দেশ-দর্শন: ইজ়রায়েলি বাহিনী ধ্বংসকাণ্ড করে সরে যাওয়ার পর জবালিয়া উদ্বাস্তু শিবিরের চেহারা, উত্তর গাজ়া, ৩০ মে। ছবি: রয়টার্স।
বসন্ত এলেই প্যালেস্টাইনে সবুজ অলিভ গাছগুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল ফোটে। এই অঞ্চলের জলপাই সবুজ এবং কালো রঙের ফলগুলো যেন ঋতু পরিবর্তনের সূচক। স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করেন, ৫,৫০০ বছরের পুরনো, পশ্চিম তীরের বেথলেহেমের কাছে আল-ওয়ালাজ়া গ্রামে বিশ্বের প্রাচীনতম অলিভ গাছটি মিশর এবং ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের আগে থেকে ছিল। স্থানীয় ভাষায় ‘আল-বাদাউই’ নামে পরিচিত এই গাছের নামের মানে, কবি মাহমুদ দারবিশ-এর ভাষায়, ‘অলিভ উইল স্টে এভারগ্রিন: লাইক আ শিল্ড ফর দি ইউনিভার্স’ (জলপাই চিরসবুজ থাকবে; মহাবিশ্বের জন্য একটা ঢালের মতো)। তাঁর আশা, এই ভূখণ্ডে যদি যুদ্ধ কখনও শেষ না হয়, তা হলেও ফিলিস্তিনের চিরসবুজ অলিভ গাছগুলো এই অস্থির ভূমির গল্প পরবর্তী প্রজন্মকে শোনাবে।
গাজ়ায় ইজ়রায়েলের যুদ্ধ-ঘোষণার পর সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনও অবধি সম্ভবত ৩৮,০০০-এর বেশি হত এবং ৮৬,০০০-এরও বেশি আহত। দিনে অন্তত ১৫-২০ জন গাজ়ার শিশু তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে। প্রায় ২৪ লক্ষ ফিলিস্তিনি বাসিন্দা আশ্রয়হীন। শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, ৫০,০০০-এর বেশি শিশুর তীব্র অপুষ্টি, এখনই চিকিৎসা প্রয়োজন। গাজ়ার ৭০ শতাংশ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়েছে। এই পরিস্থিতি ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের সমতুল্য, যখন আরব জনসংখ্যার অধিকাংশকে নবজাত ইজ়রায়েল থেকে জোর করে বিতাড়িত করে, শত শত প্রাচীন গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছিল।
পশ্চিম এশিয়ায় এখনও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়। এই অসহ্য কষ্টকর আবহাওয়ায় সাধারণ মানুষের অবস্থা এমনিতেই খারাপ থাকে। আর এখন গাজ়ায় খাবার তো দূর স্থান, বিদ্যুৎ এবং বিশুদ্ধ জলের অভাবে, অনাহারে শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কোলে মারা যাচ্ছে। আবার, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির মূল্যায়নকারী ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিয়োরিটি ফেজ় ক্লাসিফিকেশন’-এর একটি প্রতিবেদন সতর্ক করেছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে গাজ়া ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে। গাজ়ায় অবরোধের কারণে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে খাবার নিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আবার, অবরুদ্ধ অঞ্চলে সাহায্যকারী সংস্থাগুলো যখন খাবার বিতরণের জন্য ঢুকছে, তখন ক্ষুধার্ত প্যালেস্টাইনিরা বিলিব্যবস্থাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গাজ়ায় পাঠানো মোট ৭০০০ টন সহায়তার মধ্যে মাত্র ১০০০ টন নাকি বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। কয়েক দিন আগে এক শরণার্থী শিবিরে এক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা স্যুপ বিতরণ করার সময়ে গাজ়ার বাসিন্দারা জলের ট্রাকের দাবিতে তাঁদের উপর চড়াও হন। ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম অনুসারে, গাজ়ার পাঁচটি বর্জ্য জল শোধনাগারের সব ক’টিই বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে, পরিষ্কার জলের জোগান হ্রাস করার জন্য পানীয় জল আসার ব্যবস্থা অন্তত ৬৭ শতাংশ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলি বার বার সতর্ক করেছে যে, ত্রাণকর্মীরাও গাজ়ায় নিরাপদ নন: “ইজ়রায়েল গাজ়ায় সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট বিপর্যয় তৈরি করছে”— এটাই তাদের মত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটরের অভিযোগ, ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধকৌশল হিসেবে অসামরিকদের অনাহার ও মৃত্যুকে ব্যবহার করছেন।
গত ২৯ মে ‘অল আইজ় অন রাফা’ লেখা-সহ একটি উদ্বাস্তু শিবির ভর্তি তাঁবুর শহরের ছবি ৪.৬ কোটি বার শুধু ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে শেয়ার করা হয়েছে। এই পোস্টার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি। অনেক মানুষই জানতেন না, রাফা কোথায়, কেন গুরুত্বপূর্ণ? রাফা মিশরের সিনাই উপদ্বীপের সীমান্তে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। এই ৭ মে ট্যাঙ্ক এবং আকাশপথে আক্রমণের আগে রাফা-ই গাজ়ার একমাত্র সীমান্ত ছিল, যার উপর ইজ়রায়েলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। হামাস-ইজ়রায়েল দ্বন্দ্বের জেরে গাজ়ায় যুদ্ধ শুরুর পর, স্থলপথে ত্রাণ পৌঁছনোর এবং বিদেশিদের গাজ়া ছেড়ে বেরোনোর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রাফা সীমান্ত। মিশর আর ইজ়রায়েলের মধ্যেকার এই ‘বাফার জ়োন’কে নেতানিয়াহু হামাসের শেষ শক্ত ঘাঁটি বলে দাবি করার পর শুরু হয় আক্রমণ। সবচেয়ে বিপদে পড়েন কয়েক মাসের মধ্যে তৃতীয় বারের মতো বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া শরণার্থীরা। তাঁরা গাজ়ার আটটি ঐতিহাসিক শরণার্থী শিবিরের মধ্যে আল-নুসিরাত, আল-শাতি, আল-মাগাজ়ি এবং আল-বুরেজ় ক্যাম্প এবং আল-তুফাহ এলাকা থেকে রাফাতে পালিয়ে এসে ইজ়রায়েলি সাঁড়াশি আক্রমণের মাঝে পড়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ইজ়রায়েলকে রাফা আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়াতেও কোনও কাজ হয়নি। বোমা হামলায় পশ্চিম রাফার আল-মাওয়াসিতে অনেক উদ্বাস্তু প্রাণ হারান। সাধারণ মানুষ তো বটেই, ‘অল আইজ় অন রাফা’ লেখা এই পোস্টার সেলেব্রিটি ও প্রভাবশালী, যাঁরা যুদ্ধ সম্পর্কে আগে কথা বলেননি বা বলতে পারেননি, তাঁদেরও নাড়িয়ে দেয়।
জানুয়ারি থেকে গাজ়া-ইজ়রায়েলের দ্বন্দ্বের মধ্যে ঢুকে পড়েছে লেবানন। সমস্যার শুরু হয় বেরুটে হামাস নেতা সালেহ আল-আরোরিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করা নিয়ে। লেবানন-ইজ়রায়েল সীমান্তে থাকা জঙ্গি গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা, হামাসের মিত্র এবং ইরান-সমর্থিতও বটে। নেতানিয়াহু এক দিকে হামাসের সামরিক ও শাসন ক্ষমতা ধ্বংস করে, হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যে অবিচল থাকেন, অন্য দিকে ঘোষণা করেন, লেবাননের হিজবুল্লা গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করার জন্য ইজ়রায়েল তার উত্তর সীমান্তে নতুন যুদ্ধ-ফ্রন্ট খুলতে সামরিক ভাবে প্রস্তুত। ইজ়রায়েলের হার্জ়লিয়ার রাইখম্যান ইউনিভার্সিটি-র এক সম্মেলনে ক’দিন আগে যুদ্ধ মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য ঘোষণা করেছেন, “আমরা লেবাননকে পুরোপুরি অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে পারি এবং কয়েক দিনের মধ্যে হিজ়বুল্লার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারি।” ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, লেবাননে আক্রমণের পরিকল্পনা সরকারি ভাবে ‘অনুমোদিত এবং বৈধ’ করা হয়েছে।
২০০৬ সালের ৩৪ দিন ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর, হিজ়বুল্লাও দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিএনএন জানিয়েছে, এই জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্ত্র ভান্ডারের ব্যাপ্তি ও হামলার পরিশীলনের রকম দেখে ইজ়রায়েলি কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছেন। লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে হিজ়বুল্লা এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জার্মানি, কানাডা এবং আমেরিকা তার নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। হিজ়বুল্লা হামাসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই গাজ়া থেকে লেবাননে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে আরও বেশি বাস্তুচ্যুতি এবং সর্বনাশের কারণ হতে পারে: এই মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি এবং জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস। আমেরিকান প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনও বলেছেন যে, হিজ়বুল্লার সঙ্গে ইজ়রায়েলের আর একটি যুদ্ধ গোটা পশ্চিম এশিয়ায় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সিরিয়ার যুদ্ধের সময়ের পর থেকেই এই অঞ্চলের এমন অবস্থা যে, আর ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পাওয়া যায়নি।
২০ জুন এ বছরের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের থিম ছিল ‘শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি’। এই বিশ্ব শরণার্থী দিবস নিছকই প্রতীকী— বড্ড ফাঁপা শোনায় এখন ‘সংহতি’র মতো শব্দ। সারা পৃথিবীতে ১৮ বছর বয়সিরা যখন কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে, গাজ়ার ১৮ বছর বয়সিরা সেখানে বেঁচে থাকার জন্য রোজ যুদ্ধ করছে, এটাই তাদের জীবনযাপনের অর্থ। কার সংহতির কথা বলছি আমরা, অর্থ কী তার? পশ্চিম এশিয়া জুড়ে এখন সমাজের ভারসাম্যই আলাদা। হামাস থেকে হিজ়বুল্লা, ইরাক ও সিরিয়া এবং ইরান, একই সুতোয় গাঁথা। আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমি দেশের অস্ত্র সরবরাহ করে সে অঞ্চলের বাস্তুচ্যুতি, নিধন, অনাহার-মৃত্যু, মহিলা ও শিশু মৃত্যুর রোজকার হিসাব যদি বাদও দেওয়া হয়, ইউরোপের সব দেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমাজের চরম সঙ্কট, এবং একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া— সব মিলিয়ে এই বিশ্বে ‘শরণার্থী’র শরণ নেওয়ার আর কোনও পরিসর অবশিষ্ট নেই।
নেই সে বিষয়ে আমাদের কোনও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা বা উদ্যোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy