গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যে দেখছেন চমকে উঠছেন! কেউ কেউ একটু দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেলছেন। তৃণমূলের এক নেতাও বলে ফেললেন, ‘‘এরা যদি আমার দলেরও হয়, তা-ও বলছি, এটা হতে পারে না। বীভৎস! ভয়ঙ্কর!’’
বীভৎস এবং ভয়ঙ্করই বটে। এই মুহূর্তে জেলে থাকা কামারহাটির মস্তান জয়ন্ত সিংহের চ্যালাচামুণ্ডাদের যে সব কীর্তি-ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ছে একে একে, তাতে শিউরে উঠছেন সবাই (ভাইরাল এই ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)।
একটি ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, এক কিশোরকে নগ্ন করে তার যৌনাঙ্গ সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরে টানা হচ্ছে। যিনি এটি করছেন, তিনি জয়ন্তেরই ঘনিষ্ঠ বৃত্তের এক জন। নাম লাল্টু। আর একটি ভিডিয়োতে এক জনকে জনা চারেক মিলে চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে রেখেছেন। ঘিরে ধরে লাঠিপেটা করে চলেছেন একদল। আড়িয়াদহের ক্লাবে তোলা ‘২০২১ সালের’ ওই ভিডিয়োয় কাদের দেখা যাচ্ছে? স্থানীয়েরা চিহ্নিত করছেন, এঁরা জয়ন্তের ছায়াসঙ্গী। নাম শিবম, রাজদীপ, লালু, গঙ্গা, লাল, দীপু, সুমন ইত্যাদি।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, যাঁর ছায়ায় থেকে এই সব কাণ্ড ঘটিয়ে গিয়েছেন একদল মস্তান, স্বয়ং সেই জয়ন্ত সিংহটি কে? কী ভাবে হয়ে উঠলেন কামারহাটির ‘জায়ান্ট’ (জয়ন্তকে এই নামেও ডাকতেন ঘনিষ্ঠেরা)?
জয়ন্ত এক দিনে ‘জায়ান্ট’ হননি। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জয়ন্তের বাবা অনেক বছর আগে কামারহাটিতে আসেন। থাকতে শুরু করেন আড়িয়াদহে। তাঁদের খাটাল ছিল। মূল ব্যবসা ছিল গরুর দুধের। গোড়ায় কিছু দিন দুধের ব্যবসাও করেছেন জয়ন্ত। তার পর ক্রমে পথ বদলাতে শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন ক্লাবের মাথা হয়ে ওঠেন জয়ন্ত। যে সব ক্লাব সংগঠনে নিজের বাহিনী তৈরি করেন ‘জায়ান্ট’, তার নিউক্লিয়াস ছিল আড়িয়াদহের তালতলা ক্লাব। যেখানকার ভিডিয়ো নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
অভিযোগ, তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ জয়ন্ত। মদনের বল-ভরসাতেই তাঁর ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠা। মদন অবশ্য বলেছেন, তাঁর সঙ্গে ছবি রয়েছে মানেই ঘনিষ্ঠতা ছিল তা প্রমাণিত হয় না। বরং জয়ন্তকে ‘গুন্ডা’ বলেছেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুধের ব্যবসা অনেক দিন আগেই ছানা কাটিয়ে দিয়েছেন জয়ন্ত। তার পর শুরু করেন ইট, বালি, সিমেন্ট, চুন, সুরকির সিন্ডিকেট। পুকুর বুজিয়ে বহুতল তৈরির ‘হোতা’ হয়ে উঠেছিলেন গত কয়েক বছর ধরে। জয়ন্তের এক ভাই কলকাতা ফুটবলের নামী খেলোয়াড়। তিনি ইস্টবেঙ্গল এবং মহমেডান স্পোর্টিংয়েও খেলেছেন। মদন দাবি করেছেন, তিনি যখন ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন, তখন জয়ন্তের ভাইয়ের কথায় একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ছবি উঠেছিল। এটুকুই। বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, মদন মিত্রের পুত্রবধূ মেঘনা মিত্র কামারহাটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সেই বৃত্তেও জয়ন্তের অবাধ যাতায়াত ছিল।
দমদম লোকসভার তৃণমূল নেতাদের অনেকেই ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, কামারহাটির এক কাউন্সিলরকে দমিয়ে দিতে ‘তৈরি’ করা হয়েছিল জয়ন্তকে। এক প্রবীণ তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘বাঁদরের হাতে বেত দিলে যা হয়, তা-ই হয়েছে। ও ভোট করাত, ও টাকা তুলত, ও ফ্লেক্স-ফেস্টুনে ভরিয়ে দিত এলাকা। তাই ওকে তোল্লাই দেওয়া হয়েছিল।’’ তৃণমূলের অনেকের এ-ও দাবি, গঙ্গার উল্টো পারে উত্তরপাড়াতেও প্রোমোটিংয়ে পা জমানোর চেষ্টা করছিলেন জয়ন্ত। যদিও এখনও পর্যন্ত সে ভাবে বলার মতো কোনও কাজ করে উঠতে পারেননি। তবে উত্তরপাড়া, কোতরং এলাকায় জয়ন্তের যাতায়াত বাড়ছিল বলে খবর।
জয়ন্ত অল্প সময়েই আর্থিক ভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন। অনেকের দাবি, শাসকদল এবং পুলিশের একাংশের আশীর্বাদের হাত রয়েছে জয়ন্তের মাথায়। তাতেই তিনি হয়ে ওঠেন দাপুটে। কেমন দাপট? শুধুই কি লোককে মারধর? শুধুই কি দাদাগিরি? শুধুই কি নির্মাণের কাঁচা টাকা? জানা গিয়েছে, ব্যারাকপুর থেকে ডানলপ পর্যন্ত বিটি রোডের ধারের সমস্ত পানশালায় ছিল জয়ন্তের নামে ‘রিজ়ার্ভ’ চেয়ার। লোকলস্কর নিয়ে সেখানে চলত ফুর্তির ফোয়ারা। তবে টাকাপয়সা চাইলেই শুরু হত বচসা। বেরিয়ে পড়ত নাইন এমএম, একনলা। বিভিন্ন পানশালায় একাধিক গন্ডগোলের ঘটনাতেও জয়ন্তের নাম জড়ায় বলে দাবি অনেকের।
ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক কর্তার কথায়, ‘‘জয়ন্ত ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল নয়। ওর আস্ফালন বেশি ছিল। যার মূল কারণ ছিল কাঁচা টাকা। সেই টাকাতেই বাহিনী তৈরি করে এলাকা দখলের কাজ করত। রাজনৈতিক মদত ছিল বলেই সেটা করতে পারত।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘আমাদের এক বড় কর্তার আত্মীয়ের কাছ থেকে এক বার তোলাবাজি করেছিল। ওর কোনও জ্ঞান নেই কী ভাবে কী করতে হয়।’’
জয়ন্ত-বাহিনীর কার্যকলাপে নিন্দার ঝড় বইছে সর্বত্র। সিংহ জয়ন্তকে ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে তৃণমূলও। বিজেপি-সহ বিরোধীরা চাইছে রাজনৈতিক সমালোচনায় শাসকদলকে বিদ্ধ করতে। এ সব রাজনৈতিক আকচাআকচির বাইরে নাগরিক মনে প্রশ্ন উঠছে, আরও জয়ন্তেরা ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠার আগে কি পদক্ষেপ করবে প্রশাসন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy