Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Ventriloquism

মাঝরাতে জেগে ওঠে তারা! কথা-বলা পুতুলেরা কিন্তু সব সময় নিরীহ নয়

আপাত নিরীহ এই মজাদার ম্যাজিকের পিছনে থমকে এক আতঙ্কের জগৎ।

চেনা পুতুলুটিই হঠাৎ হয়ে যেতে পারে ভয়ঙ্কর।

চেনা পুতুলুটিই হঠাৎ হয়ে যেতে পারে ভয়ঙ্কর। ছবি: 'ডেড সাইলেন্স'-এর পোস্টার থেকে।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:০২
Share: Save:

বড় বড় চোখ। ঈষৎ খোনা গলায় কথা বলা। ঘাড় ঘোরানোর মধ্যেও রয়েছে একটা বিচিত্র ভাব। মঞ্চে তাদের দেখে মজা পেলেও কোথাও যেন খানিক অস্বস্তি থেকে যায়। ‘কথা-বলা পুতুল’ বা ভেন্ট্রিলোকুইস্টের ‘ডামি’ নিয়ে এমন মত অনেকেরই। মনোবিদরা এই ভয় বা অস্বস্তির একটা নামও দিয়েছেন— ‘অটোম্যাটোনোফোবিয়া’।

মঞ্চে উজ্জ্বল আলোর সামনে বসে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট তাঁর কোলে ‘ডামি’-কে রেখে মজার সব প্রশ্ন করে চলেছেন আর পুতুল সেই সব প্রশ্নের চটজলদি উত্তর দিয়ে যাচ্ছে—বিংশ শতকের গোড়া থেকেই এই জাদু জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু মঞ্চের বাইরে, জাদুকরের নিজের ঘরে যদি হঠাৎ টের পান, তাঁর সেই ‘হাতের পুতুল’ আর তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই, তা হলে ব্যাপারটা আর সুখকর থাকে না। এই অস্বস্তি বা অটোম্যাটোনোফোবিয়াকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সিনেমা। সত্যজিৎ রায় লিখে গিয়েছেন ‘ভুতো’-র মতো গল্প।

পশ্চিমি বিশ্বে কথা বলা পুতুলের খেলা বিংশ শতকের গোড়া থেকেই জনপ্রিয়। পোল্যান্ডের হ্যারি লেস্টার (জ. ১৮৭৮) বা আমেরিকান এডগার বার্গেন বিংশ শতকেই কথা বলা পুতুল বা ‘ডামি’-সহ মঞ্চে ভেন্ট্রিলোকুইজম প্রদর্শন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতি পেয়েছে তাঁদের পুতুল বা ডামিরাও। আপাতদৃষ্টিতে এই মজাদার জাদুর উৎস সুদূর অতীতে। ‘ভেন্ট্রিলোকুইজম’ শব্দটির ভিতরেই ঢুকে আছে দু’টি ল্যাটিন শব্দ— ‘ভেন্টার’ (উদর) এবং ‘লোকুই’ (কথা বলা)। প্রাচীন গ্রিসে এক জাদু প্রচলিত ছিল, যার নাম ‘গ্যাস্ট্রোম্যান্সি’। মনে করা হত, পেটের ভিতরে হওয়া বিভিন্ন শব্দ ভবিষ্যতের জানান দেয়। বিশ্বাস এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, ভেন্ট্রিলোকুইস্টের পেটের ভিতর কোনও অতিলৌকিক শক্তি অবস্থান করছে এবং সে-ই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে বলে মনে করা হতে থাকে। জাদুবিদ্যার ইতিহাসকাররা জানান, গ্রিসের বিভিন্ন দেবতার মন্দিরে পুরোহিতরা ভেন্ট্রিলোকুইজমের দ্বারা জনসমক্ষে বিভ্রম তৈরি করে তাকে ‘দৈববাণী’ হিসেবে চালাতেন। আফ্রিকার জুলু, উত্তরমেরুর ইনুইট, এবং নিউজিল্যান্ডের আদি বাসিন্দা মাওরিদের মধ্যেও এই জাদু চালু ছিল।

কিন্তু পরে খ্রিস্টধর্মের উত্থানে ইওরোপের পৌত্তলিক সংস্কৃতি লোপ পায়। ‘দৈববাণী’-র প্রয়োজনও ফুরোয়। তবে ভেন্ট্রিলোকুইজম নাকি সেই সময় থেকে তার ‘ভেলকি-মার্কা’ চরিত্র পরিহার করে এক গোলমেলে ‘আর্ট’-এ পরিণত হয়। ডামি বা পুতুল আর তাকে দিয়ে কথা বলানোর এই আপাত নির্দোষ খেলার অন্তরালে জমে উঠতে থাকে কালো জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মেঘ।

ডামি-র উপর আত্মা বা অপশক্তি ভর করতে পারে বলে দাবি কালো জাদুতে বিশ্বাসীদের।

ডামি-র উপর আত্মা বা অপশক্তি ভর করতে পারে বলে দাবি কালো জাদুতে বিশ্বাসীদের। ছবি: পিক্স্যাবে।

কালো জাদুর জগতে নিষ্প্রাণ বস্তুর মধ্যে প্রাণসঞ্চারের ‘ক্রিয়া’ পৃথিবীর প্রায় সব সভ্যতাতেই রয়েছে বলে জানান সামাজিক নৃতত্ত্বের গবেষকরা। কিন্তু কথা-বলা পুতুলের আগমনের আগেই মধ্যযুগের ভেন্ট্রিলোকুইস্টরা দাবি করতেন, তাঁরা পরলোক অথবা কোনও অপশক্তির সঙ্গে সংযোগ যোগাযোগ স্থাপন করেন এর মাধ্যমে। এই বিশ্বাস থেকে যায় ভেন্ট-ডামিদের আগমনের কালেও। ১৮৮০-র দশকেই ব্রিটিশ ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ফ্রেড রাসেল তাঁর ডামি ‘কোস্টার জো’-কে নিয়ে আবির্ভূত হন লণ্ডনের প্যালেস থিয়েটারে। ১৯২০-র দশকে ভারতীয় জাদুকর যশোবন্ত কেশব পাধ্যে ব্রিটেন থেকে ডামি আনিয়ে দেখাতে শুরু করেন ভেন্ট্রিলোকুইজমের খেলা। আমেরিকান ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এডগার বার্গেন আর তাঁর ডামি চার্লি ম্যাকার্থি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সিনেমায় অবতীর্ণ হতে শুরু করে ভয়াল ভেন্ট-পুতুলরা। ১৯৪৫ সালের ব্রিটিশ অ্যান্থোলজি ছবি ‘ডেড অব নাইট’-এ একটি কাহিনি ছিল ‘হুগো’ নামে এক ভেন্ট-পুতুলের জীবন্ত হয়ে ওঠা নিয়ে। ১৯৬৪ সালের আরেকটি ব্রিটিশ ছবি ‘ডেভিল ডল’-এ প্রাচ্যের কালো জাদু প্রয়োগ করে ভেন্ট-পুতুলের জীবন্ত হয়ে ওঠা দেখা গিয়েছিল। তাতে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট তার আত্মাকে পুরে দিয়েছিল ডামির ভিতরে। তবে ১৯৭৮ সালে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো দিকপাল পরিচালক ‘ম্যাজিক’ ছবিটি তোলার পরে ভেন্ট-পুতুলের জীবন্ত হয়ে ওঠা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সেই ছবির প্রধান ভূমিকায় ছিলেন অ্যান্টনি হপকিন্স। ছবিতে হপকিন্স একজন ব্যর্থ জাদুকর, যে তার নিজের ভেন্ট-পুতুলের দ্বারা চালিত হতে শুরু করে। ছবিতে এমনই বিশ্বস্ত অভিনয় করেছিলেন হপকিন্স, যে এখনও অনেকে প্রশ্ন করেন, তিনি আসল জীবনেও ভেন্ট্রিলোকুইজম জানেন কি না।

ভৌতিক ভেন্ট-পুতুল সংক্রান্ত ছবির তালিকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম হল ‘ডেড সাইলেন্স’। ২০০৭ সালের এই ছবিতে মেরি ’শ নামের এক ভেন্ট্রিলোকুইস্ট দর্শকদের সামনেই অপদস্থ হয়এক কিশোর তার জাদুকৌশল ধরে ফেলায়। কিশোরটি ওই ঘটনার পরে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার পরিবার মেরিকেই সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে। মেরি ছেলেটির পরিবারের দ্বারা আক্রান্ত হয়। মেরির মৃত্যুর আগে ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার শরীরকে যেন একটি ভেন্ট-পুতুলে পরিণত করা হয়। এ বার শুরু হয় সেই ভূত-পুতুলের প্রতিহিংসা নেওয়ার পালা।

এডগার বার্গেন আর তাঁর ডামি চার্লি।

এডগার বার্গেন আর তাঁর ডামি চার্লি। ছবি: উইকিপিডিয়া।

ভারতীয় পরিসরে ভেন্ট্রিলোকুইজম ছড়িয়ে রয়েছে নানা ধরনের লোকবিশ্বাসে। প্রাচীন গোষ্ঠীগুলিতে পুরোহিত বা ওঝাদের করা বহু ‘অতিলৌকিক’ কারকুরির মধ্যেও যে এই জাদু ব্যবহৃত হত, তার প্রমাণ এখনও ছড়িয়ে রয়েছে পথে-ঘাটে যাঁরা জাদু দেখান, তাঁদের খেলায়। কিন্তু ভৌতিক ভেন্ট-পুতুল একান্ত ভাবেই পশ্চিমি ব্যাপার। সেই বিষয়টিকেই কলকাতা শহরের পটভূমিকায় নিয়ে এসেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর ‘ভুতো’ গল্পে। সেখানে এক বয়স্ক ভেন্ট্রিলোকুইস্টের কাছে জাদু শিখতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত যুবক নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করে ভেন্ট্রিলোকুইজমের কারিকুরি। সে তার ডামির আকৃতি দেয় সেই জাদুকরের আদলে। ফলে বেদম চটেন বয়স্ক জাদুকর। তিনি যুবকের সঙ্গে দেখা করে বলেন, তিনি এমন কিছু জাদু জানেন, যা মঞ্চে দেখা যায় না। এর পর ঘটতে থাকে অঘটন। যুবক জাদুকর অনুভব করতে থাকে, তার পুতুল ‘ভুতো’ আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। এক রাতে নিজেই কথা বলে ওঠে ভুতো। জানায়, সে সেই জাদুকর। অর্থাৎ ভেন্ট-পুতুলের ভিতরে নিজের আত্মা পুরে দিয়েছেন সেই বয়স্ক ভেন্ট্রিলোকুইস্ট।

ভেন্ট্রিলোকুইজম এবং কালো জাদুর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন পশ্চিমের অকাল্ট চর্চাকারীরা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি আহিত্যের অধ্যাপক স্টিভেন কোনর তাঁর ‘ডাম্বস্ট্রাক: আ কালচারাল হিস্ট্রি অব ভেন্ট্রিলোকুইজম’-এ বিষয়টি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। মধ্যযুগে ‘নেক্রোম্যান্সি’ বা বিদেহী আত্মা অথবা ভিন্ন লোকবাসী পিশাচ বা অপশক্তিকে আহ্বান করার জন্য কালো জাদুকরদের একটা বড় অংশ ভেন্ট্রিলোকুইজমকে ব্যবহার করতেন। আমেরিকান ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ভ্যালেন্টাইন ভক্সও বিস্তারিত গবেষণা করেছেন এ বিষয়ে। তিনি দেখিয়েছেন, ভেন্ট্রিলোকুইস্টের উপরে ভর করেই কথা বলত বিদেহী আত্মা বা অপশক্তিগুলি। বোঝাই যায়, এই সব আপাত-অলৌকিকের আড়ালে থাকত জাদুকরের কারসাজি।

কিন্তু সম্প্রতি এস রব (এই নামেই তিনি পরিচিত) নামে এক স্বঘোষিত অতিলোক বিশেষজ্ঞ একখানি আস্ত বই-ই লিখে ফেলেছেন ভেন্ট-পুতুলের উপরে ভেন্ট্রিলোকুইস্টের আত্মা ভর করানোর পদ্ধতি নিয়ে। ‘ভেন্ট্রিলোকুইস্টস বুক অব দ্য অকাল্ট: হাউ টু ক্রিয়েট অ্যান্ড ইউজ আ হন্টেড ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ডামি’ নামে সেই বইতে তিনি আলোচনা করেছেন, কী করে পুতুলটির উপরে কোনও ব্যক্তির আত্মা বা অপশক্তিকে প্রবেশ করিয়েভেন্ট্রিলোকুইজমের চেনা জাদুকে ‘অচেনা’ করে দেওয়া যায়।

কিন্তু সত্যজিতের কল্পলোকে এই ধারণা এল কোথা থেকে? ১৯৬৪-এর ‘ডেভিল ডল’ বা ১৯৭৮-এর ‘ম্যাজিক’ তিনি দেখেছিলেন অনুমান করা যায়। রিচার্ড অ্যাটেনবরোর সঙ্গেও তাঁর সখ্য ছিল। সেই সূত্রেই কি ‘ভুতো’ জীবন্ত হয়ে ওঠে সত্যজিতের কলমে?

অন্য বিষয়গুলি:

Ventriloquism Stayajit Ray Black Magic Occult
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy