Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
জনস্বাস্থ্য বনাম লোকস্বাস্থ্য
Asha Workers

বেগুনি শাড়ি পরা আশাদিদির হাত ধরে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেঁচে থাকুক

হারিকেন ছেড়ে নিয়ন, ভেপার, বিজলির আলোয় চকচক করা জনস্বাস্থ্যের এই যে দেহ, তা লোকজীবনের কতটা কাছে?

অভিজিৎ চৌধুরী
অভিজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৫৭
Share: Save:

এক একটা খবর মাঝেমধ্যেই আমাদের ভাবনার ঘোমটা ধরে টান মারে। ছবি বলে ফেলে অনেক না বলতে পারা কথা। মেঘলা আকাশ, পায়ের নীচে করোনার কাদামাটি, অসুখ নিয়ে ডুবতে-ভাসতে থাকা প্রায় দু’বছরের জীবনে নতুন সুর জাগে, যখন চোখের সামনে চলতে থাকা ছায়াপট দৃশ্য নিয়ে আসে। দিগ্বিদিক কাঁপানো ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন, রেমডেসিভির, মলিকিউলার টেস্টের ‘ফিল হারমোনিক’ অর্কেস্ট্রা শুনতে শুনতে প্রায় পক্ষাঘাতে পড়া জ্ঞানবধিরতা যখন আমাদের গ্রাস করছে, ঠিক তখনই আমাদের চোখের সামনে হাঁড়িকাঁখে সন্তান নিয়ে সারেঙ্গাবাদের নিজামুদ্দিন, বেগুনি শাড়ির ‘পোলিয়ো দিদি’ সোনালি-নমিতা এসে পড়েছেন। লাইক, শেয়ার রিটুইট, স্মাইলিতে ভাসতে ভাসতে নিজামুদ্দিনের পনেরো দিনের ‘পুঁচকে’টার আত্মপ্রকাশ একেবারে সুপারহিট।

সেই ঘটনাক্রম এখন আমাদের মনের জানলায় দাঁড়িয়ে টক্কর নিচ্ছে নিশ্চিন্তিপুরের কাশফুলের জঙ্গল চিরে দুগ্গা-অপুর ট্রেন দেখার দৌড়, কিংবা উটের পিঠে মুকুলের সোনার কেল্লার চূড়া দেখার ছবির শিহরনের সঙ্গে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্লোবাল হয়ে ওঠা সুনীতি-সুকুমারের বাংলা ভাষার এখনকার চারণভূমিতে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ‘এথনিক, অ্যাপিলিং, পাওয়ারফুল’ শব্দগুলি। এক সঙ্গে ‘কগনিটিড কিক আর অ্যাফেক্টিভ রিল’ সুপার ইম্পোজ়ড ছবিটার মধ্যে, ফোটোশপের গ্যালারি থেকে নয়। কোমর পর্যন্ত জল, ব্যাকগ্রাউন্ডে চালাঘর, আশাদিদির মাথার উপর বিজ্ঞানের বাক্স। এ দেশের ‘পাবলিক হেলথ’-এর লখিন্দরের ভেলা, জনস্বাস্থ্যের সত্যবানের দেহ কোলে জপেতপে বসে থাকা সভ্যতার সাবিত্রীর দু’হাতে যেন এসে পড়ছে ‘ভাটনগর’ পুরস্কারের আলো।

ছবি দেখে আমাদের কল্পনার দাঁড় জল কাটতেই থাকে। গামলা হাতে সন্তানের জন্য নিজামের টিকা ভিক্ষা, থুড়ি দাবি, যেন ঝিনুক দিয়ে চাঁদের মাটিতে জল নিংড়ানো, ‘পারসিভিয়ারেন্স’-এর ডানায় বসে মঙ্গলের লাল মাটির খাদানে যেন চালবাটার আলপনা আঁকা। পাগলামি, মমত্ব, আদেখলাপনা, পরম আদিমতা, নির্মম আধুনিকত্ব— সব মিলিয়ে এক অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাঁধা জীবনের জলছবি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে।

করোনার কালবেলা কেটে গেলে নিজামের ছেলেটার স্টারভ্যালু সুশান্ত সময়ের বসন্ত বিকেলে বসে হিসাবনিকাশে পড়বে। কিন্তু ইন্দির ঠাকরুনের চলে যাওয়ার দৃশ্যের মতোই উত্তর-আধুনিকতায় মজে থাকা আমাদের সবার মানসপটে এই ছবি দাগ কেটেছে। একই সঙ্গে উস্কে দিয়েছে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে লোকজীবনের নৈকট্যের ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা। প্রশ্ন তুলেছে পাবলিক হেলথের যে সাজুগুজু করা রূপ জনস্বাস্থ্য হয়ে আমাদের উঠোনে এসে পড়েছে, তাকে লোকস্বাস্থ্যের সত্যিকারের নিয়ামক হতে গেলে তার সত্তার পরিবর্তনটাই জরুরি নয় কি? আত্মাটাই যদি বদলে যায়, মানুষের দেহ তখন রাক্ষসের রূপ ধারণ করে। নিজামুদ্দিনের গামলা আর সোনালির বেগুনি শাড়ির সঙ্গত চলতি জনস্বাস্থ্যের ভাবধারাকে লোকস্বাস্থ্যের আঙ্গিকে পাল্টে ফেলার আত্মিক পরিবর্তনেরই ডাক দিয়েছে।

আগুয়ান বিজ্ঞানের মুকুটে আপাদমস্তক ঢাকা জনস্বাস্থ্যের চলতি সিনেমায় এ ছবির খুব একটা প্রাসঙ্গিকতা নেই। পাশ্চাত্যজ্ঞানের আলোয় উজ্জ্বল অনেকেই জিভ দাঁতে কেটে বলে উঠছে “ওহ্ কিউট, কিন্তু আর যা-ই বলো এতে সায়েন্স নেই।” কণ্ঠসজ্জায় দক্ষ ডিগ্রিন্যুব্জ চিকিৎসা-তাপস বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে ঘোষণা করছেন, “পাবলিক হেলথ মানে কিন্তু অ্যাক্সেস টু স্টেট অব আর্ট কেয়ার ফর অ্যাজ় মেনি। সাম কেয়ার অ্যান্ড ডেমনস্ট্রেশন অব কমপ্যাশন ফর এভরিবডি আর যা-ই হোক, পাবলিক হেলথ নয়। ছবি তোলার জন্য ভাল।”

এ ভাবেই সবার জন্য স্বাস্থ্য, সহমর্মিতার পরশ প্রভৃতি বার বার উচ্চারিত শব্দগুলো যখন প্রগতির ল্যাম্পপোস্টে ঝুলতে থাকা বাইপাস সার্জারি, ট্রান্সপ্লান্ট, ক্যানসারের চিকিৎসার বিপণনের আড়ালে মুখ গোঁজে, ঠিক তখনই পোলিয়োদৃপ্ত ‘কামাল পাশা’কে অ্যালুমিনিয়ামের গামলা থেকে চালাবাড়ির দাওয়ায় পেতে রাখা কাঁথার উপর নামিয়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসেন নিজামুদ্দিন। গেয়ে ওঠেন, “দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি।” চিরায়ত লোকজীবন আর জনস্বাস্থ্যের এগিয়ে চলার ভাবনা অনেক দূর থেকে একে অন্যকে দেখে। মধ্যেখানে এক অসেতুসম্ভব দূরত্ব।

এই হাসিটাই নিজাম হেসেছিলেন, যে দিন ওঁরা ভোটার কার্ড হাতে পেয়েছিলেন। আশাদিদির পোলিয়োর ডাক শোনার একটু আগে তিনি শুনতে পেয়েছেন যে, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নাকি ডিজিটাল হেলথ কার্ড হবে। বিষয়টা ঠিক ঠাহর না হলেও তাঁদের মনে হয়েছে েয, এটা অবশ্যই প্রাপ্তিযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দয়া, প্রাপ্তি, সুখভোগ— স্বাস্থ্যের সরলরৈখিক এ-দেশীয় পথ-চলার সময় আমজনতা এই সুরেই গান গায়। দাবি, অধিকারের মতো শব্দগুলো এ দেশের জনস্বাস্থ্যের অর্কেস্ট্রায় খঞ্জনির মতো বেতাল হয়ে মাঝে মাঝে বাজে। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি নিজামের মনের পাল্কি হয়। কেয়াবন, শালুক, ডোবাপুকুর ছাড়িয়ে হুম না হুম না ডাক ছেড়ে যখন তা অ্যাসফল্টের রাস্তায় এসে পড়ে, পিছলাতে থাকে দু’পা। পাল্কি থেকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে, শুনতে থাকে জনস্বাস্থ্যের দু’কূল জোড়া শোভা। সেখানে সাজানো থাকে আইসিউ, রেমডেসিভির, অনলাইনে ডাক্তার দেখানো, ই-ফার্মাসি, ইনশিয়োরেন্স ইত্যাদি শব্দগুলো। বেগুনি শাড়ি পরা আশাদিদির চেয়ে ‘স্টেট অব আর্ট পাবলিক হেলথ’-এর এই চিত্তহারী রূপে নেকটাইনন্দিত আর্য ভাষায় কথা বলা মানুষেরা প্রাধান্য পান।

জনস্বাস্থ্যের এই দাঁত বার করে হাসতে থাকা রূপে রেশন কার্ড লাগে না। জরুরি আধার কার্ড, ইনশিয়োরেন্সের কার্ড। আর সেই কার্ডগুলো বুড়ির শোনপাপড়ির মতো নিমেষে গলে জল হয়। নিজামদের সৌভাগ্য যে, এই কার্ডগুলো এখনও তাঁদের হাতে এসে পড়েনি। গাঁয়ের তুলসীতলায় ফুলপরি হয়ে এখনও আসেন বেগুনি শাড়ির নমিতা-সোনালিরা। দরজায় এসে হাঁক পাড়েন, কথা বলেন, মুখ ঝামটান। বড় গলায় বলেন, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। সব চাওয়া যায় যাঁর কাছে, সেই আশাদিদি গাঁয়ের আটচালায় সরকারের পাঠানো জনস্বাস্থ্যের আঙুল থেকে মাথা, দান থেকে অধিকার সব কিছু এক সঙ্গে হয়ে আবির্ভুত হন।

হারিকেন ছেড়ে নিয়ন, ভেপার, বিজলির আলোয় চকচক করা জনস্বাস্থ্যের এই যে দেহ, তা লোকজীবনের কতটা কাছে? প্রশ্ন জাগে। রিসর্ট বানিয়ে সেখানে অসুখের আলাপনে মজে থাকা জনস্বাস্থ্য নামের যে সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে আমরা প্রতি দিন পরিচিত হচ্ছি, সেখানে আর যা-ই হোক, লোকস্বাস্থ্যের কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। লোকস্বাস্থ্যে থাকে প্রাণের প্রাচুর্য, জনস্বাস্থ্য শব্দের চলতি রূপে আছে জীবন থেকে অনেক দূরে প্রাণ বাঁচানোর কুঠরি বানিয়ে সেখানে গানবাজনা করার ভাবনা। জনস্বাস্থ্যের ভড়ংমুখর এই চলতি-ভাবনার গর্তে পড়ে জীবন বার বার আছাড় খায়। জনস্বাস্থ্যকে তাই লোকস্বাস্থ্যের বেগুনি শাড়ি পরানোটা ভীষণ জরুরি। পাশ্চাত্য প্রগতির আলোয় উজ্জ্বল এদেশীয় জনস্বাস্থ্য পরিকল্পনাতে গুরুগ্রামের ছবি আঁকার চেষ্টা চলে গেঁওখালিতে। চোখ এবং মাথাও থাকে বস্টনে, বীরভূমে নয়। লোকস্বাস্থ্য প্রতি দিনের জীবনের ছন্দ, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে বিজ্ঞানের আলোর মিশ খাওয়ায়।

গাঁয়ের স্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনীয়তা শহুরে জীবনের থেকে অনেকটাই আলাদা। সিংহেশ্বর গ্রামের সদ্য-দেখা ছবি যদি আমাদের গ্রামের স্বাস্থ্যের ভাবনাকে আরও বাস্তবভিত্তিক এবং সংবেদনশীল করে তোলে, তা হলেই ভাল।

সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন

অন্য বিষয়গুলি:

Asha Workers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy