত। এখন মাটির তলা থেকে যে পরিমাণ জল তুলে নেওয়া হচ্ছে, বৃষ্টির জল সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। এ কথা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একাধিক রিপোর্টে সামনে এসেছে, তবু নদিয়ার পুরসভাগুলি উদাসীন।
বৃষ্টির জলের সংরক্ষণ নিয়েও একই উদাসীনতা। কোভিডের আগে পর্যন্ত কৃষ্ণনগর পুরসভা যে সব বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করেছে, সেখানে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। কোভিডের পরে গঠিত নতুন পুরসভা বিল্ডিং প্ল্যানে সেই ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক করেছে। কিন্তু সেই সব প্ল্যান অনুসারে নির্মিত বাড়িগুলিতে বাস্তবিক বৃষ্টির জল ধরার ব্যবস্থা আছে কি না, তা পরীক্ষা করে না দেখেই ‘অকুপেন্সি সার্টিফিকেট’ দিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় পরিবেশ-কর্মীদের পর্যবেক্ষণ, শহরে নব-নির্মিত আবাসনগুলির কোনওটিতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাঁরা জানাচ্ছেন, কৃষ্ণনগর, বীরনগর ও রানাঘাট, এই তিনটে পুরসভা মিলিয়ে বড়জোর দশ-বারোটা বাড়ি, ও কয়েকটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এই সব বাড়ির বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগেই ওই ব্যবস্থা করেছেন, প্রশাসনিক সহায়তা পাননি।
এই তিনটি পুর এলাকাতেই গরমে জলের সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। গরমে জলের চাহিদা বাড়ে, অথচ পুরসভার সরবরাহ করা জলের পরিমাণও কমে যায়। এমনকি দিনের নির্দিষ্ট সময়ে জলের জোগানও মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। ঘাটতি পূরণ করতে প্রায় প্রতিটা বাড়িতে মাটির নীচের জল তোলার জন্য পাম্প বসানো রয়েছে।
অথচ, খুব কম খরচে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের নানা কৌশলের কথা পুরো দেশ তথা বাংলার সামনে ছিল। যেমন, ‘ওয়াটার লেডি অব ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত আইএএস শান্তা শ্রীলা নায়ারের ‘চেন্নাই মডেল’। যেখানে তিনি একশো টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করে বৃষ্টির জল ধরে রাখার নানা মডেলের কথা সাধারণ মানুষের সামনে রেখেছিলেন। তার বাস্তবায়নও তিনি করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের পুরসভাগুলোর এই ধরনের কাজ করার ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে না।
গঙ্গার আশেপাশের পুরসভাগুলোতে গঙ্গা থেকে জল তুলে সরবরাহ করা হয়। সেখানে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, উলুবেড়িয়া পুরসভার দিকে তাকালেই তা বোঝা যাবে। গ্রীষ্মে নদীর জল কমে যাওয়ার ফলে জোয়ারের সময়ে নদীর জল নোনতা হয়ে যায়। এমনকি ওই সব এলাকায় গরম কালে মাটির তলার জলও ক্রমশ নোনতা হয়ে যাচ্ছে। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের উপায় হতে পারত বৃষ্টির জল সংরক্ষণ। সেই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি উলুবেড়িয়া পুরসভা।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উপকূল থেকে ক্রমশ উপরের দিকে নদীর জল ও ভৌমজলে নুনের পরিমাণ বাড়ছে। গঙ্গা অববাহিকার উপরের দিকের রাজ্যগুলো গঙ্গা থেকে প্রচুর জল তুলে নিচ্ছে। এমন নানা কারণেই বিপন্ন গঙ্গা। ছোট নদী ও জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ভাবে মাটির তলার জলের ভান্ডার পূরণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির জল ধরার ব্যবস্থা করা, ভূগর্ভের জলের ব্যবহারের উপর লাগাম টানা, জলাভূমিগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা, জল অপচয় বন্ধ করা, এগুলিই আজ বাঁচার উপায়। কিন্তু যাদের উপর এই বিশাল কাজ পরিচালনার দায়িত্ব, সেই রাজনৈতিক দলগুলি কতটা আগ্রহী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy