বাস থেকে নেমে, রাস্তা পেরোনোর আগেই দেখা গেল ছোট ছোট জটলা। এ জটলা ব্যাঙ্কবাবুদের চেনা। উত্তর কলকাতার জমজমাট এলাকায় দোতলায় ব্যাঙ্ক, একতলায় একটু ঢুকে সিঁড়িতে উঠতে হয়। বাইরের জটলার পাশ কাটিয়ে, হিন্দি আর বাংলায় মেশানো সম্মিলিত নমস্কারের ঝঙ্কার শুনতে শুনতে ভিতরে পা রাখা। নাকে আসে মৃদু ধেনো মদের গন্ধও— ঢোকার রাস্তাটুকু শুধু ছেড়ে দিয়ে, স্ত্রী-পুরুষের যে লাইনখানা সিঁড়ির শেষে ব্যাঙ্কের গেট পর্যন্ত বয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে।
কর্পোরেশনের, মূলত সাফাইকর্মীদের, পুজো-বোনাস দেওয়ার দিন বলে কথা। তাই দশটায় ব্যাঙ্ক খুললেও আটটা থেকেই লাইন পড়ে। স্পেশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা ‘বড়বাবু’ নিজের টেবিলে বসে প্রথমেই কম্পিউটার চালু করেন, তার পর ড্রয়ার থেকে দুটো স্ট্যাম্প প্যাড, কালির বোতল আর অনেকটা লাল কাপড় রাখেন সামনে। ও-দিকে দুই ক্যাশিয়ার এবং এক অফিসার খাঁচার ভিতরে প্রস্তুত।
ম্যানেজার তাঁর চেম্বারের দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “সব রেডি তো?” চারিদিক থেকে আওয়াজ, “হ্যাঁ, দাদা।” সরকারি ব্যাঙ্কে ‘স্যর’ বলার চল তখনও কম। দূরের দেওয়ালে ঘড়ি দেখে বড়বাবু হাঁক পাড়েন, “সিকিয়োরিটি, প্রথম বিশ জন।” গেট খুলে যায়, হালকা চেঁচামেচির শব্দ ঘোরাফেরা করে ব্যাঙ্কের মধ্যে। এক-এক করে কুড়ি জন লাইন করে চলে আসে বড়বাবুর সামনে। সাধারণ গ্রাহক দু’-তিন জন দেখেশুনে অন্য কাউন্টারে চলে গেলেন, এমন দিনে তাঁরা কম আসেন।
এ বার বড়বাবুর টেবিলে কাজ শুরু। ছবি মিলিয়ে, অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স দেখে, প্রয়োজনে স্লিপ লিখে দিয়ে কাউন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া। দশ জন টাকা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলে কানে আসে, “এ বার দশ জন!” তার আগেই হঠাৎ একপ্রস্ত হইচই: “মহাজন ঢুকে পড়েছে!” অন্য গ্রাহকদের সঙ্গে ঢুকে পড়া মহাজন চিহ্নিত হয়ে যায় সহজেই। “আপনি তো কাস্টমার নন, ঢুকেছেন কেন?” বড়বাবু ধমক দেন। আসলে এরা বাইরের জটলার লোক, গরিব মানুষদের টাকা ধার দেয়। এই দিনে আদায় করতে চলে আসে। টাকা হাতে পাওয়ার পরে ফাঁক গলে দু’-এক জন দেনাদার পালিয়ে যায় কিনা, তাই তাদের ‘পাকড়াও করতে’ দু’-এক জন পাওনাদার মহাজন ব্যাঙ্কের ভিতরে ঢুকে পড়ে।
অন্য ‘ঝামেলা’ও আছে। এক সাফাইকর্মীর দুই বৌ, তারা এ সব দিনে চলে আসে টাকা ‘ছিনতাই’ করতে। এক বার মহা ফ্যাসাদ, দু’টি মেয়ের প্রায় হাতাহাতির উপক্রম, ফাঁকতালে ‘দোষী’ অর্থাৎ স্বামীটির পলায়ন। নিরাপত্তাকর্মী মেয়ে দু’টিকে নিয়ে হাজির ম্যানেজারের চেম্বারের কাছে, তিনিই বা কী করবেন! সত্যিই আমরা এঁদের জন্য কতটুকু করতে পারি? গ্রামের ব্যাঙ্কে যে সব ধানের কারবারি পুজোর আগে টাকা তুলতে ব্যাঙ্কে আসেন, মহাজনরা তাঁদের জন্যও ব্যাঙ্কের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।
আর যাঁরা অন্যের ধান জমিতে জন খাটেন, বাকি দিনগুলোয় টুকটাক কাজ করেন, তাঁদের পুজো-মরসুমের গল্পগাছাও ঘোরাফেরা করে ব্যাঙ্ককর্মীদের আড্ডায়। বছর বাইশ আগে মুর্শিদাবাদের এক গ্রামীণ শাখায় কাজ করতেন এক ব্যাঙ্কবাবু। দেখলেন কাউন্টারের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে চেনা এক বয়স্ক ঢাকি, সঙ্গে তরুণ ছেলে। এমনিতে জীবিকা সারা বছর পরের জমিতে জন খাটা, আর দুর্গাপুজোয় কলকাতায় সপুত্র ঢাক বাজাতে যান। ত্রয়োদশীর সকালে ফিরে বাড়ির লোকজনদের পুজোর কাপড় কিনে দেন। ব্যাঙ্কে রাখা যৎসামান্য টাকা তুলতে আসেন কলকাতা যাওয়ার আগে।
সেই ব্যাঙ্কবাবুই বদলি হয়ে কলকাতার এক শাখায় একটু বড় দায়িত্বে এসেছেন। বছর দুই আগে ব্যাঙ্কে তাঁর চেম্বারের বাইরে হঠাৎ দুই চেনামুখকে দেখে বললেন, আপনারা কি মুর্শিদাবাদের...? বড়জন বললেন, “হ্যাঁ স্যর, আপনাকে আমি চিনেছি। সে দিন বাবা আর আমি ছিলাম, আজ আমি আর আমার ছেলে। এখন তো ব্যাঙ্কে অনেক সুবিধা হয়ে গেছে, এখানে জমা দিলাম, ওখানে চলে গেল!” আর পুজোর জামাকাপড়? “সেই বাড়ি ফিরে কেনা। আজ রাতে রওনা হচ্ছি, পরশু ত্রয়োদশীর দিন ওই ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুলব। তার পর সবার জন্য শাড়ি-জামা কেনা। আমরা তো দুগ্গাপুজোয় নতুন পরতে পারি না, লক্ষ্মীপুজোয় নতুন কাপড় পরে প্যান্ডেলে যাব। লক্ষ্মীপুজোয় তো ঢাক বাজে না।”
শেষপাতে বছর সতেরো আগের এক ‘গল্প হলেও সত্যি’। বাংলাদেশ সীমান্ত মিনিট দশেকের গাড়ি-দূরত্ব, এমন এক জায়গার ব্যাঙ্ক-ম্যানেজারের জীবনের। ষষ্ঠীর দিন বিকেলে ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়ে স্টেশনে যাওয়ার বাসের অপেক্ষা, হঠাৎ কোত্থেকে এসে এক আনাজ-বিক্রেতা এক ব্যাগ-ভর্তি আনাজ হাতে ধরিয়ে বললেন, “এগুলো নে যান। যা হোক কিছু দ্যান।” অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকাতে জানালেন, শুধু এইটুকুই রয়েছে। দেখালেন, মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদূরে, ওর ফ্রক কিনতে যেতে হবে, পুজোর দিন তো। “ঠিক আছে, দাম বলুন।” উনি যা বললেন সেটুকু দিয়ে দিতেই— বাচ্চা মেয়েটির মুখে শরতের রোদ্দুর, শান্ত চোখ নির্মল আনন্দে ঝলমল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy