ঐতিহাসিক: ৭৫ বছর আগে ভারতীয় সংবিধান সূচনার মুহূর্তে স্বাক্ষর করছেন সংবিধান-সভার সদস্যরা, জানুয়ারি ১৯৫০। —ফাইল চিত্র।
১৯৪৭ সালে যখন দক্ষিণ এশিয়া ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হল, তখন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে হারিয়ে গেল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাসূত্র। তার মধ্যে প্রধানতমটি হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের গুরুত্বের চিন্তাটি। আজ যখন ক্ষমতার শীর্ষস্তরে গণতান্ত্রিক ও একাধিপত্যকামী শক্তির মধ্যে এক জটিল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তখন সেই হারিয়ে যাওয়া চিন্তাসূত্রটি ফের তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
১৯২১ সালের ২ মার্চ সুভাষচন্দ্র বসু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে একটি চিঠিতে লেখেন, “স্বরাজের ভিত্তির উপর আমাদের এখন ভারতের কনস্টিটিউশন তৈয়ারি করিতে হইবে।” তখন ইয়ং ইন্ডিয়া-য় গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের অনৈতিকতা বিশ্লেষণ করে এবং ভারতের ধর্মীয় ও ভাষাগত বহুত্বের কথা মাথায় রেখে নতুন জাতিকল্পনা বিষয়ে লিখছেন। ১৯২০ সালে গান্ধী কংগ্রেসের নতুন সংবিধান রচনা করলেন। প্রাদেশিক কংগ্রেস সংগঠনগুলির ভিত্তি মজবুত করতে গান্ধী রচনা করলেন ‘ভাষা নীতি’; জানালেন, দেশ স্বাধীন হলে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠিত হবে।
১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫-এর সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে ভারতে অতি সঙ্কীর্ণ ভোটাধিকারে যে সীমিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ব্যবস্থা হয়েছিল, তা ছিল ঔপনিবেশিক শাসন জিইয়ে রাখার কৌশলটি। স্বদেশি আন্দোলনের সময় তার প্রতিস্পর্ধী অবস্থান হিসাবে গড়ে উঠেছিল উপনিবেশ-বিরোধী সাংবিধানিকতার ধারা। ‘শাসনতন্ত্র’র বিপ্রতীপে ‘সংবিধান’ শব্দটি এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্বদেশী সমাজ’-এ। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে স্বরাজপন্থীরা এই যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের নীল নকশা পেশ করেন; তার সঙ্গে তাঁরা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতার সাম্যভিত্তিক বণ্টনের কথাও বলেন। বলেন, স্বাধীন ভারতে ‘কেন্দ্রীয় সরকার’-এর ‘স্বাভাবিক ভূমিকা’ হবে ‘মূলত পরামর্শদাতা’র। বলা হয়েছিল, ‘সর্বোচ্চ স্থানীয় স্বশাসন থাকবে, উচ্চতর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ও সমন্বয়সাধনের সাহায্যে কাজ হবে, কিন্তু কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হবে ন্যূনতম’। সে সময় এমন একাধিক সংবিধান রচিত হয়েছিল।
পূর্ণ স্বরাজ-এর শপথ নেওয়ার পর ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারতে ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন অনুসারে ভবিষ্যতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপরে স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক প্রতিনিধিদের চাপিয়ে দেওয়া নীতির বিরোধিতা করে কংগ্রেস। ১৯৩৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুভাষচন্দ্র লেখেন, “আমাদের মতে, একমাত্র ক্ষমতা দখলের পরই প্রকৃতার্থে কোনও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
শেষ অবধি স্বাধীনতা যখন সমাগতপ্রায়, তখন অতি সঙ্কীর্ণ ভোটাধিকার-ভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক আইনসভা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে গঠিত হয় দেশের সংবিধানসভা; ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর দেশের সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গৃহীত হয় অনেকগুলি নীতি সম্বলিত এক দীর্ঘ নথি। সেই সংবিধানে যে প্রজাতন্ত্রের কল্পনা করা হয়, আনুষ্ঠানিক ভাবে তার সূচনা হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। সংবিধানের সবচেয়ে সাহসী এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ নীতিটি ছিল সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রদান— এমন সময়ে, যখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১২ শতাংশের কাছাকাছি। এ ছাড়াও ছিল তফসিলি জাতি ও জনজাতিগুলির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
অন্য দিকে, সংবিধানসভার বড় অংশ জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতার সীমা, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নের যথোপযুক্ত নীতি নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আম্বেডকর বলেছিলেন যে, ভারতীয় সংবিধান আমেরিকান সংবিধানের মতো নিখাদ যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ছাঁচে ঢালা নয়। প্রশ্ন হল, সংবিধানের মধ্যেই যদি যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্রকে লঙ্ঘন করার পথ নিহিত থাকে, তাতে কী ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে, তা কি কেউ বোঝেননি? কয়েক জন— বিশেষত মহাত্মা ও নেতাজির কিছু সমর্থক— বুঝেছিলেন। কিন্তু, সংবিধানে তাঁরা যে সংশোধনীগুলি পেশ করতে চেয়েছিলেন, সেগুলি ভোটে হেরে যায়। কে টি শাহ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১-এ সংশোধনী আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল বলা হোক যে, “ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র হবে।” প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। তিনি আরও চেয়েছিলেন যে, কোনও রাজ্যের বিধানসভার স্পষ্ট অনুমোদন ব্যতিরেকে সে রাজ্যের নাম বা ভৌগোলিক সীমানা পরিবর্তনের এক্তিয়ার যেন কেন্দ্রীয় সরকারের না থাকে। নেতাজির আর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী হরি বিষ্ণু কামাথ জরুরি অবস্থার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করে দিয়েছিলেন। আম্বেডকর স্বীকার করেন যে, এই ব্যবস্থাটির অপব্যবহার হতে পারে। “আমরা আশা করি যে, এই অনুচ্ছেদগুলি কোনও দিনই ব্যবহৃত হবে না, এবং তা নেহাতই মৃত শব্দরাজি হিসাবে থেকে যাবে।” কয়েক দশকের মধ্যেই এই উচ্চাশা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।
সংবিধান সম্বন্ধে অনেকের আপত্তিই গৃহীত হয়নি। তবে আম্বেডকর তাঁদের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আমি তাঁদের পরামর্শ গ্রহণে সম্মত হইনি, তাতে তাঁদের পরামর্শের গুরুত্ব হ্রাস পায় না...।” এই ‘বিদ্রোহী’রা নিজেদের হতাশার কথা জানাতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। কে টি শাহ বলেন, “যে সংবিধানটি রচিত হল, তাতে প্রকৃত, কার্যকর গণতন্ত্রের পরিবর্তে ফ্যাসিবাদের বিকাশের পরিসর তৈরি হয়েছে”— কারণ, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ‘প্রকৃত একনায়ক’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে, এবং মন্ত্রিসভা ও সংসদ ‘সেই একনায়কের রেজিস্ট্রি অফিস বই আর কিছুই নয়’। গান্ধীবাদী শিব্বন লাল সাক্সেনা বলেন, “আমি কখনও ভাবতেই পারিনি যে, স্বাধীন ভারতের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অধীনে তাঁকে বিনা বিচারে আটক করার ব্যবস্থাও থাকবে।” কামাথ সংবিধান সম্পর্কে বলেন যে, সেটি সংসদীয় গণতন্ত্রের মুখোশধারী কেন্দ্রীভূত যুক্তরাষ্ট্রীয়তা মাত্র।
ব্রিটিশ রাজের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার উত্তরাধিকার গ্রহণ করতে উদ্গ্রীব কংগ্রেস দেশভাগের পথে হাঁটল। দেশভাগকে কেন্দ্র করে হিংস্রতার যে স্রোত বইল, তাতে আরও জোরদার হল শক্তিশালী কেন্দ্রের দাবি; সংবিধানে জরুরি অবস্থার ব্যবস্থা রাখাও বৈধ হল। দেশভাগের ফলে সংবিধানসভায় যুক্তরাষ্ট্র-পন্থী সদস্যের সংখ্যা হ্রাস পেল। মাত্র কয়েক জন অবশিষ্ট রইলেন, যাঁরা অধিকতর গণতন্ত্র ও প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন।
শরৎচন্দ্র বসু ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে লিখলেন, “ভারতীয় সংবিধানের অষ্টাদশ পর্বে রাষ্ট্রপতির হাতে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত যে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৪২, ৪৩ ও ৪৫ ধারার আশ্চর্য মিল রয়েছে।” জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতাকে তিনি তুলনা করেন ‘টাইম বোমা’-র সঙ্গে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন যে, এতে আইনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়নি, পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে মাত্র। ১৯৭৫ সালে এই ফাঁক গলেই ভারতে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিলম্বিত হয়। জরুরি অবস্থার সময় ‘হেবিয়াস কর্পাস’-এর নীতি নিলম্বিত করার সিদ্ধান্তকে এই কারণেই ‘সাংবিধানিক’ আখ্যা দেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের চার সদস্য। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রারম্ভিক মুহূর্ত বিষয়ে যে অগভীর, প্রশ্নহীন আলোচনা আজ শোনা যায়, তার পিছনে হয় এই ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞানতা রয়েছে, অথবা আছে ইচ্ছাকৃত ভাবে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। কে টি শাহ লিখেছিলেন, “আমাদের সংবিধান যদিও বাক্স্বাধীনতাকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করার কথা বলে, কিন্তু তার উপরে এত রকম সীমাবদ্ধতা ও বাধানিষেধ আরোপিত হয়েছে যে, সেই ব্যতিক্রমের চাপে প্রকৃত স্বাধীনতার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।”
সংবিধানের প্রস্তাবনার কথাগুলি জরুরি, অনুপ্রেরণাদায়ী। কিন্তু, সেই সংবিধানেই ঔপনিবেশিক শাসনের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য গৃহীত হয়েছিল যে, তার সঙ্গে প্রস্তাবনায় বর্ণিত আদর্শের সঙ্গতি পাওয়া দুষ্কর। যে আদর্শবাদী ছাত্ররা পথে নেমে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, এই সংবিধানের আইন ব্যবহার করেই কিন্তু তাঁদের বিনা বিচারে কারাবন্দি করে রাখা সম্ভব, ঔপনিবেশিক স্বৈরতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যে ভরা দানবীয় প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন আইন অনুযায়ী।
২০৫০ সালের ভারত কী ধরনের সংবিধান অনুসারে শাসিত হবে, তা স্থির করার অধিকার আজকের তরুণ প্রজন্মের আছে। সেটা তাঁদের দায়িত্বও বটে। দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণ যুদ্ধে যা-ই হোক না কেন, প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগে আমরা বৃহৎ চিন্তার যুদ্ধে জয়ী হতে পারি, এমন একটি গণতন্ত্র গড়ে তুলতে পারি, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করবে, আবার গণতন্ত্রের মুখোশ পরা স্বৈরব্যবস্থাকে দূরও করবে। প্রস্তাবনায় যে ভারতকল্পনা— তার অনুসরণে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে মজবুত করবে। একশো বছরেরও বেশি আগে সুভাষচন্দ্র স্বরাজের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার কথা বলেছিলেন। চেয়েছিলেন, পূর্ণ স্বরাজের আগে যেন আসে পূর্ণ সাম্যবাদ।
গার্ডিনার প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy