পারিবারিক আইন বিপন্ন করছে মেয়েদের।
কেন্দ্রীয় সরকার ৩১ জুলাই, ২০১৯ তিন তালাক বে-আইনি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে। ১ অগস্ট সেই আইন কার্যকর হলে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি বলেছিলেন, ৯ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল, আর ১ অগস্ট ২০১৯ মুসলিম নারীরা অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন। ফলে ওই দিনটাও ঐতিহাসিক।
এই ‘ঐতিহাসিক’ ছবির বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্প্রতি একটি ইংরেজি সাময়িক পত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আইনে বিপাকে পড়ছেন মেয়েরাই। হায়দরাবাদের বেশ কিছু মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা শুধু আদালতে চক্কর কাটছেন। তিন তালাক দেওয়াতে স্বামীরা জেলে, তাতে মেয়েদের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। স্বামী তবু জেলে খাবার পাচ্ছে, মেয়েদের সন্তানদের নিয়ে অনাহারে মরতে হচ্ছে। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে তাঁরা সর্বস্বান্ত। জেলায় জেলায় এমন মামলার পাহাড়।
অমানবিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলনের ফলে তাৎক্ষণিক তিন তালাক ভারত সরকার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিধিবদ্ধ ভাবে তালাক, অর্থাৎ মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা এখনও তেমনই চলছে। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী তিন রকম তালাক প্রচলিত আছে। তালাক-ই-আহসান, তালাক-ই-হাসান, তালাক-ই-বিদ্দত। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক তিন-তালাক অর্থাৎ তালাক-ই-বিদ্দত নিষিদ্ধ হয়েছে। ফলে তালাক প্রথা বন্ধ হয়নি।
পারিবারিক আইন অনুসারে নিয়ম হল, স্ত্রীর সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে আদালত থেকে তালাকনামায় তিন মাসে তিন বার স্ত্রীর কাছে পাঠালে, এবং সে গ্রহণ করলে, তালাক হয়ে যায়। অতি সহজ পদ্ধতি। তালাক দেওয়ার জন্য আদালতে মামলাও দায়ের করতে হয় না। তালাকনামা কোর্ট থেকে মেয়ের বাড়িতে গেলেই গরিব, অল্পশিক্ষিত মানুষ ধরে নেন, মেয়ের তালাক হয়ে গিয়েছে। গ্রামের মোড়লরা জানিয়ে দেয়, আর স্বামীর ঘরে যাওয়া চলবে না। অথচ ভারতের আইন অনুসারে, অন্যান্য পারিবারিক আইন অনুসারেও, বিচ্ছেদের পদ্ধতি অনেক কঠিন ও দীর্ঘ, আদালতের কাছে বিচ্ছেদের আবেদনকারীকে তার স্ত্রীর (বা স্বামীর) বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝি ঘটে থাকলে আইনি পদ্ধতি সম্পর্করক্ষায় সহায়কও হয়। মুসলিম সমাজে আইনের শিথিলতার জন্য পরিত্যক্ত নারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আরও দুঃখের কথা, মৌখিক তিন তালাক এখনও অপ্রতিহত। মুর্শিদাবাদের সারভানু খাতুন মাত্র সাত মাসের বিবাহিত জীবন কাটানোর পরে এক দিন স্বামী তাঁকে মারধর করে মুখে তিন বার তালাক বলে। মোড়লরা তাঁর স্বামীকে ‘নিকা হালাল’ করে স্ত্রীকে গ্রহণ করতে বলে। স্বামী রাজি না হওয়াতে মোড়লরা সারভানুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, স্বামীর থেকে কিছু টাকা আদায় করে দিয়ে। মধ্যমগ্রামে মদ খেয়ে আয়েষার স্বামী তাঁকে মারধর করে মুখে তিন-তালাক বলে দেয়, আয়েষাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। হাওড়ার ডোমজুড়ের মেরিনা বিবিকে মোবাইলে তালাক দেয় স্বামী। ঘটনাগুলি ঘটেছে তিন তালাক নিষিদ্ধ হওয়ার পরে, ২০২০-২০২২ সালের মধ্যে। শরিয়তি আইনে স্বামীর ঘর থেকে নির্বিচারে উচ্ছেদ হয়ে মেয়েরা দিনরাত ঘুরে চলেছেন কোর্টে, একটু বিচারের আশায়। অনেক পুরুষ তালাক না দিয়েই দ্বিতীয় বিবাহ করছে। তাদের সন্তানেরা পিতৃহারা হচ্ছে, মায়েরা অতি কষ্টে তাদের প্রতিপালন করে চলেছেন। অনেকে দেহপসারিণী হতে বাধ্য হচ্ছেন। পারিবারিক আইনে বহুবিবাহ অনুমোদনের বিষাক্ত ফল এটা।
নানা ভাবে পারিবারিক আইন বিপন্ন করছে মেয়েদের। বাঁকুড়ার রিজিয়ার বিয়ে হয়েছিল উচ্চবিত্ত পরিবারে, হঠাৎ স্বামীর মৃত্যু হয়। শ্বশুর জীবিত, শরিয়তি আইনে বিধবা বধূর অধিকার নেই শ্বশুরের সম্পত্তিতে। দুই সন্তানকে নিয়ে রিজিয়াকে আশ্রয় হারাতে হল। এমনই নীতিহীন ধর্মীয় বিধান চলছে ভারতে, এখনও। মেয়েদের সামাজিক, আর্থিক, মানসিক নিরাপত্তা দেয় না যে আইন, তাকে কেন স্বীকার করবে রাষ্ট্র? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এক দিন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানকে তুলে ধরে বলছিলেন, “তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই স্ত্রী জাতির শরীর পাষাণ হইয়া যায়; ...দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু তোমাদের সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক।” তাঁর এই শিক্ষা আজ প্রয়োজন। আইনে হোক পরিবর্তন। বন্ধ হোক তালাক প্রথা, বহু বিবাহ। সম্পত্তিতে হোক সমান অধিকার। অন্তত বাইশটি মুসলিম-প্রধান দেশ এই পরিবর্তন করেছে পারিবারিক আইনে। ভারত তা করবে না কেন?
আমরা জানি, শরিয়তে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ, চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া, ব্যভিচারের শাস্তি বেত্রাঘাত। ভারতে মুসলিমদের অধিকাংশই কিন্তু ব্যাঙ্কের সুদও নেন, থানাতেও যান। কেবল নারীর অধিকারের প্রশ্নে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ ‘ধর্মের উপর আঘাত’ বলে শোরগোল তোলেন। মানবাধিকার রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভারতের সব নারীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা চাই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সমস্ত মেয়ের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় আইনই তো দরকার। নারীর স্বার্থরক্ষায় আইন প্রণয়ন করতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাধা কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy