ভূত মানে অতীত। সেই অতীত আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসে। বাংলা সাহিত্যের খাঁজে খাঁজে এমন উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ‘ভূত’ হিসাবেই কখনও কখনও সেই অতীতের উপস্থিতি। অতীত জীবনের কথা জানানোর পাশাপাশি, না-বলতে পারা কথার ‘কন্ঠ’ও বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে। সেখানে যেমন পুরুষ আছে, আছে নারী চরিত্রও। ভূত চতুর্দশীর আগে সাহিত্যের সেই সকল নারী চরিত্রের সন্ধান করলে দেখা যায়, কত রকম ভাবেই ‘অন্যায়’ হয়েছে তাঁদের জীবিত কালে। ভূত চতুর্দশীর রাতও বছর বছর আসে। কিন্তু অপরাধ বা অন্যায় ঘটেছে যাঁদের সঙ্গে তাঁরা কেউ ফিরে আসেন না। এঁরা কেউই ফিরে এসে ‘অপরাধী’দের বিচার প্রক্রিয়ার লম্বা সময়কালের মধ্যে শাস্তি দিয়ে যান না। নথি আর ফাইলের চাপে ‘স্মৃতি’ হয়ে যেতে যেতে আবার সংযোজন হয় নতুন অপরাধের। এ বারের ভূত চতুর্দশী যদি সেই অপরাধীদের মেরুদণ্ড দিয়ে বইয়ে দিতে পারে হিমেল স্রোত! অপরাধ ঘটেছিল যাঁর সঙ্গে, আচমকা যদি তাঁর সঙ্গেই দেখা হয়ে যায় অপরাধীর?
রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ গল্পের মেয়েটি ডাক্তারি ছাত্রের কাছে এসেছিল নিজের পূর্ব জীবনের কথা জানাতে। গল্পে লেখা হচ্ছে, “ইচ্ছা ছিল, যখন লোকে আসিয়া আমাকে দেখিবে তখন এই হাসিটুকু যেন রঙিন নেশার মতো আমার ঠোঁটের কাছে লাগিয়া থাকে। ইচ্ছা ছিল, যখন আমার অনন্ত-রাত্রির বাসরঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিব তখন এই হাসিটুকু এখান হইতেই মুখে করিয়া লইয়া যাইব। কোথায় বাসরঘর। আমার সে বিবাহের বেশ কোথায়। নিজের ভিতর হইতে একটা খটখট শব্দে জাগিয়া দেখিলাম, আমাকে লইয়া তিনটি বালক অস্থিবিদ্যা শিখিতেছে। বুকের যেখানে সুখ-দুঃখ ধুকপুক করিত এবং যৌবনের পাপড়ি প্রতি দিন একটি একটি করিয়া প্রস্ফুটিত হইত সেইখানে বেত্র নির্দেশ করিয়া কোন অস্থির কী নাম মাস্টার শিখাইতেছে।”
খুঁজে দেখতে গেলে বোঝা যায়, সামাজিক কাঠামোতে নানান অপ্রাপ্তি, যৌন ঈর্ষা, অত্যাচার— বিভিন্ন মহিলা ভূতেদের নির্মাণ করেছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে আমরা অমানবী যে সমস্ত অস্তিত্বের কথা জানতে পেরেছি, তাদের অনেকেই রণযাত্রিণী। শিবায়ন কাব্যে আমরা পেয়েছি সন্ধ্যাবেলা ‘পেত্নী’র বাতি জ্বালানোর কথা। অন্নদামঙ্গলে আছে— ‘‘চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে/ চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্তকেশে।” ডাকিনীরা শিব-দুর্গার অনুচরীবিশেষ। ডাকিনীই ক্রমে ধ্বনি পরিবর্তনের ধারায় ‘ডাইনি’ হয়েছে। কিন্তু আজও ‘ডাইনি’ সন্দেহে মহিলাদের পুড়িয়ে মারার খবর পাওয়া যায়৷ এ রকমই কবিকঙ্কণে দেখতে পাই, ‘‘রণে অলক্ষিত হয়ে, চৌষট্টি যোগিনী লয়ে উরিলেন শ্রীসর্বমঙ্গলা।”
সাহিত্যে বহু দিন ধরেই আমরা মহিলা ভূতেদের নিজস্ব ভাষ্য তৈরি হয়ে উঠতে দেখি। দেখতে পাই, প্রতিশোধ নিতে ফিরে ফিরে আসা। আবার কখনও সামাজিক কোনও বিচ্যুতিকে জানান দেওয়ার জন্য কথা বলা।
যেমন, প্রথম পত্নী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে হরিচরণ যখন নৌকা করে যাচ্ছে তখন এক বীভৎস বর্ণনা দেন লেখক। প্রথম স্ত্রী বারে বারে যেতে চায় স্বামীর সঙ্গে। আমরা গল্পে পড়ি, “হরিচরণ চোখ বুজিল, হাত দিয়া কান ঢাকিল, তবু কানে ঢুকিতে লাগিল ঝড়ের একটানা শব্দ— উ উ উ, ভাষাহীন একটানা কান্না। মনে হইল ওই শব্দ আসিতেছে সাঁকোর ও পার হইতে, সেখানে মুখ থুবড়াইয়া বিনাইয়া বিনাইয়া সরব কাঁদিতেছে সে। উহাদের কথাবার্তা শুনিতে পাইয়াছে— শুনিয়া বুক চাপড়াইয়া বিজন শ্মশান ঘাটায় একলা প্রেতিনী মানুষের ভালোবাসার জন্য মাথা খুঁড়িয়া মরিতেছে।” মনোজ বসুর ‘প্রেতিনী’ গল্পে আমরা পড়ি মৃতা প্রথম স্ত্রীর যৌন ঈর্ষা এবং হরিচরণের তাড়িত অতীত।
আমাদের সাহিত্যে তো বটেই, পাশ্চাত্যেও এ রকম গল্প বা চলচ্চিত্র কম নেই। প্রচলিত অনেক ভূতের চরিত্রই মহিলাদের মানবী জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা বলতে ফিরে এসেছে। ঘরে, বাইরে, কর্মস্থলে ছোটবেলা থেকেই হয়ে যাওয়া মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের কথা যে ভাবে বলা প্রয়োজন তা বলতে না-পেরে মেয়ে জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পর জানানো।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টাইপরাইটার’ গল্পে আমরা যেমন পড়ি, অফিসের বস মেয়েটিকে যৌনলালসার জন্য বল প্রয়োগ করে মেরে ফেলে। পরে নিজে যখন মেয়েটির ব্যবহার করা টাইপরাইটারে টাইপ করতে বসে, বার বার নিজের ঘটানো অপরাধ লিখে ফেলতে থাকে সে। সেক্রেটারি সুলতা পালের সঙ্গে তার কৃতকর্ম জানানোর শেষে বাসের নীচে চাপা পড়ে মারা যায় সে-ও। তাড়িত অতীত, অপরাধপ্রবণতা ভূতের গল্পে খুবই ব্যবহৃত কৌশল। কিন্তু বাস্তবে সামাজিক ক্ষেত্রে অপরাধীদের মনে এমন কোনও ভাবনা কি উঁকি দেয়? সামাজিক ক্ষেত্রে নিত্য দিন অপরাধ সংঘটিত করে চলা অনেক ব্যক্তিই বহাল তবিয়তে থাকেন।
বাংলা সাহিত্যের স্বল্প পরিচিত আরও একটি গল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
মেয়েটির নাম ছিল বিনতা। বিনতা দস্তিদার। ওড়না দিয়ে গলা ঢেকে রাখত। তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা প্রৌঢ় বিরূপাক্ষ ভৌমিকের। নানা ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করলেও বিনতা জানিয়েছিল, বিয়ের পরেই তার ওই আবরণ উন্মোচন করবে সে। ক্রমে এগিয়ে আসে বিয়ের দিন। ফুলশয্যার রাতে বিরূপাক্ষের জানলায় আড়ি পাতে তার এক সহকর্মী বন্ধু। বিনতার গলার ওড়না সরে যায়। সেখানে দেখতে পাওয়া যায় জমাট বেঁধে থাকা রক্তের দাগ। বিরূপাক্ষ শুনে অজ্ঞান হয়ে যায়। মেয়েটি বাইরে বেরিয়ে এসে তার সহকর্মীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলে চলে যায়। বিরূপাক্ষ মারা গিয়েছিল। মেয়েটিকে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। বেশ কিছু দিন পর অফিসে এক ব্যক্তি আসে, যার কাছ থেকে জানতে পারা যায়, বিরূপাক্ষ আসলে খুনের আসামি। নিজের স্ত্রীকে ২১ বছর আগে গলা টিপে সে মেরে ফেলেছিল। বনফুলের লেখা ‘বিনতা দস্তিদার’ গল্পটির প্লট অন্য অনেক ভূতের গল্পের মতন মনে হলেও বিশেষ কারণে এই গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। অনেক দিন পরে প্রতিশোধ নিতে অন্য কেউ সেজে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বিনতাকে। যাকে অন্ধকারে একলা আসতে হয় না। যে দিনের আলোয় ভিড়ের মধ্যে ঘোরে। অফিস পাড়ায় যায়। লোকজনের মাঝে নববধূ সেজে বিয়ে করে। যেন চেনা জানা প্রতি দিনের এক জন।
অন্য অনেক জোরালো প্লটের গল্প থাকলেও এই গল্পটির অবতারণা করার কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেন, বাস, মেট্রো, অফিস পাড়া, অন্ধকার হয়ে আসা গলির মোড় সর্বত্রই যেন বিনতা দস্তিদারদের উপস্থিতির একটা জানান পাওয়া যাচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে চোখগুলো যেন বড় হচ্ছে। হাতের শিরায় বইছে আবহমানের দমে থাকার প্রতিরোধ।
মেয়ে হয়ে না-বলতে পারা কথা, নিজের উপর হয়ে যাওয়া অত্যাচারের গোপন জবানবন্দি দিতে হাজির হচ্ছে মেয়েরাই। এখন আর অন্ধকারকে ভয় নেই। নিজেদের নিরাপত্তার দাবিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে তারা। গ্রামের আলপথ দিয়ে সদ্য স্কুল যাওয়া মেয়েটা একা একা এগিয়ে আসছে। খালের পাড় থেকে উঠে আসছে হারিয়ে যাওয়া নিথর মেয়েটা। সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যাওয়ার আগেই যে মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয়েছিল, সে-ও জানতে চাইছে, তাকে এখন কোন নামে ডাকা হয়। লাশ হয়ে যাওয়া মর্গে আসা মেয়েটি কেবিন ড্রয়ারে ঢোকার আগে চাদরটা মুঠো করে ধরে আর এক বার। রাতের বেলায় মর্গে থাকার কথা ভেবে আগে ভয় করত। এখন মর্গের ভিতরে এসে মানুষের কথা ভেবে ভয় লাগছে। মৃত্যুর পরেও শরীরটা নিরাপদ তো? মফস্সলের গলিতে যেখানে ল্যাম্পপোস্টের আলো কেঁপে কেঁপে আসে। পড়া থেকে ফেরার পথে কয়েক বার ছেলেগুলো রাস্তা আটকেছিল যে মেয়েটার, সে-ও বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে আসে।
ভূত মানে অতীত। কিন্তু কখনও কখনও কিন্তু এই ভূত আগামীর রূপরেখা তৈরি করে। সেই দিগ্নির্দেশই করে বাংলা সাহিত্য।
(লেখক গবেষক। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy