কতটা চিনি খাই, আগে থেকেই তাঁর জানা ছিল। নিজের হাতে কফি সার্ভ করলেন ছত্তীসগঢ় পুলিশের তৎকালীন সর্বময় কর্তা, তাঁর অফিসে বসে। এবং ‘সস্নেহ’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন, “আচ্ছা, তুমি যে এই এই জায়গায় ঘুরলে, কোথাও কোনও অসুবিধে হয়নি তো?” কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম, আমি বলিনি ওঁকে, তবু এমন সবিস্তার বর্ণনা! অবশ্য, বিস্ময়ই বা কেন। মাওবাদী-প্রভাবিত রাজ্যের সাংবাদিক মাত্রই জানেন পুলিশের কর্মপদ্ধতি। গিয়েছিলাম গ্রেফতার হওয়া মানবাধিকার কর্মী, চিকিৎসক বিনায়ক সেনের উপর লেখা লিখতে। তাই হেসে বললাম, “কী বলছেন! আপনারা এত দেখভাল করেন যে, জঙ্গলে আছি না বাড়িতে, বোঝা দায়!” পুলিশকর্তার অট্টহাস্য। হাসি থামতে বললেন, “কী করব বলো, এটা তো আমাদের কাজ। সিস্টেম ফেল করে যাবে তা না হলে!”
কিছু দিন ধরেই কেবল এই ‘সিস্টেম’-এর কথা ভাবছি। এবং ভাবতে গিয়ে নতুন করে পড়ছি অরুন্ধতী রায়ের মাই সিডিশাস হার্ট বইটি। রাষ্ট্রশক্তির ‘সিস্টেম’-এর কথাই তো নানা ভাবে উঠে এসেছে তাঁর এই গ্রন্থে। রাষ্ট্রের ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে গেলে, বা সহমত পোষণ না করলে কী হতে পারে, তার নজির এ দেশে ভূরি ভূরি। বলা বাহুল্য, সব ক্ষেত্রে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে, কিন্তু তা কফির পেয়ালায় চিনি মেশানোর মতো মোলায়েম নয়!
অরুন্ধতী রায় অবশ্য বরাবরই ‘বিদ্রোহী’ লেখক হিসেবে পরিচিত। আজকের দিনে যদিও আলাদা করে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটার অর্থ নেই, যে কোনও বিক্ষুব্ধ বা বিরোধী স্বরই আমাদের আজকের শাসকের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। লক্ষণীয়, অরুন্ধতীর প্রায় এক হাজার পাতার এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে রচিত। রচনাকালের মধ্যে কেন্দ্রে সরকার গড়েছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ, এবং নরেন্দ্র মোদী। এই সব প্রবন্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র কখনওই ‘সিস্টেম’-বিরহিত ছিল না, তবে এখন সেই সিস্টেম-এর যা চেহারা, সেটাও আবার সব সময় এমন ছিল না।
২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময় সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে অরুন্ধতী তীব্র আক্রমণ শাণিয়েছিলেন তাঁর প্রবন্ধ ‘ডেমোক্র্যাসি: হু ইজ় শি হোয়েন শি’জ় অ্যাট হোম?’-এ। কংগ্রেস এবং বাম দলগুলি তখন মোদীর ইস্তফা দাবি করছে। আর ঠিক সেই সময়ে অরুন্ধতী লিখছেন, “পদত্যাগ? আমরা কি যাবতীয় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি? অপরাধীদের ইস্তফা হয় না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনো, বিচার করো এবং সাজা দাও।”
গড অব স্মল থিংস-এর জন্য বুকার পুরস্কার পাওয়ার পর, অনেকেই ভেবেছিলেন— অরুন্ধতী হয়তো সাহিত্য রচনাতেই মগ্ন থাকবেন। অথচ, না, তিনি সমসময়ের রাজনীতিতে শক্ত ভাবে পা রেখে দাঁড়ালেন। তাঁর লেখার মূল সুরটি বাঁধা পড়ল একটি তারে— প্রান্তিক, অবহেলিত মানুষের হয়ে সরব হওয়া। অত্যন্ত প্রভাবশালী, বিপজ্জনক ও ক্ষমতাধরদের চোখে চোখ রেখে সোজা কথা সোজা ও বলিষ্ঠ ভাবে বলা। আজ আমরা জানি, এই ভঙ্গিমায় যাঁরা লেখেন, তাঁরা ব্যতিক্রমী এবং রাষ্ট্রের চোখে অত্যন্ত বিপজ্জনক। অরুন্ধতী মনে করিয়ে দেন, সংবিধানের শপথ নিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র রক্ষার ভার যে শাসকরা নেন, তাঁরা বিক্ষুব্ধ স্বর সহ্য করতে অপারগ। পঁচাত্তর বছরের দেশ সেটাই দেখিয়েছে। তবে পঁচাত্তর বছরের দেশ এটাও দেখিয়েছে যে, ক্রমে সেই অসহিষ্ণুতা কেমন লাগামছাড়া হয়ে দেশের চেহারাটাই নষ্ট করে দিতে বসেছে। কী ভাবে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক, সাম্যকামী নাগরিকের মন অস্থির হয়ে উঠেছে ক্রমাগত, হৃদয় হয়েছে বিদ্রোহী, রক্তাক্ত। ‘সিডিশাস হার্ট’।
মাই সিডিশাস হার্ট বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। ২০২২ সালে আজ মনে হয়, এই সব প্রবন্ধ রচনার প্রেক্ষাপট এখন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। এক দিকে প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে প্রতি বাড়িতে, অফিসে, দোকানে তেরঙ্গা ওড়ানোর মোলায়েম ডাক। অন্য দিকে, অদম্য অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসা, বিরুদ্ধ স্বর ও সাংবাদিকের সমালোচনা নৃশংস ভাবে দমিয়ে রাখার স্পর্ধা আজ প্রতি দিনের সংবাদ। সবটা মিলিয়েই আজকের ‘সিস্টেম’।
অরুন্ধতী লিখেছিলেন, এই বইয়ের প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধ প্রকাশের পরেই কত তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল! পুলিশ কেস, আইনি নোটিস, আদালতে হাজিরা, এমনকি কয়েদবাসের আদেশ! গণতান্ত্রিক দেশে বসে এতটা অবসন্ন করে তুলত এ সব যে, প্রতি বারই তিনি ভাবতেন, “পরের লেখাটা আর লিখব না।” “কিন্তু, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে প্রতিটি লেখাই আমাকে এ পৃথিবীর গভীর থেকে আরও গভীরে নিয়ে যায়, যে সময়ের মধ্যে আমরা বাস করছি, সেই সময়কাল সম্পর্কে বিচারবোধ আরও সমৃদ্ধ হয়, দেখার চোখ উন্মোচিত হয়।”
ভাগ্যিস প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন তাঁদের মতো লেখকরা। তাই, গণতান্ত্রিক পথে আদিবাসীদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে রাষ্ট্রশক্তি কী ভাবে দমন করে, তার বিশ্লেষণ ‘পিস ইজ় ওয়ার’ প্রবন্ধে পড়তে গিয়ে আমরা স্মরণ করি, আদিবাসী-পরিচয়সম্বলিত নবতম রাষ্ট্রপতির দেশে কিন্তু আজও বাঁধ, খনি বা ইস্পাত কারখানা নির্মাণ থেকে অরণ্যের বাসভূমি রক্ষা করতে চেয়ে দলিত ও আদিবাসীরা কী ভাবে পুলিশের গুলিতে মরেন।
আসলে, ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হওয়ার জন্য আজ আর বিশেষ কিছু করতে হয় না। শুধু সহমর্মিতা থাকলেই চলে। কেননা, আমাদের সময় এখন আমাদের শেখায়, অন্যের জন্য না ভাবাটাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy