Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
সরকারকে কত খয়রাতি দিচ্ছেন আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা?
Freebies

অনুদানও বদলায় জীবন

২০১৫ সাল পর্যন্ত রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছিল। তখন ষোলো কোটি গ্রাহক ছিল, যার মধ্যে আয়কর দেন এমন মানুষেদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ কোটি।

দাবি: পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের রাজভবনের সামনে অবস্থান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ছবি: রণজিৎ নন্দী

দাবি: পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের রাজভবনের সামনে অবস্থান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। ছবি: রণজিৎ নন্দী

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৫
Share: Save:

অদ্ভুত দিনকাল পড়েছে, গণবিতর্কের বিষয়বস্তুও প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিচ্ছেন! নরেন্দ্র মোদী বারকয়েক ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সওয়াল করলেন, ব্যস, অমনি খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ডিজিটাল চ্যানেল, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। পণ্ডিতেরা কেউ রায় দিলেন ‘রেউড়ি’ সংস্কৃতি খুব খারাপ; কেউ বা বললেন তার উল্টো, সরকার তো অনেক কিছুই দিচ্ছে, কোনটা ‘রেউড়ি’, কোনটা নয়, কে বলবে? প্রাথমিক উত্তেজনা যখন কিছুটা কমেছে, তখন বিষয়টার আর একটু গভীরে ঢোকা যাক।

‘খয়রাতি’ বললে তিনটে ভাব প্রকাশ পায়। এক, সরকার থেকে গরিবকে, বা জনগণের একাংশকে কিছু দেওয়া হচ্ছে। দুই, যা দেওয়া হচ্ছে, তা বিনামূল্যে। আর তিন, যা দেওয়া হচ্ছে, সেটা অপ্রয়োজনীয়, না দিলে কিছু আসে যায় না, দেওয়া হচ্ছে শুধুই সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য। আরও একটা ভাব লুকিয়ে থাকে, এই মিনিমাগনা বিতরণ মানুষের অভ্যাস খারাপ করে, তারা আরও চাইতে থাকে। এর প্রত্যেকটা নিয়েই বিতর্কের অবকাশ আছে। খয়রাতির আলোচনাটি শুধু সরকারের দৃষ্টিতে না দেখে সমাজের দৃষ্টিতে দেখার দরকার।

‘রেউড়ি’ বা খয়রাতি কি কেবল গরিবদের দেয় সরকার? ২০১৫ সাল পর্যন্ত রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছিল। তখন ষোলো কোটি গ্রাহক ছিল, যার মধ্যে আয়কর দেন এমন মানুষেদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ কোটি। নিশ্চিত ভাবে এঁদের পুরো দাম দিয়ে রান্নার গ্যাস কেনার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তাঁরা এই প্রশ্ন তোলেননি, রাজনৈতিক দলও তোলেনি। এটা কি খয়রাতি নয়? তেমনই, বিদ্যুতে ভর্তুকি কেবল চাষিরা পান না, ২৫ কোটি গৃহস্থও পান। যাঁদের মধ্যে এই ১০ কোটি আয়করদাতাও পড়েন। এঁরা নিশ্চিত ভাবে বিনা ভর্তুকিতেই বিদ্যুৎ কিনতে পারেন, কিন্তু কেনেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতে ভর্তুকিকে ‘খয়রাতি’ বলা হবে না কেন? ছাত্রদের বিনামূল্যে বা অল্প মূল্যের বাস পাশ, রেলে ছাত্র কনসেশন স্বাধীনতার পর থেকেই আছে। তখন দরিদ্র পরিবারের ক’টা ছেলেমেয়ে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেত? কিন্তু তখন এগুলি খয়রাতি, এই অভিযোগ ওঠেনি। তা হলে আজকে রোজগেরে মেয়েদের বিনামূল্যে বাসের পাশ, বা মেট্রোর পাশ নিয়ে ‘খয়রাতি’-র অভিযোগ উঠছে কেন? মেয়েরা যে দূরে কাজ করতে যেতে পারে না, তার একটা কারণ নিরাপত্তা। আর একটা কারণ মেয়েদের রোজগার, যা ছেলেদের তুলনায় গড়ে ৩০ ভাগ কম। তাই মেয়েরা চেষ্টা করে কাছাকাছি কাজ নিতে। দেশের মোট রোজগেরে কর্মীর মধ্যে মেয়েরা মাত্র ২১%, শহরে তা ১৪%। কাজেই মেয়েদের ফ্রি বাস পাশ বা মেট্রো পাশ দেওয়াটা যথেষ্টই সঙ্গত।

এর পরেও কথা আছে। শুধু সরকার জনতাকে দিলে খয়রাতি ধরা হবে? আর জনতা সরকারকে দিলে? দেশের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা যাদের উপর নির্ভরশীল, সেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা, আশাকর্মী, পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার সঙ্গে যুক্ত। অথচ দেশ এঁদের পূর্ণ কর্মীর মর্যাদা দেয় না, বলে ‘স্বেচ্ছাসেবী’। অর্থাৎ তাঁদের শ্রমের কিছু ভাগ আসলে বিনা পারিশ্রমিকের শ্রম, অর্থাৎ খয়রাতি। ‘গ্রুপ ডি’ সরকারি কর্মীদের মাস মাইনের তুলনায় আশাকর্মীর মাইনে প্রায় ১৩ হাজার টাকা কম, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর মাইনে প্রায় ১১ হাজার টাকা, সহায়িকার মাইনে ১৪ হাজার টাকা কম, প্যারাটিচারেরমাইনে প্রায় ১২ হাজার টাকা কম। দেশের ৯ লক্ষ আশাকর্মী, ১৪ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, ১২ লক্ষ সহায়িকা, সাড়ে পাঁচ লক্ষ প্যারাটিচার তো বলতেই পারেন যে, তাঁরা সম্মিলিত ভাবে সরকারকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ‘খয়রাতি’ দিচ্ছেন। কাজের গুরুত্ব, দায়িত্ব এবং দক্ষতার হিসেবে বেতনের অঙ্ক ধার্য করলে খয়রাতির পরিমাণ আরও বেশি হবে।

সরকারি খয়রাতিতেই ফেরত আসা যাক। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মিক্সার, আরও কত কী! অনেকেই মনে করেন এগুলো খয়রাতি, শুধুই সস্তা জনপ্রিয়তা। কিন্তু গবেষণা তা বলে না। গ্রামের মহিলাদের জীবনে টেলিভিশনের কী প্রভাব তাই নিয়ে পাঁচটি রাজ্যে গবেষণা হয়েছিল। তাতে দেখা গেল মহিলারা বলেছেন, টেলিভিশন আসার পর গার্হস্থ হিংসা কমেছে, ছেলে সন্তানের চাহিদা কমেছে, মেয়েদের চলাফেরার স্বাধীনতা বেড়েছে, খবরাখবরের ভান্ডার বেড়েছে। অন্যান্য দেশেও এমন গবেষণা হয়েছে, যা একই কথা বলে। শহুরে মধ্যবিত্ত যাকে ‘অকারণ খরচ’ মনে করে, তার যুক্তি থাকতেও পারে।

সরকারের ভান্ডারের অবস্থা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। অনেকেরই মনে থাকবে, ২০১২ সালে খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের সময়েও শোনা গিয়েছিল একই আশঙ্কা, এত খরচ সরকার কোথা থেকে দেবে? তখন অমর্ত্য সেনকে লিখতে হয়েছিল, সেই একই বছর সোনা আমাদানির উপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরকার খুইয়েছিল একান্ন হাজার কোটি টাকা, আর খাদ্য সুরক্ষা আইনে খরচ হবে বছরে পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকা। সোনা আমদানি হয় অলঙ্কার তৈরির জন্য, যা উচ্চবিত্তের বিলাসিতার অঙ্গ। এখন যখন সরকারের ভান্ডার নিয়ে আবার কথা উঠছে তখন বলা দরকার, সরকার কর্পোরেট কর ২০১৮ সালে কমিয়ে দেওয়ায় পরবর্তী দু’বছরে সরকারের বার্ষিক ৯০ হাজার কোটি টাকা করে কম আয় হয়েছে। এটা খয়রাতি নয়?

তবে রাজ্য সরকারের ভান্ডারের অবস্থা নিয়ে আশঙ্কার কারণ আছে। সাত থেকে ন’টি রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা বেশ চিন্তাজনক। গত জুন মাসে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তার বুলেটিনে বিনামূল্যে জল, বাস পাশ, বিদ্যুৎ এবং চাষিদের ঋণ মকুবকে ‘খয়রাতি’ আখ্যা দিয়েছে, এবং জানিয়েছে যে এই সব খাতে রাজ্য সরকারগুলির খরচের হার তাদের আয়ের দশ ভাগেরও কম, ব্যতিক্রম কেবল পঞ্জাব আর অন্ধ্রপ্রদেশ। ওই বুলেটিনে এ-ও স্বীকার করা হয়েছে যে, রাজ্য সরকারের প্রধান ভর্তুকি আসলে সেচের পাম্পে আর ঘরোয়া বিদ্যুৎ গ্রাহকদের।

সমাজে কে কাকে কতটা খয়রাতি দেয়, এই প্রসঙ্গে সে কথা না বললেই নয়। দেশের সম্পদ তৈরিতে শ্রমের অবদান সবাই স্বীকার করেন, তা-ই ‘শ্রম’ যা রোজগার দেয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মহিলারা দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা বিনা পারিশ্রমিকে ঘরের কাজ করেন। তার ভিত্তিতেই সমাজ ও অর্থনীতি চলতে থাকে। এটা সবাই জানেন, শুধু দেশের হিসাবের খাতায় স্বীকৃত হয় না। মেয়েদের দৃষ্টিতে সেটাও দেশকে তাঁদের খয়রাতি। দেশ, অর্থনীতি ও সমাজকে সবচেয়ে বেশি খয়রাতি দেন মেয়েরাই, সেটা সরকারি নীতির ভাষায় প্রকাশ পায় না।

খয়রাতির ভাষা আসলে রাজা-বাদশাদের ভাষা, আধুনিক গণতন্ত্রে শাসককুল দিব্যি সেই ভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন। রাজা-বাদশারা মাঝে মাঝে গরিবগুর্বোকে দান খয়রাতি করতেন, সাময়িক কষ্ট লাঘবের জন্যে আর নিজেদের ‘দরাজ’ ভাবমূর্তি তৈরির জন্যে। আজকের শাসককুল খয়রাতি দিয়ে ‘পাবলিক ইমেজ’ তৈরি করেন, আবার অন্যেরা করলে সেই ‘জনমোহিনী নীতি’-র বিরোধিতা করেন। সমাজের দৃষ্টিতে খয়রাতিকে দেখলে দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যায়।

উন্নয়নবিদ্যা বিভাগ, আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Freebies Government Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy