সায়তি সদ্য দেখেছে ছবিটা, গত সরস্বতী পুজোর দিন। এইট্টি থ্রি। স্নাতকোত্তর অর্থনীতির ছাত্রী সায়তি ছবি দেখার পর ফেসবুকে লিখেছে ‘অ্যামেজ়িং মুভি’। ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ-জেতা ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিখুঁত চরিত্র হয়ে-ওঠার পাশাপাশি যেটা তার ভাল লেগেছে— তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কী ভাবে সেই ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে কাজে লাগিয়েছিলেন নবাবপুরের মতো ছোট্ট একটা শহরের দাঙ্গা রুখে দিতে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা নির্দেশ দিয়েছিলেন তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রককে ইংল্যান্ড থেকে খেলা দূরদর্শনে লাইভ টেলিকাস্ট করতে, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, ক্রিকেটই পারে দাঙ্গা ঘুচিয়ে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে।
নবাবপুরের দাঙ্গায় ত্রস্ত এক অতি সাধারণ মুসলমান পরিবার কী ভাবে মেতে উঠছে বিশ্বকাপে ভারতের একের পর এক ম্যাচ জেতার আনন্দে, এই ছবি আমাদের বলে সে কথা। পরিবারের বৃদ্ধ মুসলমান সদস্যটির সঙ্গে বেশ ভাবও জমে যায় দাঙ্গা নিবারণে বন্দুক-কাঁধে টহলদার সেনাবাহিনীর এক জওয়ানের। যোগসূত্র ওই একটাই: ক্রিকেট। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জেতার মুহূর্তে পরস্পরকে তাঁরা জড়িয়ে ধরছেন, এমন দৃশ্যও আছে ছবিতে।
শুধু এইটুকুই? আরও আছে। সীমান্তে পাহারারত ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যখন অতি কষ্টে রেডিয়ো জোগাড় করে ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের পারদর্শিতায়, ঠিক তখনই গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানের তরফ থেকে, ফলে জয়ের আনন্দ আর উপভোগ করা হয় না তাঁদের। ভারত ফাইনালে ওঠার পর কিন্তু সেই পাকিস্তানের মেজরেরই ফোন আসে: আপনারা নিশ্চিন্তে খেলা শুনুন, আমাদের দিক থেকে আজ আর কোনও গোলাবর্ষণ হবে না।
দেখতে দেখতে মনে হয় খেলার পাশাপাশি যেন বা খেলার ছলেই ঘটনাগুলি গাঁথছেন কবীর খান, ম্যাচের ডকুমেন্টেশনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা প্লে-ফুল মুডে ঘটনাগুলি গুঁজে দিচ্ছেন পরিচালক। কারও মনে হতেই পারে এ সব অ-বাস্তব বা ‘মেক বিলিভ’, ঘটনার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন কেউ। তবু এ-ছবি কিন্তু ঠিক সংযোগ তৈরি করে নিয়েছে সায়তির মতো সিরিয়াস তরুণ দর্শকের সঙ্গে, যে প্রজন্মের জন্মই ’৮৩ সালের অনেক পরে।
আসলে বলিউডের ধারাতেই ছবি তৈরি করলেও যে স্বপ্নপূরণ আর অসম্ভবের রূপকথা ফাঁদেন কবীর, তা এতাবৎ বলিউডি ফিল্মে ভারতীয় মুসলমান আর পাকিস্তানকে ‘ভিলেন’ বানানোর একপেশেমি বা থোড়-বড়ি-খাড়া থেকে বেরিয়ে আসার একটা পরিসর। তাঁর আগের ছবিগুলির মধ্যে এক থা টাইগার-এর নায়ক-নায়িকা ছিল যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ ও ‘আইএসআই’-এর চর, দু’জনেই পরস্পরের প্রতি প্রেমের আকর্ষণে এক সঙ্গে পালিয়ে যায় সংস্থা দু’টি ছেড়ে, বলে যায়, সে দিনই তারা ফিরবে যে দিন ভারত-পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পারস্পরিক রেষারেষি বন্ধ হবে। আর বজরঙ্গি ভাইজান-এর নায়ক যখন পাকিস্তানের ছোট্ট বোবা মেয়েটিকে তার বাবা-মা’র কাছে পৌঁছে ফেরার জন্য পালাতে থাকে, তখন পাকিস্তানি জনতা নিজেদেরই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, ভেঙে ফেলে সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আরও একটি ছবি টিউব লাইট-এর নায়ক ভারত-চিন যুদ্ধের সময় প্রত্যন্ত প্রদেশে এক চিনা পরিবারের রক্ষায় ব্রতী হয়ে ওঠে।
হয়তো বা এক অলীক ভুবনেরই বাতাবরণ তৈরি করেন কবীর খান তাঁর ছবিগুলিতে, যেখানে সাম্প্রদায়িকতায়, উৎকট জাতীয়তায়, পরধর্ম বা পরদেশ বিদ্বেষে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে না মানুষজন, যেখানে কোনও ব্যক্তি বা নাগরিক প্রকৃত আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে চায়, যেখানে স্বাভাবিকতার চিহ্নে দেশের মানুষ পরস্পরকে চেনার চেষ্টা করে।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর একটি লেখায় এক মুসলিম ছাত্রীর কোণঠাসা হওয়ার বিবরণ দিয়েছিলেন, আজরা রজ্জাককে। স্কুল-কলেজে তার চার পাশের হিন্দু বন্ধুরা ও মাস্টারমশাইরা কেবলই বুঝিয়ে দিতেন, তিনি মুসলমান, তিনি আলাদা। এ ভাবেই আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তৈরি করে দেওয়া হয়, বলেন শঙ্খ ঘোষ, “সংখ্যাগুরুর প্রাত্যহিক আচারসংলাপ এইভাবে একটু একটু করে একটা ভুল খোলসে ঢুকিয়ে দেয় সংখ্যালঘুকে, আত্মপরিচয়ের খোঁজে এই ভাবে ঠেলে দেয় তাকে দেশপরিচয়হীন এক ধর্মপরিচয়ের দিকে।” (অবিশ্বাসের বাস্তব)
এই দেশপরিচয়ের খোঁজ যেন করে গিয়েছেন কবীর খান এইট্টি থ্রি-তে। ইউরোপীয় মডেলে নয়, আমাদের স্বদেশ ও সমাজকে বুঝে নিতে হবে আমাদের মতো করেই, সামাজিক বহুবৈচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের স্বদেশের অখণ্ডতা। ছবিতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের চিনিয়ে দেন পরিচালক তাঁদের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে, কত রকমের খাদ্যাভ্যাস, কত রকমের রুচি, কত রকমের কথাবলার ধরন, ইংরেজি জানা না-জানা নিয়ে কত রকমের রসিকতা... অথচ খেলার মাঠে তাঁরা এককাট্টা, ব্যর্থতা বা সাফল্যে অখণ্ড।
একই সঙ্গে কবীর কিন্তু কখনও ভুলতে দেন না ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কথা। স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছর পরও ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে কত না অপমান অপেক্ষা করে থাকে ভারতীয় ক্রিকেটারদের জন্য, পঁচিশে জুন ফাইনাল ম্যাচের এন্ট্রিপাস দেওয়া হয় না, টিম ম্যানেজারকে বলা হয় “আগে তো উঠুক ইন্ডিয়া ফাইনালে, তখন দেখা যাবে।” ম্যাচ জেতার পরও লেখা হয়, ভাগ্যের জোরে জিতে গিয়েছে ইন্ডিয়া। যোগ্যতার কথা? অনুল্লিখিতই থেকে যায়। উত্তরে কপিল দেব কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রনায়কদের মতো মূঢ় অহমিকাকে প্রকট করে তোলেন না। বলেন, খেলার ভিতর দিয়েই এর জবাব দিতে হবে। প্রতিটি অপমানের জবাবে ধীর লয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কপিল শুধু বলেন: “উই হিয়ার টু উইন।” এক অসম্ভব সহিষ্ণু নৈতিকতায় ভারতীয় ক্রিকেটার খেলোয়াড়োচিত শক্তিকে মুড়ে রাখেন কবীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy