আন্দামানে সেলুলার জেলের বোর্ডে বিপ্লবী বন্দিদের তালিকায় সর্বাধিক নাম বাঙালির। ৬০৮ জন। এর পরেই পঞ্জাবিরা। ৯৫ জন। তার পর অন্যান্য রাজ্য। ব্রিটিশ জেলারের উদ্ভাবিত নারকীয় অত্যাচারের স্মারকের সামনে বাঙালিরা হাসিমুখে নিজস্বীতে ব্যস্ত। সেলে ‘মিছিমিছি’ বন্দি হয়ে ছবি তুলছেন সমাজমাধ্যমের জন্য। বেদনা হচ্ছিল। বিপ্লবীদের বলিদান ব্যর্থ? তরুণ অরুণদের অস্তাচলের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার উদ্যাপন কি মেগা অফারে, ফুড কোর্টেই সীমাবদ্ধ? কই, সেই স্পন্দন?
আমার শহর, আমার রাজ্য দেখিয়ে দিল, সে এখনও প্রাণে স্পন্দমান, প্রতিবাদে মুখর। যাঁদের কেবল ওটিটি-র গৃহসুখে তৃপ্ত মনে হত, তরুণ প্রজন্ম, যাঁরা নাকি ইতিহাস জানে না, আত্মকেন্দ্রিক, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নেমেছেন। যাঁরা ভিডিয়ো চ্যাট আর সিরিজ় দেখতে রাত জাগতেন, তাঁরা রাস্তায় রাত জাগছেন আপসহীন প্রতিবাদে। ‘জাস্টিস’ কবে আসবে জানা নেই, কিন্তু কোথাও যেন ‘ফুরিয়ে আসা’ বাঙালিত্বে নতুন জোয়ার এসেছে।
তবে প্রতিবাদ যত তীব্র হচ্ছে, সমাজমাধ্যমে এবং সংবাদমাধ্যমগুলির বিতর্কসভা গরম করতে আসা নেতা-নেত্রীদের আকথা-কুকথা যেন তত বাড়ছে! কুবাক্যের গরলে আমাদের মেয়েটি নতুন করে নিগৃহীতা হচ্ছেন। যেমন দেখেছি তপন সিংহের আদালত ও একটি মেয়েতে, কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন-এ (কাহিনি: সুচিত্রা ভট্টাচার্য) ।
মিছিল, রাত দখল, দ্রোহ আর জাগরণের মাঝে কাদাখোঁচার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিছু মানুষ, যাঁদের বাক্যে সংবেদন ও সংযমের অভাব পীড়াদায়ক। কানে খট করে লাগছে একটি শব্দ। ‘যুবতী’ চিকিৎসক। অনেকেরই সন্দেহ, এক ‘যুবতী’কে কারও একার পক্ষে এতখানি আহত ও বিধবস্ত করা সম্ভব কি না। ‘যুবতী’ চিকিৎসকটি খামোকা ওখানে ঘুমোতে গেলেন কেন, মাথা ঘামাচ্ছেন অনেকেই।
তাঁদের ক্ষোভ, সন্দেহ নিয়ে আলোচনায় যাব না, কিন্তু ‘যুবতী’ শব্দটি গোল বাধাচ্ছে। নারীর প্রতি হিংসা যে কত গভীরে প্রোথিত, বোঝা যায় শব্দটির ব্যবহারে। ‘নারী’ শব্দের অর্থ যে পুষ্টিদান করে, নিঃশর্ত অনুগামিতায় পুরুষকে পুষ্টিদান। স্ত্রী, কান্তা, রমণী, বরারোহা ইত্যাদি প্রতিশব্দের মধ্যেও নারীকে সহিংস ভাবেই ভোগ্যবস্তু রূপে চিহ্নিত করা। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বরুণপ্রঘাস যজ্ঞে প্রকাশ্যে জনবহুল যজ্ঞসভায় পুরোহিত যজমান-পত্নীকে প্রশ্ন করছেন, ‘কেন সহ চরসি’ অর্থাৎ স্বামী ছাড়া আর কার সঙ্গে বসবাস করেছ? যজমানকে কিন্তু কোনও প্রশ্ন করা হয় না।
‘যুবতী’ শব্দটিও নারীর শরীরকেই অবজেক্টিফাই করে, ইঙ্গিত করে রূপ-যৌবনের দিকেই। যত বার শব্দটি উচ্চারিত হয়, তত বার নতুন করে অসম্মানিত হন সেই মেধাবিনী, যিনি মেধা, পরিশ্রমের জোরে চিকিৎসক হয়েছিলেন। যেখানে পাত্র-পাত্রীর কলামগুলিকেও নতুন ভাবে লেখার কথা চলছে, সেখানে এক পেশাদার মানুষ সম্পর্কে ‘যুবতী’ শব্দটি অত্যন্ত আপত্তিকর। আমরা কি এখনও এতটা সভ্য হলাম না যে বলতে শিখব ঘটনাটি ঘটেছে এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সঙ্গে?
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ জানাচ্ছেন যুবতী (যুবন+ স্ত্রী তি)-র একটি অর্থ ‘যে আপনাকে পতির সঙ্গে মিশ্রিত করে’। সাহিত্যে উদাহরণ দিয়েছেন চণ্ডীদাসের থেকে— যুবতী ধরম। কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এ দুষ্মন্ত বলেছেন, শকুন্তলার অধর কিশলয়ের মতো রক্তিম। গাছের শাখার মতো কোমল বাহু। অঙ্গে ঝলমল করছে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো লোভনীয় যৌবন।
অতএব, যুবতী বললেই তার অনুষঙ্গে লোভনীয় যৌবনের ভাবনা এসে পড়ে না কি? সেখানে কী ভাবে চিকিৎসক সম্পর্কে বলা যায় যুবতী? কোনও পেশা সম্পর্কেই বলা যায় কি? যুবতী উকিল? যুবতী লেখক বা শিক্ষক?
কালিদাস, চণ্ডীদাসের অনেক পরে চোখের বালি-তে বিনোদিনী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— “...যখন তাহার জোড়া ভুরু ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ...নিখুঁত মুখ ও নিটোল যৌবন লইয়া উপস্থিত হইল”— বাক্যটিতে ইঙ্গিত, বিনোদিনীর যৌবন স্থিতাবস্থাকে টলিয়ে দিতে চলেছে। কিংবা চতুরঙ্গ-এর দামিনী। “বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ; অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিক্মিক্ করিয়া উঠিতেছে।” বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ উপন্যাসে জ্যোতির্ময়ী দেবী লিখেছিলেন, “মেয়েদের পরিচয়— হয় শুধু সম্পর্কেরই ইতিহাস, নয় পরিচয়হীন সম্পর্কহীন রূপবহ্নিবিলাসে পোড়ানো ও পুড়ে যাওয়ার কাহিনী, এ ছাড়া আর কোনো পরিচয়— মানুষের পরিচয় পৃথিবীর ইতিহাসে স্পষ্ট করে পাওয়া যায় না। চিরকালই তারা হয় সতী সীতা সাবিত্রী, নয়, ঊর্বশী বসন্তসেনা ক্লিয়োপেট্রার দলে। কিন্তু এই যুগে কোনো কোনো জায়গায় সে যুগ শেষ হয়ে গেছে।”
নতুন যুগের মেয়েদের সম্বোধন যে নতুন হবে, সমাজকে বুঝতে হবে। সুবিচারের জন্য মিছিলে হাঁটার পাশাপাশি যুবতী, মেয়েছেলে, মেয়েমানুষ, মাল, চিজ, জিনিস— এই সব শব্দ-আবর্জনাও পরিষ্কার করা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy