Advertisement
E-Paper

বীর চাই, যে করেই হোক!

ছাত্র আন্দ্রেয়া তাঁর শিক্ষক গ্যালিলিয়োকে বলেছিলেন, ‘‘দুর্ভাগা সে দেশ, যে দেশে বীর নেই।’’ গির্জার অত্যাচারে ধ্বস্ত দার্শনিক জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘দুর্ভাগা সে দেশ, যে দেশে শুধু বীরেরই প্রয়োজন!’’

The return of Sunita Williams to Earth and the reactions in India

ঊনষাটের সুনীতা উইলিয়ামস এবং বাহান্নর রাহুল দ্রাবিড় খুব নির্মোহ এবং নিস্পৃহ ভাবে পেশার ধর্মটুকু পালন করেছেন। —ফাইল চিত্র।

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৭
Share
Save

বুধবার ভোররাতে হুগলি থেকে ফোন গেল উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রান্তে। আনন্দবাজার ডট কমের সিনিয়র সহকর্মীকে রসিক জুনিয়র প্রশ্ন করল, ‘‘আচ্ছা, এই যে ওঁরা মহাকাশ থেকে ফিরলেন, এ বার তো চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। চিকিৎসাও হবে। সেই চিকিৎসা কি স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে হবে?’’

নিছকই ইয়ার্কি। ফোনের দু’প্রান্তই রাত জেগে সিএনএনে সুনীতা উইলিয়ামসের পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন অভিযানের সরাসরি সম্প্রচার দেখেছে এবং উত্তেজিত। শুধু কি দুই সহকর্মী? সকলেই তো উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন এবং কৌতূহলী। সুনীতাদের নিয়ে গোটা গোটা খবর লেখা হচ্ছে (আনন্দবাজার ডট কম-সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে)। সঙ্গের গ্রাফিকে অসামান্য কুঁচির কাজ। আবেগে জবজবে হয়ে উঠছে ফেসবুক। কোথাও আবার চপল রসিকতাসমৃদ্ধ ‘মিম’। কিন্তু বেশির ভাগটাই সুনীতা এবং তাঁর সহকর্মীর (যাঁর নামটা ছাপার অক্ষরের বাইরে আর সে ভাবে পরিচিতি পেল না) বীরত্বের কাহিনিসঞ্জাত।

বুধবার একটু বেলার দিকে এক বিশিষ্টজন প্রশ্ন পাঠালেন: সুনীতার পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন নিয়ে আমাদের এখানে এত হইচই কেন?

প্রথমে ভাবলাম, ওই স্বাস্থ্যসাথী মার্কা রসিকতার মতো একটা লঘু এবং চপল জবাব আশা করছেন। তার পরে মনে হল, সম্ভবত না। অতএব লিখলাম, মনে হয় দুটো ‘ফ্যাক্টর’ আছে। প্রথমত, মহিলা। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় বংশোদ্ভূত। যে দু’টি ফ্যাক্টরের জন্য তিন নম্বর কারণটা জন্ম নিয়েছে। এবং সেটাই আসল— আমাদের একটা ‘বীর’ দরকার। কারণ, ইদানীং এই উপমহাদেশের কাউকে নিয়ে বীরত্বের কাহিনি খুব একটা লেখা হচ্ছে না।

সুনীতাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে। কারণ, আমরা সুনীতার মধ্যে একজন ‘বীর’ খুঁজে পেয়েছি। সেই কারণেই মার্কিন নাগরিক সুনীতার গুজরাতের শিকড়, তাঁর হিন্দু ধর্ম পালনের কথা ইত্যাদি বাখান করে বলা হচ্ছে। মার্কিন মহাকাশচারিণীর সঙ্গে ভারতের সংশ্রব টেনে বলা হচ্ছে, সুনীতা ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে যাওয়ার সময় ভগবদ্‌গীতার অনুলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১২ সালে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি ‘ওঁ’ চিহ্ন এবং উপনিষদের অনুলিপি। তার আগে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সুনীতা এসেছিলেন সবরমতী আশ্রমে। সেখান থেকে গিয়েছিলেন তাঁর পৈতৃক গ্রামে। সুনীতা পদ্মভূষণ পুরস্কারপ্রাপ্ত। তাঁকে ‘ওয়ার্ল্ড গুজরাতি সোসাইটি’ পুরস্কৃত করেছিল ‘সর্দার বল্লভভাই পটেল বিশ্বপ্রতিভা’ পুরস্কারে। ঘটনাচক্রে, তিনিই প্রথম ওই পুরস্কারপ্রাপক, যিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও ভারতীয় নাগরিক নন। তিনিই প্রথম মহাকাশ থেকে বস্টন ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে সুনীতা দেখা করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে। নিঃসন্তান উইলিয়ামস দম্পতি অহমদাবাদ থেকে একটি কন্যাসন্তানকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। গুগ্‌ল-বাহিত হয়ে ইত্যাদি-প্রভৃতি নানা তথ্য ঘুরছে চারদিকে।

সেটা অবশ্য অপ্রত্যাশিতও নয়। যেমন অপ্রত্যাশিত নয় নরেন্দ্র মোদীর কালক্ষেপ না-করে সুনীতাকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁর শাসনাধীন রাজ্যের আইনসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুনীতাকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার দাবি। অবশ্য স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সুনীতাদের প্রত্যাবর্তনকে রাজনৈতিক রং দিয়ে থাকতে পারেন (সব দোষ বাইডেনের। তিনিই সুনীতাদের মহাকাশে ফেলে রেখেছিলেন), তা হলে মোদী-দিদি আর কী দোষ করলেন!

বসুন্ধরা, এমনিতেই বীরভোগ্যা। তার পরে সেই বীর যদি হন ভারতীয় বংশোদ্ভূত, সুনীতা নাম্নী এবং অন্তরীক্ষচারিণী, তা হলে তাঁকে আরও ঝলমলে লাগে। কিন্তু মহাকাশে পাড়ি দেওয়া তো তাঁর পেশা! হ্যাঁ, সেই পেশা ঝুঁকিপূর্ণ। ‘কলম্বিয়া’ ধ্বংস হয়ে কল্পনা চাওলার পরিণতির কারণে অত্যন্ত ঝুঁকির। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও সত্যি যে, সুনীতা এবং তাঁর সহকর্মী নভশ্চরেরা একটি পরীক্ষামূলক অভিযানে গিয়েছিলেন। যেমন অভিযানে যান পুলিশবাহিনী, সেনাবাহিনী বা আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যেরা। পেশার কারণেই যান। ঝুঁকি নিয়েই যান।

যেমন গিয়েছিলেন সুনীতারা।

সুনীতা এবং ব্যারি উইলমোরকে নিয়ে যে ‘স্টারলাইনার’ আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে (আইএসএস) গিয়েছিল, সেটিই তার প্রথম অভিযান। সেই কারণেও ঝুঁকি ছিল। যন্ত্র গোলমাল করলে যে দু’জনকে গবেষণাকেন্দ্রে রেখেই ফিরে আসতে হতে পারে, সেই পরিকল্পনাও আগে থেকেই ছিল। অভিজ্ঞ নভশ্চর সুনীতার ন’টি ‘স্পেসওয়াক’-এর অভিজ্ঞতা রয়েছে (মহিলাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। যার মোট সময়কাল ৬২ ঘণ্টা ৬ মিনিট। অভিযানের আগে তাঁকে ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি’ সম্পর্কে জানানোও হয়েছিল। সেটাই দস্তুর।

যে কোনও পরিকল্পিত অভিযানেই গোলমাল হতে পারে। তার জন্য ‘প্ল্যান বি’ তৈরি রাখাটাও সেই পেশার পরিকল্পনারই অঙ্গ। সুনীতাদের অভিযানেও গোলমাল হয়েছিল। পরিকল্পিত ভাবেই তা সামলানো হয়েছে। সেই কারণেই মার্কিন বা ইয়োরোপীয় সংবাদমাধ্যম সুনীতাদের ‘ঘর ওয়াপসি’ নিয়ে কোনও গদগদ বাড়াবাড়ি করেনি। কারণ, এটা ওই বাসে চড়ে কোথাও গন্তব্যে যাওয়ার মতো। ফেরার সময় বাস বিগড়ে গেলে যাত্রীরা আটকে পড়েন। পরিবর্ত বাস গিয়ে তাঁদের নিয়ে আসে।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে সুস্থই ছিলেন সুনীতা। বিভিন্ন নিরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। যেমন হয়ে থাকে। তিনি ফিরে আসার পরে তাঁর শরীরের উপর কী কী প্রভাব পড়েছে বা অভিঘাত হয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখাও তেমনই এক নিরীক্ষারই অঙ্গ। নভশ্চর হিসেবে সুনীতাদের অভিযানের শর্ত।

The return of Sunita Williams to Earth and the reactions in India

(বাঁ দিকে) পৃথিবীতে ফিরলেন সুনীতা উইলিয়ামস। ভাঙা পা নিয়ে রাজস্থান রয়্যালসের অনুশীলনে রাহুল দ্রাবিড় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

ঠিক যেমন পেশার শর্ত মেনে রাহুল দ্রাবিড় ইলেকট্রিক হুইলচেয়ারে বসেই হাজির হয়েছেন রাজস্থান রয়্যালসের অনুশীলনে। সুনীতার মতো তাঁকেও লোকগাথার ‘বীর’ বানিয়েছি আমরা। কারণ, আমাদের জগতে ‘বীরত্ব’ কম পড়িয়াছে।

ভারতীয় দলের প্রাক্তন কোচ দ্রাবিড় আইপিএলে রাজস্থানের হেড কোচ হয়েছেন। মরসুম শুরু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি বেঙ্গালুরুতে কর্নাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত স্থানীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে খেলতে গিয়ে বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে বসেছেন। যদিও সেই চোট নিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে পুত্র অন্বয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ছিলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার দ্রাবিড়। ৬৬ বলে ৪৩ রানের পর আর দাঁড়াতে পারেননি। ধরাধরি করে মাঠের বাইরে নিয়ে যেতে হয়। এই অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটার কী করবে? বাড়িতে পা ঝুলিয়ে ভালমন্দ খাবে, ওয়েব সিরিজ় দেখবে বা টেলিভিশনের ক্রিকেট শোয়ে রাজা-উজির মারবে।

কিন্তু পেশাদারকে তো কর্মক্ষেত্রে পৌঁছোতেই হবে। অতএব, বাঁ পায়ে গাবদা প্লাস্টার নিয়ে হুইলচেয়ারে বসে (কখনও বগলে ক্রাচ নিয়ে) হেড কোচ দ্রাবিড় গিয়েছেন আইপিএলের মাঠে। যে ছবি নিয়ে মুগ্ধ সারা দেশ।

দেখেশুনে আইপিএলের প্রথম মরসুমের কথা মনে পড়ে গেল। ইডেনে ম্যাচের পর বাইপাসের ধারের হোটেলে রাত পার্টি। যথারীতি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু আমরা হলাম গিয়ে নেই-আঁকড়ার দল। ইডেনের ম্যাচ শেষের পরে অফিসে ফিরে কপি-টপি লিখে পড়ে পাওয়া আরও চোদ্দো আনার আশায় হোটেলে পৌঁছে কফিশপে যাওয়ার পথে লবির বেঁটে দেওয়ালটায় বসে পা দোলাচ্ছি।

তখন বেশ রাত। হঠাৎ দেখলাম, করিডর ধরে হেঁটে আসছেন দ্রাবিড়। পরনে ডেনিমের রংচটা ট্রাউজ়ার্স আর নেহাতই সাদামাঠা একটা চেক শার্ট। আদৌ পার্টির পোশাক নয়। আমি ক্রিকেট সাংবাদিক নই। খেলাটার ছাত্র মাত্র। তা-ও টিভি দেখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মাঠের চ্যাঁ-ভ্যাঁ খুব একটা ভাল লাগে না। তার চেয়ে বেশি উৎসাহ রিপ্লে এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত শোনায়। কিন্তু আইপিএলের প্রথম সংস্করণ শুধু ক্রিকেট নয়, একটা ‘মেগা ইভেন্ট’। সুতরাং প্রধান সম্পাদক নির্দেশ দিয়েছেন কভার করতে। অগত্যা।

দ্রাবিড়ের আমায় চেনার কথা নয়। চিনলেনও না। কিন্তু বিলক্ষণ চিনলেন পাশে বসে-থাকা আনন্দবাজার পত্রিকার সহকর্মী (এবং পরিচিত ক্রিকেট সাংবাদিক) সুমিত ঘোষকে। সামান্য ভ্রুভঙ্গি। যাতে লেখা ছিল, তুমি এখানে এখন কী মনে করে? সুমিত একটা একপেশে হাসির সঙ্গে তা-না-না-না করে একটা ‘হুঁ’ দিল। দ্রাবিড় মাথা নেড়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন পার্টিস্থল অভিমুখে।

ভারতীয় ব্যাটিংয়ের দেওয়ালকে দেখে সেই রাতে মনে হয়নি, সারা সন্ধ্যার ক্রিকেটীয় ধকলের পর রাতভরের পার্টি-টার্টিতে তাঁর খুব রুচি ছিল। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির দুনিয়া পেশাদারের। মাঠে ম্যাচ জিতিয়েও পার্টিতে হাজিরা দিতে হয়। পা ভাঙলেও মোটরচালিত হুইলচেয়ারে চেপে মাঠে পৌঁছোতে হয়। এবং সেই পেশাদারকে দেখে সারা দেশ আমোদিত হয়। নিজেদের পছন্দমতো বীরত্বের আখ্যান রচনা করে।

ঊনষাটের সুনীতা এবং বাহান্নর দ্রাবিড়। কাউকেই নিজের মুখে নিজেদের সাম্প্রতিক ‘কীর্তি’ নিয়ে কিছু বলতে শুনিনি। অবশ্য পেশাদারেরা ‘হ্যান করেছি, ত্যান করেছি’ বলেনও না। তাঁরা মঞ্চের পিছনের পরিশ্রম, ব্যক্তিগত জীবনের নাটকীয় ওঠাপড়া আড়ালে রাখেন। তাঁরা খুব নির্মোহ এবং নিস্পৃহ ভাবে পেশার ধর্মটুকু পালন করেন। যেমন সুনীতা করেছেন। যেমন করেছেন দ্রাবিড়।

আমরাই শুধু পেশাদারের মধ্যে ‘বীর’ খুঁজে মরি! কারণ, আমাদের বীরের প্রয়োজন।

গ্যালিলিয়োর বিখ্যাত আখ্যান মনে পড়ছিল। ছাত্র আন্দ্রেয়া শিক্ষককে বলেছিলেন, ‘‘দুর্ভাগা সে দেশ, যে দেশে বীর নেই।’’ গির্জার অত্যাচারে ধ্বস্ত দার্শনিক জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘দুর্ভাগা সে দেশ, যে দেশে শুধু বীরেরই প্রয়োজন!’’

Sunita Williams Sunita Williams space mission Rahul Dravid

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}