সরব: মহানগরের রাস্তায় আনিস-হত্যার প্রতিবাদ মিছিল, ২১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
ব্যানার লিখতে লিখতে রং ফুরিয়ে গেলে আমার রক্ত দিয়ে লেখা হোক সংগ্রামী ব্যানার। ফেসবুক থেকে জানলাম সদ্য নিহত আনিস খানের এক সময়ের এই উক্তির কথা। জানি না কবেকার প্রসঙ্গ। হতে পারে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনে অতিমারির প্রাদুর্ভাবের প্রাক্কালে নাগরিকত্ব আন্দোলনের উত্তাল জোয়ারে আনিস তাঁর বন্ধুদের এ কথা বলেছিলেন। আনিস হত্যার খবরে বিক্ষুব্ধ কলকাতার প্রতিবাদী ছাত্রসমাজের মিছিলে দেখা গেল সেই ব্যানার। এক গুচ্ছ প্রশ্ন বাংলার মানুষ ও সরকারের কাছে ছুড়ে দিয়ে গিয়েছে আনিসের অকালে ঝরে যাওয়া প্রাণ। রক্ত থেকে উঠে আসা বিচারের দাবি যেন নীরবে নিভৃতে কান্নায় না ডুবে যায়, তা দেখার দায়িত্ব আজ বাংলার গণতান্ত্রিক বিবেকের উপর।
আনিসের বাবা ও পরিবারের সদস্যদের কাছে আমরা শুনেছি সে রাতের বিভীষিকার কথা। নাগরিক দরজায় পুলিশের মাঝরাতের কড়া নাড়া গণতন্ত্রের জন্য চিরকালই অশনিসঙ্কেত। সেই রাতে ঘাতকেরা আনিসের বাড়িতে কড়া নেড়েছিল পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারের পোশাকে। আমতা থানা ও জেলা পুলিশ প্রথম কয়েক দিন বলেছিল তাদের কেউ এই হানাদার বাহিনীতে ছিল না। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ঘাতকেরা তবে পোশাক ও অস্ত্র কোথায় পেল। মঙ্গলবার অবশ্য ঘটনাবলি নতুন মোড় নিয়েছে, যার ফলে আরও অনেক নতুন প্রশ্ন উঠে আসবে।
সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে গত বছর ২৪ মে আমতা থানার কাছে আনিসের লেখা নিরাপত্তার আবেদন। নির্বাচনে তাঁর এলাকা থেকে তৃণমূলের ভোট কম হওয়ার জেরে স্থানীয় কয়েক জন তৃণমূল নেতার হামলার কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তা চেয়েছিলেন আনিস। লিখেছিলেন, প্রাণের ভয়ে তাঁকে ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে।
সম্ভবত বেশ কিছু দিন পরে সে দিন ঘরে ফিরেছিলেন আনিস। আর ঘরে ফিরতেই নির্মম বাস্তবে পরিণত হল তাঁর আশঙ্কা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সেই নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসার জেরেই কি আজ আনিসকে খুন হতে হল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিশেষ তদন্তকারী দল তদন্ত করবে। দোষী শাস্তি পাবে, ছাড় পাবে না। যেখানে থানা এবং শাসক দলের স্থানীয় শাখা প্রশ্নের মুখে, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি কী ভাবে এবং কতখানি বাস্তবায়িত হয় সেটা অবশ্যই বাংলার মানুষের নজরে থাকবে। আনিসের পরিবার স্বভাবতই সরকারি তদন্তের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না। প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য চাই উচ্চ বিচারবিভাগীয় তদন্ত। পনেরো বছর আগের রিজওয়ানুর হত্যার কথা বাংলা ভুলে যায়নি।
আনিস হত্যা অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজ্য জুড়ে আবার একটা রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও পুলিশি যথেচ্ছাচারের প্রবণতা চোখে পড়ছে। দু’সপ্তাহ আগের নরেন্দ্রপুর থানার ঘটনা একটু দেখা যাক। হিন্দু সংহতি সংগঠন কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায় আন্দোলন কর্মী শরদিন্দু উদ্দীপনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাঁকে জেরা করে নরেন্দ্রপুর থানা। এই প্রসঙ্গে ছাত্র, মহিলা ও গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা থানায় গিয়ে প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদকারীদের অভিযোগ, সেখানে তাঁদের উপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চলে। এবং তার পরে দেখা যায়, কোমরে দড়ি বেঁধে ছাত্রছাত্রীদের বারুইপুর কোর্টে তোলা হল। অত্যাচারের ধরন পঞ্চাশ বছর আগে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানার রুনু গুহনিয়োগীদের কলঙ্কিত অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
পুলিশের চোখে এই কর্মীদের বড় অপরাধ তারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্র। আটক ছাত্রীদের পরীক্ষার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুলিশের কাছে আবেদন জানালেও সে আবেদনকে দম্ভভরে অগ্রাহ্য করে দেয় থানা। উল্টে ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশের উপর হামলা করার মামলা ঠুকে দেয়। আজ দিল্লির বুকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা উত্তরপ্রদেশে আলিগড়, লখনউ, বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশকে যে ভাবে বিষিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার ফলে ছাত্রদের উপর ঔপনিবেশিক শাসনের কায়দায় বার বার পুলিশি আক্রমণ নেমে আসতে আমরা দেখেছি। নরেন্দ্রপুর থানায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপর অত্যাচারের প্রকৃতিও একই রকম।
বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র আন্দোলন পেরিয়ে গ্রামের দিকে তাকালেও ছবিটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বীরভূমে শোনা যাচ্ছে সরকার প্রচুর কয়লা খুঁজে পেয়েছে। ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা নাকি দেশের বৃহত্তম কয়লা ব্লক। এক বার খুঁড়ে ফেলতে পারলে নাকি আগামী একশো বছর কয়লা ও বিদ্যুতের কোনও অভাব হবে না। একশো বছর ধরে বিপন্ন পৃথিবী এ-ভাবেই কয়লা পুড়িয়ে তার ধোঁয়ায় ধুঁকতে থাকবে কেন, সেই বেয়াড়া প্রশ্ন ছেড়ে দিলেও প্রশ্ন থেকে যায় জমি-বাসস্থান-জীবিকা থেকে যে বিরাট সংখ্যায় মানুষ উচ্ছেদ হবেন, তাঁদের কী হবে। যে গ্রাম হারিয়ে যাবে, যে প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে তার কি ক্ষতিপূরণ সম্ভব?
জাতীয়করণের পাঁচ দশক পরে কয়লা শিল্প আজ আবার উল্টো পথে। আউটসোর্সিং ও বেসরকারিকরণের রীতিমতো অভিযান চলছে বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চল জুড়ে। জমি হারানো মানুষের কয়লা খনিতে কাজ পাওয়ার অধিকারকে নস্যাৎ করে মাফিয়া শক্তি আবার জাঁকিয়ে বসছে কয়লা শিল্পে। সরকারি ভাষ্যে যাকে অবৈধ খনন বলা হয় তা আসলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এক নিরাপত্তাহীন সমান্তরাল খনন ব্যবস্থা, যা থেকে এক দিকে নিয়মিত মোটা টাকা কামিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা-প্রশাসক-ব্যবসায়ী চক্র, আর অন্য দিকে সামান্য অর্থের বিনিময়ে অঘোষিত দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাচ্ছে শ্রমিকের প্রাণ। কয়লা অর্থনীতি থেকে অতিমুনাফার আকর্ষণে অতিকায় পুঁজির দৃষ্টি লোলুপ হলেও খনি এলাকার মেহনতি মানুষের চোখে আজ গভীর আশঙ্কার ছায়া।
আইন অনুযায়ী যে কোনও মেগা প্রকল্প এবং ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করার আগে সেই প্রকল্পের সম্ভাব্য সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব অধ্যয়ন করতে হবে, এবং সংশ্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের গ্যারান্টি দিতে হবে। কিন্তু এই সব প্রশ্ন তুললেই আজ ডেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙার গ্রামের আদিবাসী জনগণের উপর পুলিশি মদতে শাসক দলের ভৈরব বাহিনীর তাণ্ডব চলছে। জনগণের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও সন্ত্রাস ও মিথ্যা মামলার কবলে পড়তে হচ্ছে। বীরভূমের মাটিতে আবার কি সে দিনের সেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের পূর্বাভাস— প্রশ্ন সেটাই।
বিধানসভা নির্বাচনের পর এখনও এক বছর পেরোয়নি। এই সন্ত্রাসের ছবিটা নির্বাচনের আগেও ছিল। আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাংলার গ্রামে গ্রামে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল গণতন্ত্রের পতাকা। তবুও বৃহত্তর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপির ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী অভিযানকে রুখে দিয়েছিল বাংলা। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও তাই আসন ও ভোট বেড়েছিল বাংলার শাসক দলের। সেই ভোটের পিছনে ছিল বাংলার মানুষের শান্তিতে ও সম্মানে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। আনিসের হত্যা, ডেউচা-পাঁচামিতে শাসক দলের তাণ্ডব, নরেন্দ্রপুর থানার অত্যাচার এই রাজ্যের মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষাকেই বিদ্রুপ করে চলেছে, অপমানিত করছে।
সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy