—ফাইল চিত্র।
অর্থনীতি ব্যাপারটা যে কঠিন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু তার সবটাই যে নিমের পাচন তা-ও কিন্তু নয়। অন্য অনেক বিজ্ঞানের মতো অর্থনীতিতেও কিছু সহজ প্রশ্নের জায়গা রয়েছে। যা উঠে আসে দৈনন্দিন জীবন থেকেই। যেমন, “আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম বড় আর্থিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তা হলে আমার রোজকার জীবন এত কষ্টের কেন?” উল্টো দিকে অনেকেই বলবেন, “কই আমার জীবন তো এত কষ্টের নয়!” তা হলে সাধারণ ঔৎসুক্য থেকেই আমরা যে প্রশ্নের দিকে এগোতে থাকব তা হল— দেশের কত জন মানুষের দৈনন্দিন জীবন আর্থিক ভাবে আমাদের সাধারণ ব্যাখ্যাতে স্বচ্ছল?
না। কোনও কঠিন অর্থনীতির তাত্ত্বিক আলোচনায় না ঢুকেই কিন্তু উন্নয়নের অত্যন্ত বুনিয়াদি কিছু উত্তর এই দুই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। শুধু প্রয়োজন নিজের জীবনকে অন্যের সঙ্গে একটু তুলনা করে এগিয়ে যাওয়ার। যেমন আমরা যতই বলি না কেন যে, এটা ঠিক নয়, তবুও তো সেই বিয়েবাড়িতে খেয়ে এসে বলেই থাকি যে, “বাব্বা, কী করে যে পারে!” প্রশ্নটা কিন্তু দু’জায়গা থেকে আসতে পারে। হতে পারে যে, আমন্ত্রণকারীর যা আর্থিক ক্ষমতা আছে বলে আমরা মনে করছি, আপ্যায়নের বহর তার অনুপাতে কম বলে মনে হয়েছে। আবার অন্য দিকে এটাও হতে পারে যে, আপ্যায়নের বহর আপ্যায়নকারীর যে আর্থিক ক্ষমতা তা, ছাপিয়ে গিয়েছে। ঠিক একই ভাবে কিন্তু জীবনযাপনের তুলনা আমরা নিয়মিত ভাবে করেই থাকি। আর এই পরচিকীর্ষাকেই একটু এগিয়ে নিয়ে উন্নয়ন যাচিয়ে নেওয়ার ভাবনায় পরিণত করা যেতে পারে!
তবে এই তুলনার প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের কোনও সূচকের কথা ভাবতে হবে। না হলে তুলনাটা করব কী করে! এ জন্য আয়কর যাঁরা দিয়ে থাকেন আমরা তাঁদেরই বেছে নেব সেই শ্রেণি হিসাবে, যাঁদের কাছ থেকে ‘কই আমার জীবন তো এত কষ্টের নয়’ এই প্রশ্ন উঠে আসতে পারে। জানি অনেকের মনেই খচখচ করছে একটা প্রশ্ন। বছরে আট লক্ষ টাকা আয় (পারিবারিক) পর্যন্ত আর্থিক ভাবে দুর্বল শ্রেণি হিসাবে স্বীকৃত। তা হলে কি এঁদেরও এই অঙ্কে ধরা ঠিক হবে? যৌক্তিক ভাবে আপনার তা হলে আরও একটা প্রশ্ন করা উচিত উন্নয়নের প্রেক্ষিতে। আর্থিক ভাবে যাঁরা দুর্বল হিসাবে গ্রাহ্য, তাঁদের কাছ থেকে কি আয়কর নেওয়া সমীচীন? উত্তরটা আমরা জানি। কিন্তু তবুও আট লক্ষ টাকার কাছাকাছি যাঁদের আয়, তাঁদেরও কিন্তু আয়কর দিতে হয় আর্থিক ভাবে দুর্বল হিসাবে সরকারের খাতায় নাম ওঠা সত্ত্বেও। অর্থাৎ, ঠিক বা বেঠিকের প্রশ্নকে পাশে সরিয়েই কোষাগারের স্বার্থ মেটাতেই এঁদের কর দিতে হচ্ছে যা উন্নয়ন বলবিদ্যার পরিপন্থী।
ফেরা যাক বুনিয়াদি প্রশ্ন বলে ধরে নেওয়া আলোচনায়। ভারতে ১৩০ কোটি নাগরিকের মধ্যে মাত্র ১.৬ শতাংশ আয়কর দেন। এই সংখ্যার মধ্যে আছেন তাঁরাও, যাঁরা রিটার্ন দেন কিন্তু নানান ছাড়ের সুবাদে করমুক্ত থাকেন। তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এ রকম যে, ভারতের জনসংখ্যার একটা ‘হাতে গোনা’ অংশ যা আয় করেন তা করের আওতায় আসে। অর্থাৎ ভারতের জাতীয় উৎপাদন যতই বেশি হোক না কেন তা দেশের জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশেরই ব্যক্তি আয় বাড়িয়ে চলেছে।
বিশ্বের প্রথম পাঁচটি আর্থিক ভাবে শক্তিধর দেশ ভারত। তা সত্ত্বেও কেন এত কম সংখ্যক লোক আয়কর দেওয়ার উপযোগী আয় করে থাকেন? এই প্রশ্নটা মাথায় এলে তা কি খুব অযৌক্তিক হবে? তার মানে কি এই যে, কোথাও গিয়ে সকলের কাছে সমান সুযোগ নেই? যদি থাকতই তা হলে কি এত কম সংখ্যক মানুষের কপালে আয়কর দেওয়ার খাতায় নাম তোলার সৌভাগ্য হত? যাঁরা আয়কর দেন তাঁরা সৌভাগ্য শুনে রাগ করতে পারেন। কিন্তু আয়করের খাতায় নাম তোলা মানে আপনি কিন্তু দেশের ১.৬ শতাংশ ‘বড়লোকের’ সঙ্গে এক পাতে! কিন্তু তা তো হচ্ছে না!
আপনি তো উন্নয়ন বলতে কোনও কঠিন তত্ত্বের মধ্যে না ঢুকে সোজা কথায় বোঝেন জীবনযুদ্ধের চাপ কমা। হাসপাতালে গেলে সহজে চিকিৎসা, সহজ পরিবহণ ব্যবস্থা, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ, দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ, দক্ষতা অনুসারে আয়ের সুযোগ এবং বৃদ্ধ বয়সটা নিশ্চিন্তে কাটাতে। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা তো এই চাহিদার সঙ্গে মিলছে না।
সন্তানের জন্য শিক্ষার সুযোগ সব নাগরিকেরই বুনিয়াদি চাহিদা। এই চাহিদা পূরণ করতে গেলে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার সুযোগ আর সেখানে পড়ানোর খরচ বহন করার আয়। কিন্তু যাঁরা মাইনে পান দেশে গত পাঁচ বছরে তাঁদের গড় মাইনে বৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু সন্তানকে পড়ানোর খরচ বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি হারে। এর মানে তো একটাই। মূল্যবৃদ্ধির গড় হারকে ৬ শতাংশ ধরলে, সংসারের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে সন্তানের পড়ার খরচ মেটাতে গিয়ে আপনি গলদঘর্ম!
তবে এটাও ঠিক, স্কুল পার করে সন্তানের উচ্চ বা কারিগরি শিক্ষার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে আপনি ঋণ করতে পারেন। তার জন্য সরকার ঋণের নিয়ম অনেক সহজ করে দিয়েছে। আপনার আয়ে হয়তো সন্তানের শিক্ষার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, কিন্তু আপনার আশা ঋণ নিয়ে সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করলে তার হয়তো আপনার দশা হবে না। চাকরি করে সে নিজেই তার ঋণ শোধ করে আপনাদের দেখাশোনা করবে। কিন্তু সে গুড়েও এখন দেখা যাচ্ছে অনিশ্চয়তার বালি। কারণ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে!
আপনার পরচিকীর্ষার জায়গা থেকেই তাই প্রশ্ন হবে যে সব দেশকে হারিয়ে ভারত প্রথম পাঁচে উঠে এসেছে সে সব দেশেও কি সাধারণ নাগরিকের এত দুরবস্থা? শিক্ষা, যা এ দুনিয়ায় বাঁচার প্রাথমিক শর্ত, তা পেতেও এত দুর্ভাবনা করতে হয়? এর সোজা উত্তর হল, ‘না’। ডেনমার্ক জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বের ৩৮তম দেশ। কিন্তু মাথাপিছু আয়ে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। শুধু তাই নয় দেশটি আমাদের থেকে বহু যোজন এগিয়ে নাগরিক সুবিধার নিরিখেও।
উন্নয়নের দিশা খোঁজার তো এ সামান্য একটা দিক। স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বাদই দিলাম। বাদ দিলাম বার্দ্ধক্যের সমস্যার কথা। ভাবুন তো তাঁদের কথা, যাঁরা ‘দিন আনি, দিন খাই’ অবস্থায় আছেন। মিড ডে মিলের মতো প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার সংস্থানটুকুও করে উঠতে পারেন না, তাঁদের কথা!
আপনার মনে যদি এই প্রশ্ন ওঠে যে, একেই কি আর্থিক বৈষম্য বলে? দেশের আয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাকেই কি উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ বলে? তা হলে বোধহয় তা ভুল হবে না। এর পরের প্রশ্ন অবশ্যই হতে পারে, ‘‘দেশ নাকি দ্রুত তৃতীয় আর্থিক শক্তিধর দেশ হয়ে উঠতে চলেছে। তা হলে আমাদের আর্থিক পরিস্থিতির কবে সুরাহা হবে? কবে কমবে এই বৈষম্য?” এর উত্তর কিন্তু বব ডিলানের সেই গানের লাইনেই ভাল বলা আছে— ‘‘...সে জবাব ভাসছে বাতাসে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy