Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Instinct of Violence & Society

পাঁচ টাকার নিরীহ মুদ্রা এবং তার উল্টো পিঠের আখ্যান

কলকাতার তথাকথিত অভিজাত এলাকায় পাঁচ টাকা খুচরো নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে একটা মানুষকে মাথা ঠুকে ঠুকে মেরে ফেলা হল! ফুটপাথে রক্তাক্ত দেহটা পড়ে রইল! কেউ হাসপাতালেও নিয়ে গেল না।

Killing of a customer in the Wine Shop of Dhakuria in South Kolkata & few questions on Violence in Human instinct

ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে কি ঘাপটি মেরে থাকে এক অনন্ত হিংস্রতা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৩ ০৮:০০
Share: Save:

মানুষ আজকাল কিসে ভাল থাকে?

গত ডিসেম্বরের শেষাশেষি। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের পুনর্মিলন উৎসবে সকাল থেকে গিজগিজে ভিড়। সেই ভিড়ে কেউ বিশিষ্টজন, কেউ নিরাপদ ধরনের ফড়ে, কেউ রাজনীতিক, কেউ সাহিত্যিক, কেউ সাংবাদিক, কেউ সফল উদ্যোগপতি, কেউ তত সফল নয় ব্যবসায়ী, কেউ আমলা, কেউ পুলিশ, কেউ আমেরিকা বা ইংল্যান্ড প্রবাসী, কেউ শিক্ষক, কেউ অধ্যাপক, কেউ প্রাক্তন খেলোয়াড়, কেউ অভিনেতা, কেউ নাট্যব্যক্তিত্ব। কেউ আবার স্রেফ নেই-আঁকড়া ভবঘুরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিলেমিশে একাকার।

ছোটবেলাকার সমীহ-জাগানো অডিটোরিয়ামে গ্রাম্ভারি, ধ্যানগম্ভীর এবং ‘মা আমায় মানুষ করো’ টাইপের বক্তৃতা চলছে। কিছু প্রাক্তন এবং নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র পরিবার-সমেত এসে মন দিয়ে শুনছেন। আমাদের মতো কিছু শিশুপাল (যারা শিশুকালে ওই সব ভাষণ চলাকালীন বিপুলায়তন প্রেক্ষাগৃহের আরামদায়ক চেয়ারে সেঁধিয়ে গিয়ে ঝিমোত) বাইরে দাঁড়িয়ে শীতের রোদের তাত নিতে নিতে একটু ছোটবেলায় ঘুরে আসছি। হরলিক্স সুলভ চা-ভরা কাগজের কাপ হাতে হাতে ঘুরছে। হিমেল বাতাসে হিজিবিজি কথার ডুগডুগি বাজছে।

সেই সমস্ত বুদ্বুদের মধ্যেই প্রশ্নটা উঠল। প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন নরেন্দ্রপুরের এক প্রাক্তন কৃতবিদ্য ছাত্র তথা অধুনা খ্যাতনামী রাজনীতিক। কয়েক মাস আগে আনন্দবাজার অনলাইনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের পর কী ভাবে সমাজমাধ্যমে তাঁকে বাছা-বাছা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে (যাকে অপাপবিদ্ধ এবং সাধুপুরুষদের ভাষায় বলে ‘ট্রোল্‌ড’ হওয়া), সেটা বলতে গিয়ে তাঁকে ঈষৎ বিধুর দেখাচ্ছিল কি?

তখনই প্রশ্নটা উঠল— মানুষ আজকাল কিসে ভাল থাকে। অর্থে? বিত্তে? স্বাচ্ছন্দ্যে? সুখী-সুন্দর-ছমছমে ফ্ল্যাটে? বড় মোটরগাড়ির মালিক হয়ে? রাজনৈতিক ক্ষমতায়? সামাজিক প্রতিপত্তিতে? সন্তানের সাফল্যে? ঘটনাহীন দৈনন্দিনতায়? না কি এক ধরনের পিঙ্গল এবং কপিশ যাপনে?

চারদিকে সিনিয়রদের থইথই ভিড়। তার মধ্যেই যা থাকে কপালে ভেবে ঝড়াক করে বলে দিলাম, ও সব কিছু নয়। মানুষ এখন ভাল থাকে অন্যে খারাপ থাকলে! অগ্রপশ্চাৎ না-ভেবে, না-দেখে সমাজমাধ্যমে মোড়লি করার প্রবণতা দেখে তেমনই মনে হয়। দিকে দিকে অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের ছড়াছড়ি। ছদ্ম বিপ্লবের ধুম লেগেছে হৃদ্‌কমলে। মনে হয়, মুখে এঁটে-রাখা আপাত-মিনমিনে এবং মিহিদানায় মাখা মুখোশ অহরহ একটানে ছিঁড়ে ফেলে মনে মনে অন্য কেউ হয়ে যাই আমরা। সেই লোকগুলো হয়ে যাই, যারা প্রতিনিয়ত ভাবি, নিজেদের পাঁচপেঁচি জীবনের বিভিন্ন রকম হতাশা, অপ্রাপ্তি, খিটিমিটি অন্যের উপর বিষ্ঠার মতো মাখিয়ে দেব। নিজের মনে ‘ভিলেন’ খাড়া করে দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় বাণ মারি। পারলে অ্যাসিডই ছুড়তাম। কিন্তু তাতে আবার পুলিশে ধরবে! তাই পারি না। অতএব নিজের ভিতরের যাবতীয় দহন, যাবতীয় গরল পাবলিক প্ল্যাটফর্মে ঢেলে দিই অন্যকে খারাপ রাখার তাড়নায়। কেন না, আমাদের মোক্ষলাভের পারানির কড়িটি গুনে গু‌নে অন্যের খারাপ থাকার সঙ্গে সমানুপাতিক।

সাত মাস পরে মনে হচ্ছে, ভুল বলেছিলাম! আগাগোড়া ভুল বলেছিলাম। অন্যে খারাপ থাকলে আমি ভাল থাকি— এই স্তরও আমরা পেরিয়ে এসেছি। এখন আমরা তার পরের স্তরে উন্নীত হয়েছি। আগে মনে মনে ভাবতাম, অন্যকে খারাপ রাখতে হবে। নইলে আমার ভাল থাকা হবে না। মনে মনে ব্যাটাকে দু’ঘা দিয়েই ক্ষান্ত থাকতাম। এখন মনে হয়, পারলে খুন করে ফেলব!

রবিবারের ঘটনাটা দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। ছুটির দিনের ভরদুপুরে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার মতো তথাকথিত অভিজাত এলাকায় পানীয় কেনা এবং তজ্জনিত কারণে পাঁচ টাকা খুচরো থাকা না-থাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি আর বচসা থেকে একটা মানুষকে মাথা ঠুকে ঠুকে মেরে ফেলা হল! লোকটা স্রেফ মরে গেল! বাড়ির আধ কিলোমিটারের দূরত্বের ফুটপাথে তার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে রইল অত ক্ষণ! কেউ হাসপাতালেও নিয়ে গেল না।

বেশ কয়েক বার ওয়ালেট খুলে পাঁচ টাকার কয়েন বার করে দেখলাম। নিছকই নিরীহ এবং নিরামিষ সোনালি রঙের মুদ্রা, যেটা আজকাল ট্র্যাফিক সিগনালে ছেঁকে-ধরা পেশাদার ভিক্ষুকেরাও নিতে চান না, সেটি যে কারও বেঘোরে মৃত্যুর কারণ হতে পারে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এই হল তার উল্টো পিঠের আখ্যান? তার পর মনে হল, মুদ্রাটা কারণ নয়। ওটা নিছকই এক স্বেচ্ছানির্বাচিত ‘ট্রিগার’। ছুতো।

সিসিটিভি ফুটেজটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কী মারাত্মক জিঘাংসা! কালো টিশার্ট পরা একটা চেহারা কাউন্টার থেকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে একটা চেহারাকে টেনে এনে কাউন্টারের উপর তার মাথাটা ঠুকতে থাকল, ঠুকতে থাকল, ঠুকতেই থাকল! তার পাশে দাঁড়িয়ে আর একটা লোক সেটা দিব্যি দেখতে লাগল, দেখতে লাগল, দেখতেই লাগল। মাথা থ্যাঁতলানো লোকটা জ্ঞান হারানোর পরে তাকে কলার ধরে হিঁচড়ে দোকানের বাইরের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হল। সে ভাবেই লোকটা পড়ে রইল। সম্ভবত তত ক্ষণে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছিল সেই দেহ ছেড়ে।

নিহত মানুষটির পাড়ায় খবর যাওয়ার পরে তাঁরা এসে পানীয়ের দোকান ভাঙচুর করেছেন। ঢাকুরিয়া সেতু অবরোধ করেছেন কিছু ক্ষণ। অভিযুক্তকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ারও দাবি করেছিল উন্মত্ত জনতা। পেলে বোধহয় তাঁদেরও অকুস্থলেই পিটিয়ে মারা হত। পুলিশ এসে প্রাথমিক ভাবে গ্রেফতার করে সম্ভবত তাঁদের প্রাণই বাঁচিয়েছে।

যে চার জন ধরা পড়েছেন অভিযুক্ত হিসেবে, তাঁরা পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, নিহত লোকটি তাঁদের সঙ্গে আগে থেকেই ঝুটঝামেলা করছিলেন। হতে পারে। না-ও হতে পারে। সে সব আইন এবং আদালতের বিচার্য। কিন্তু সেই ছুটছাট বচসা থেকে এক জনের প্রাণটাই নিয়ে নিতে হবে? এত ‘অ্যাংরি’ তো অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রেরাও ছিল না। তাদের মধ্যেও কিছু মায়াদয়া অবশিষ্ট ছিল। বলিহারি!

কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হল, সেই ফুটেজটা দেখার পর অহর্নিশ মনে হচ্ছে, আমাদের সকলের মধ্যেই কি এক একটা হননেচ্ছু এবং হিংস্র শ্বাপদ গুঁড়ি মেরে থাকে? সামান্যতম সুযোগেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে ঘাড় মটকাবে বলে! না কি আমাদের সুযোগেরও দরকার হয় না? আমরা নিজেরাই সুযোগ তৈরি করে নিই?

মানুষ কি হিংস্র হয়ে জন্মায়? না কি পরিবেশ এবং পরিস্থিতি তাকে হিংসার চর্চা করতে বাধ্য করে? জীবনের পথে সমাজ তাকে সামাজিকতা এবং সামাজিকীকরণের অনুশীলন করিয়ে দাঁত-নখ লুকোতে শেখায়? হয়তো শেখায়। কিন্তু কিছু কিছু শিখলেও তার মধ্যে বোধকরি আদিম হিংসার বীজটা রয়ে যায়। ঝোপ বুঝে আমরা সেই বীজে কিছুটা জলবাতাস দিয়ে তাকে বাড়িয়ে চারাগাছ এবং চারাগাছ থেকে হিংসার বাবলাকাঁটার ঝোপে পরিণত করে নিই। ইদানীং সেই চর্চা কি একটু বেশি বেশিই হচ্ছে চারপাশে? নইলে গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাল্যবন্ধু কেন তার সাবালক পুত্রকে সাবধান করে বলে, ‘‘দেখিস, কারও সঙ্গে কোনও ঝামেলায় জড়াস না যেন!’’

বহু কাল আগে দেখা নানা পটেকর পরিচালিত এবং অভিনীত ‘প্রহার’ ছবির কথা মনে পড়ছিল। সমাজের অসৈরণের প্রতিবাদের ভার নিজের হাতে তুলে-নেওয়া এক ফৌজির কাহিনি। সেই কাহিনির একটি চরিত্র ছিল পিটার ডি’সুজা। প্রশিক্ষিত প্রিয় কমান্ডো পিটারের বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠি পেয়ে মুম্বই এসেছিলেন ভারতীয় ফৌজের কমান্ডো ট্রেনিং অফিসার মেজর চৌহান (নানা পটেকর)। ঘটনাচক্রে, প্রশিক্ষণ শেষের পর তাঁরই নেতৃত্বে এক জঙ্গিদমন অপারেশনে গুরুতর জখম পিটারের দু’টি পা হাঁটুর নীচ থেকে অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয়েছিল। অকালে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল মেজরের অন্যতম প্রিয় ছাত্রকে। ফিরে আসার কিছু দিন পরেই বিবাহের নিমন্ত্রণ।

মুম্বই শহরে পিটারের মহল্লায় পৌঁছে মেজর দেখেছিলেন, চারদিক থমথম করছে। সুনসান বাড়ি। নির্বাক পাড়া। বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে পিটারের খোঁজ করায় এক পড়শি আধখানা পাল্লা খুলে বুকে-কপালে ক্রুশ এঁকে নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলেছিলেন, ‘‘পিটার? ওহ্ তো মর গ্যয়া।’’ বলেই সপাটে দরজা বন্ধ করেছিলেন মুখের উপর। হতবাক মেজর ক্রমে জানতে পেরেছিলেন, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের ‘হফ্‌তা’ দেওয়ার সোচ্চার প্রতিবাদ করায় হুইলচেয়ারে বন্দি পিটারকে তিন মস্তান ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে। শরীরে পঙ্গু প্রাক্তন কমান্ডো যথাসম্ভব লড়েছিল। ভালই লড়েছিল। কমান্ডো তো। কিন্তু অর্ধেক দেহ আর হুইলচেয়ারে নড়াচড়া নিয়ে কমান্ডোই বা কত ক্ষণ পাল্লা টানবে! বেধড়ক মারধর খেয়ে হুইলচেয়ার থেকে রাস্তায় পড়ে-যাওয়া পিটারের মাথাটা পাথরের চাঙড় দিয়ে থেঁতলে দিয়ে চলে গিয়েছিল এলাকার তিন বীর।

পুলিশ এসেছিল। কিন্তু কোনও ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ পাওয়া যায়নি।

মেজর চৌহানকে সামনে পেয়ে পিটারের সন্তানহারা বৃদ্ধ বাবা সপাটে একটি চড় কষিয়েছিলেন তাঁর গালে। কারণ, গুন্ডাদের তোলা দিতে বেঁকে-বসা পুত্র পিটার তাঁকে বলেছিল, ওই মেজরই তাকে শিখিয়েছেন, আ সোলজ়ার ডাজ় নট ক্যুইট আনটিল হি ইজ় ডেড! মৃত্যুর আগে কোনও ফৌজি ময়দান ছেড়ে পালায় না। নিজের জীবন দিয়ে ফৌজি প্রশিক্ষকের সেই শিক্ষা পালন করে গিয়েছে নিশ্চিন্ত বিবাহিত জীবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ পিতার একমাত্র সন্তান। তাঁর মেজরের উপর রাগ হবে না তো কার হবে! মৃতদার, মৃতপুত্রক বৃদ্ধের সেই থাপ্পড়ের মধ্যে নিষ্ফল ক্রোধ ছিল বটে। কিন্তু তার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে ছিল অসহায়তাও।

কেন দিনের পর দিন ‘হফ্‌তা’ দাও? কেন প্রতিবাদ করো না? যুবক পুত্রের এমত উত্তেজিত প্রশ্নের জবাবে নাচার বৃদ্ধ (অভিনয় করেছিলেন হাবিব তনবীর) শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘‘কিঁউ কি হম শরিফ লোগ হ্যায়। লড়না হমারা কাম নহি।’’ অর্থাৎ, আমরা ভদ্রলোক। মারপিট করা আমাদের কাজ নয়।

পাঁচটা টাকার লেনদেন নিয়ে ফয়সালা না-হওয়ায় রবিবার দুপুরে যে লোকটি তাঁর দোকানে আগত ৪৭ বছরের যুবকের চুলের মুঠি ধরে তাঁর মাথাটা কাউন্টারে ঠুকে ঠুকে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেললেন, তিনিও তো ভদ্রলোকই। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। তাঁর মধ্যেও কি ঘাপটি মেরে ছিল এক অনন্ত হিংস্রতা? অন্য কারও উপর ক্রোধের ঢাকনিচাপা আগুন ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছিল ওই কয়েক মিনিটে?

এই যে সমাজমাধ্যমে দেখি ক্রমান্বয়ে গরল উদ্গীরণ, এই যে অপছন্দ হলেই টুইটারে বা ফেসবুকে বাবা-মা’কে নিয়ে অন্তহীন টানাটানি অথবা এই যে সামান্যতম ছুতোনাতায় কুটকুট করে কামড়ানো— ওই লোকটি কি তারই ফলিত এবং চূড়ান্ত রূপ? হয়তো তা-ই। আমরা তো এ সবেরই নিরন্তর অনুশীলন করি আজকাল। ভদ্রতা বা সহবতের ধার ধারি না। খালি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়েও উৎকট হর্ন বাজাতে থাকেন মোটরসাইকেল আরোহী। যেন নিজের চিৎকৃত অস্তিত্ব জাহির না-করলে চলছিল না। তর্কের মানদণ্ড নির্ধারিত হয় গলার জোরে। আলোচনাকে বচসায় রূপান্তরিত করি। বচসাকে বিতণ্ডায়। ধৈর্য থাকে না।

কেন এত ধৈর্যহীনতা? এত অসহিষ্ণুতা? এত ক্রোধ? অপ্রাপ্তি থেকে? অসূয়া থেকে? নিরাপত্তাহীনতা থেকে? না কি নিছক প্রবৃত্তি থেকে? স্রেফ নিজের নিষ্কণ্টক হয়ে বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি থেকেই কি অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতে চাই? অন্যকে একেবারে ‘নেই’ করে দিতে না-পারলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি? নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে, নিজের বাঁচার সঙ্গে অন্যের না-বাঁচাকে, না-বাঁচতে দেওয়াকে জুড়ে দিই? আশ্চর্য লাগে! না কি আশ্চর্য লাগার কথা নয়। এমনই তো হয়। এমনই তো দেখি চারপাশে। অবাক হব কেন এত? ভদ্র, সহবতশীল, শরিফ হওয়ার দায় কার পড়েছে? কেনই বা পড়বে? এটা ঠিকই যে, ভদ্রতায় কিছু ‘ব্যাঙের হাসি’ মার্কা কাপট্য থাকে। কেউ যদি সেই ঔপচারিকতা না-মেনে ‘আমি যেমন, আমি তেমন’ হতে চান, তাঁকে কি এই জ়ালিম সমাজের বাধা দেওয়া উচিত?

উচিত। কারণ, সহবতের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা না-থাকলেও সমাজে তার দরকার আছে। নইলে পারিপার্শ্বিকের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সমাজের বাস্তুতন্ত্র গোলমাল হয়ে যায়।

নরেন্দ্রপুরের বিবিধ বয়সের প্রাক্তন ছাত্রদের গজল্লার কথা আবার মনে পড়ে গেল— মানুষ আজকাল কিসে ভাল থাকে।

ভারতজোড়া পরিচিতির নকশালপন্থী নেতা তথা ইস্কুলের অনেক উঁচু ক্লাসের (ক্লাস ছাড়াও সমস্ত বিষয়েই অনেক উচ্চকোটির) দাদা দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে বলেছিলাম, মানুষ এখন ভাল থাকে অন্যের খারাপ থাকায়। খানিকটা লঘু এবং চপল জবাব ছিল কি? খানিক অতি সরলীকরণ? কে জানে! কিন্তু দীপঙ্করদা মেনে নিয়েছিলেন। খানিকটা স্নেহমিশ্রিত প্রশ্রয়ের সুরে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘মন্দ বলোনি।’’

এখন মনে হচ্ছে, ঠিক বলিনি। দীপঙ্করদা একমত হতেন কি না জানি না। কিন্তু আমার বলা উচিত ছিল, ইদানীং অন্যের খারাপ থাকায় আমরা ভাল থাকি তো বটেই। খুন-টুন করে ফেলতে পারলে বোধহয় তূরীয় পর্যায়ে পৌঁছই!

অন্য বিষয়গুলি:

Society Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy