গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মুম্বইয়ের আলিসান ইমারতের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে মুণ্ডিতমস্তক মস্তান খুব ঠান্ডাগলায় তার বাহিনীকে বলছে, ‘‘আগে মাটিতে শুইয়ে দে। দেখিস, মাথায় মারিস না। তাড়াতাড়ি মরে যাবে। পায়েঁ তোড়! অব হাত তোড়, হাত তোড়!’’ আর লোহা ভাঁজার ডাম্বেল দিয়ে জনা তিনেক লোক ভূমিশয্যা নেওয়া যুবকের হাত-পায়ের গাঁটগুলো ভেঙে দিচ্ছে নিশ্চিন্তে, নির্বিকারে এবং নির্বিচারে। মস্তান নেতার পরনে সাদা বুশ শার্ট আর গাঢ় রঙের ট্রাউজ়ার্স। পায়ে সাদা চপ্পল। গলায় সোনার সরু চেন আর কালো কারের ধুকধুকিতে বাঁধা বাঘনখ। কপালে লম্বা সিঁদুরের টিকা। ঘন ভ্রু। মোটা কালো গোঁফ। দু’চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি।
বেধড়ক ঠ্যাঙানিতে যুবকের মুখ থেকে ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছে জমাটবাঁধা রক্ত। হইহল্লা শুনে সামান্য সচকিত ভঙ্গিতে কিছু বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী পায়ে পায়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ইস্পাত-কঠিন চোখের সেই টেকো গুন্ডা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত তুলে তাঁদের বলছে, ‘অ্যায়, চলো পিছে! চলো পিছে! কী দেখছ? কোনও কাজ নেই নাকি? চলো, নিজের নিজের কাজ করো!’’
আড়িয়াদহের ক্লাবে ধুনুরিদের লেপ-তোশক পেটানোর মতো করে মানুষ পেটানোর ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে ‘সরকার’ ছবির দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল।
রামগোপাল বর্মা ছবির শুরুতে একটা মনে রাখার মতো ‘ট্যাগলাইন’ দিয়েছিলেন— ‘হোয়েন দ্য সিস্টেম ফেল্স, আ পাওয়ার উইল রাইজ়’। সিস্টেম যখন ভেঙে পড়ে, তখন একটা শক্তি মাথা তোলে। যেমন তুলেছিল সুভাষ নাগরের ‘সমান্তরাল সরকার’।
আড়িয়াদহের জয়ন্ত সিংহের বিভিন্ন ভিডিয়ো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, তিনিও কি তেমনই এক সমান্তরাল সরকারের যন্ত্র? সমান্তরাল প্রশাসনের জমিতে জন্মানো আগাছা?
ছিপছিপে, খেলাধুলো-করা পেটানো চেহারা। চাপদাড়ি। মাথার বাঁ-পাশে সিঁথি-কাটা ছোট করে ছাঁটা চুল। বাঁ-হাত জোড়া ট্যাটু। পরনে মূলত গোলগলা টি-শার্ট আর জিন্স। চলাফেরা খুব সপ্রতিভ। কোথাও একটা স্মার্টগিরি আছে। সেটা অবশ্য এই ধরনের চরিত্রদের থাকে। কারণ, এদের পিছনে ফুঁ দিয়ে হাওয়া ভরার লোকও থাকে। তা সে আগাছার নাম জয়ন্ত, হেমন্ত, বসন্ত, অনন্ত, হসন্ত যা-ই হোক না কেন।
পাকেচক্রে এখন জয়ন্ত শাসকদলের চক্ষুশূল এবং জেলে বন্দি। সেই অবসরে তৃণমূলের কেউ বলছেন, ‘‘যে ভাবে ও লোককে পিটিয়েছে, ওকেও সে ভাবে পেটানো উচিত!’’ কেউ বলছেন, ‘‘জয়ন্ত আমার ঘনিষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু আমি ওকে ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনি না।’’ কেউ বলছেন, জয়ন্তকে ছাড়াতে বলে তাঁর কাছে হুমকি ফোন এসেছে। কেউ বলছেন, জয়ন্তের ভয়ে গত চার বছর নাকি নিজের দলীয় কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। আর রাজ্য পুলিশ বলছে, ২০১৬ সাল থেকে পাঁচ বার গ্রেফতার হয়েছেন জয়ন্ত। এক বছর আগেও একটি গুলিচালনার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিন পেয়ে (যাঁরা জামিন পান, সেটাকে তাঁরা ‘খালাস’ পাওয়া বা ‘মুক্তি’ বলেই ধরে নেন) ফিরে এসে এলাকায় আবার কর্তৃত্ব শুরু করেন। ছ’মাস আগেও দাবিমতো ‘তোলা’ না দেওয়ায় নাকি এক প্রোমোটারের বাড়িতে গভীর রাতে (না কি ভোররাতে) ইট-পাটকেল ছোড়ে তাঁরই দলের লোকজন। দক্ষিণেশ্বর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিল প্রোমোটারের পরিবার। সেই এফআইআরে জয়ন্তের নামও ছিল। কিন্তু ওই নামটুকু ছিল-ই শুধু।
জয়ন্তের প্রাসাদসম অট্টালিকা দেখে সমীহ জাগে। সিসি ক্যামেরায় মোড়া সে প্রাসাদে যাওয়ার সরু রাস্তাটি। তিন তলা বাড়ির অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গে বৈভবের নির্ভুল ছাপ। চত্বরে দামি গা়ড়ি। এই বাড়ি নাকি পুকুরের একাংশ বুজিয়ে তৈরি হয়েছে। অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই এখন শোনা যাচ্ছে, সেই বাড়িও নাকি অনুমতি মেনে তৈরি হয়নি! মনে হয়, অনুমতিবিহীন একটি বাড়ি হু-হু করে মাথা তুলে আকাশের গায়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ কেউ সেটা লক্ষ করলেন না? সে বাড়ির বহিরঙ্গই যদি এমন হয়, তা হলে অন্দরসজ্জা না জানি কেমন হবে! মনে হয়, খাটাল আর গরুর দুধের ব্যবসা করেও তা হলে এই পরিমাণ সম্পত্তি বানানো যায়! জয়ন্তের ভাই অবশ্য দাবি করেছেন, ওই বাড়ি জয়ন্তের একার অর্থে হচ্ছে না। তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারের সকলের অর্থেই হচ্ছে। জয়ন্তের বড়জোর ১০ শতাংশ অর্থে অবদান রয়েছে। তাই? হতে পারে।
কিন্তু ভাবতে অসুবিধা হয়, যে জয়ন্তের সঙ্গে এখন দূরত্ব তৈরির হিড়িক পড়ে গিয়েছে, সেই জয়ন্তকে এর আগে কেউ চিনতেন না। তাঁর সম্পর্কে জানতেন না। অথবা এলাকায় তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। যাঁকে এখন ‘আড়িয়াদহের ত্রাস’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, তিনি তো আর গত কয়েক মাসে ‘ত্রাস’ হয়ে ওঠেননি। তা হলে?
আড়িয়াদহ তালতলা স্পোর্টিং ক্লাবের ফেসবুক পেজে গেলে এখনও বিভিন্ন ‘রিল’-এ দেখা যাচ্ছে বিশাল জনসমাবেশে গায়ক-সুরকার অনুপম রায়ের জলসা। দেখা যাচ্ছে হেলমেট-বিহীন বাইক বাহিনীর রাতের পথশাসন। দেখা যাচ্ছে আতশবাজি পোড়ানোর উৎসব, গঙ্গাবক্ষে নৌকাভ্রমণ। দেখা যাচ্ছে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘাড়ে-গর্দানে প্রসেন দাস ওরফে লাল্টু। যাঁকে এই সে দিন গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চে এলাকার কেষ্টবিষ্টু পুলিশ অফিসারেরা মঞ্চে আসীন। তা-ও আবার ফুল ইউনিফর্মে! দেখা যাচ্ছে এলাকার কোনও এক পুলিশ আবাসনের মাঠে ক্লাবের জমকালো ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন চলছে। এবং সেই একাধিক ‘রিল’-এ অনিবার্য উপস্থিতি নিয়ে রয়েছেন টি-শার্ট এবং জিন্সের ট্রাউজ়ার্সের জয়ন্ত। তা হলে?
চারদিক থেকে উড়ে উড়ে যা আসছে, তাতে শুনতে পাচ্ছি জয়ন্তের বয়স ৩৭-৩৮। বিবাহিত। দুই কন্যার জনক। হাতেখড়ি সম্ভবত আগেই হয়ে থাকবে। তবে ২০১১ সালের পর থেকে কাঁচা টাকার কারবারে হাত পাকানো শুরু হয়েছিল তাঁর। অভিযোগ, নওদাপড়া এলাকায় তিনি একটি জুয়ার ঠেক চালাতেন। একই সঙ্গে ইট-বালি-চুন-সুরকির সিন্ডিকেটও চালাতেন। তার পরে জয়ন্তের কাহিনি এগিয়ে গিয়েছিল উত্থানের পথে। যে কোনও সিন্ডিকেটবাজ যে ভাবে তার পরের ধাপের দিকে এগিয়ে যায়। নিজেই প্রোমোটার হয়ে ওঠে।
সিন্ডিকেট চালানোর সময়েই নিজের বাহিনী তৈরি করেছিলেন জয়ন্ত। আড়িয়াদহ এলাকায় নিজেকে আটকে না রেখে কামারহাটির বিভিন্ন প্রান্তে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জয়ন্ত। রয়্যাল এনফিল্ড চালাতেন (এই দুরুস্ত মোটরসাইকেলটি তর্কযোগ্য ভাবে মনুষ্যসমাজে ‘হিম্যানশিপ’-এর অভিজ্ঞান বলেই পূজিত হয়ে থাকে)। ঠান্ডামাথার। খুব বেশি চেঁচামেচি করতে তাঁকে কেউ কখনও শুনেছেন বলে মনে করতে পারেন না। কিন্তু সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ফুত্তি করতে গিয়ে পানশালায় ছুটকো বচসার সময় তাঁর বাহিনী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে তাস ফেলার মতো করে ঘরে মেঝেয় ‘মেশিন’ ছড়িয়ে দিচ্ছে— এমন বীরগাথাও তাঁর কর্মভূমিতে বিরল নয়।
পুলিশি বা জেল হেফাজতে থাকার সময় জয়ন্তের আলগা চলন (গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের হাতে নিজের হাতটা আলগোছে গলিয়ে দেওয়া) এবং প্রায় নিরুত্তাপ বলন (‘নেতাদের সঙ্গে তো সকলেরই ছবি থাকে’ বা ‘ভিডিয়োয় কি আমাকে দেখা গিয়েছে? যারা করেছে, তারা শাস্তি পাবে’) দেখে অবাধে বিচরণরত অবস্থায় তাঁর ভূমিকাটা ভাবার চেষ্টা করছিলাম।
এখন যখন শাসকদলের কোনও নেতা আত্মসমালোচনার সুরে বলছেন, জয়ন্ত একটা বিকারগ্রস্ত লোক। কিন্তু ওখানে সকলেই জয়ন্তের দাদাগিরি উপভোগ করেছে, তখন মনে পড়ছিল সেই ছবির কথা, যেখানে জয়ন্তের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে কেক কেটে। তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে হাজির এলাকার বিধায়কের পুত্র। হাসিমুখে হাজির বিধায়কের পুত্রবধূ।
চুরি করেছে, এই সন্দেহবশত কাউকে ক্লাবের ঘরে পুরে আগাপাশতলা পেটানো হচ্ছে, মোবাইল চুরির অভিযোগে সন্দেহভাজন কিশোরকে ধরে এনে নগ্ন করে তার যৌনাঙ্গ টেনে ধরা হচ্ছে সাঁড়াশি দিয়ে! অযাচাইকৃত যে সব ভিডিয়ো (বন্ধ বাজারে পিস্তলের চাঁদমারি অনুশীলন) ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো দেখে গা শিউরে ওঠে। বিবশ লাগে ভাবতে যে, এই সাঁইত্রিশ-আটত্রিশের যুবকের অঙ্গুলিহেলনে সেই কাণ্ডগুলো ঘটেছে দিনের পর দিন। সে তাঁকে কোনও ভিডিয়োয় দেখা যাক বা না-যাক!
কিন্তু তার চেয়েও মুহ্যমান লাগে এটা ভাবতে যে, এলাকার আইনরক্ষকদের কাছে না-গিয়ে মানুষ অপরাধের ‘বিচার’ চাইতে যাচ্ছেন জয়ন্তের কাছে। যিনি তাঁর নিজস্ব ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে, নিজস্ব দরবারে বিচার করে, নিজের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী দিয়ে সন্দেহভাজনদের শাস্তি দিচ্ছেন। তাঁর তালিবানি শাসনে অত্যাচারিত হওয়ার দৃষ্টান্ত যেমন সত্যি, তেমনই এ-ও তো সত্য যে, বিচার পেতে বা চটজলদি সমস্যার সুরাহা প্রার্থনা করে পুলিশের চেয়ে জয়ন্তের উপরেই বেশি ভরসা করেছেন কোনও কোনও সহ-নাগরিক।
সেই কারণেই কি পাড়ায় পাড়ায় এমন জয়ন্ত (বা বসন্ত, হেমন্ত, বসন্ত, অনন্ত অথবা হসন্ত) গজিয়ে উঠছে? যেমন উঠেছিল দীর্ঘ দিনের বামশাসনে? লোকাল বা জ়োনাল কমিটির আবডালে যে নিজস্ব সিস্টেম গড়ে তুলেছিল সিপিএম, এই জমানায় ক্লাব-সংগঠনের আড়ে-আড়ে কি সেই ‘লোকাল’ ঔদ্ধত্য এবং দাদাগিরিই ফিরে আসছে? যা আসল সিস্টেমকে অস্বীকার করে? বা অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিসরে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কোথা হা-হন্ত চিরবসন্ত আমি বসন্তে মরি’। পরিসর আলাদা বটে। কিন্তু ব্যাধিটি একই রকমের বিপজ্জনক। বসন্তের মতোই জয়ন্তরাও এক ছোঁয়াচে রোগ। চারদিক দেখেশুনে মনে হচ্ছে, শেষপর্যন্ত এই ছোঁয়াচে রোগই কি আমাদের ভবিতব্য?
রামগোপাল বর্মা মনে পড়ে যাচ্ছে— হোয়েন দ্য সিস্টেম ফেল্স, আ পাওয়ার উইল রাইজ়। সিস্টেম যখন ভেঙে পড়ে, তখন একটা শক্তি মাথা তোলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy