পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সহমত হয়েছিলেন ১১৪টি দেশের রাষ্ট্রনেতারা, ১৯৭২ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব-পরিবেশ সম্মেলনে। অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে দেখছি যে, এই পৃথিবী শিল্প-বিপ্লবের সময়ের তুলনায় আরও ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ হয়েছে, হিমালয়ের হিমবাহগুলির উপরিভাগ বছরে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার হারে গলে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ডে প্রতি মিনিটে ১০ লক্ষ টন হিমবাহ গলে গিয়েছে, সাগরের জলস্তর বছরে ৩.৬ মিলিমিটার হারে ফুলে উঠে গ্রাস করছে উপকূলের ভূমিভাগ। জলস্তর ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে এবং বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় বারে বারে আছড়ে পড়ছে উপকূলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শতাব্দীতে উপকূলের ৩৪-৪৮ কোটি মানুষ বাস্তুভিটে হারাবেন। এখানেই শেষ নয়, প্রতি মিনিটে ২০টি ফুটবল মাঠের সমান আয়তনের বনাঞ্চল কেটে ফেলা হচ্ছে; ১৯৮০-২০০০ সালের মধ্যে ১০ কোটি হেক্টর ক্রান্তীয় অরণ্য হারিয়ে গিয়েছে। এই আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে পৃথিবীর মাত্র ১০% এলাকায় জঙ্গল টিকে থাকবে। ক্রমশ আরও উষ্ণ হয়ে ওঠায় দাবানলে জ্বলে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ও সাভানা ঘাসের এলাকা। ২০১৯-২০২০ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় ৯৭০০০ বর্গকিমি এবং আমাজ়নের ২২০০ বর্গকিমি বনাঞ্চল পুড়ে গেছে। ১৯৭০-২০১৬ সালের মধ্যে পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ, পাখি, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর সংখ্যা ৬৮% কমেছে। আশঙ্কা, আগামী কয়েক দশকে ১০ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হবে, ৫০০ প্রজাতি লুপ্ত হতে পারে আগামী দুই দশকে। বিপন্ন মৌমাছির মতো পতঙ্গরাও, যারা পরাগ মিলন দিয়ে এই বাস্তুতন্ত্রকে সচল রাখে।
যে সময়কালের মধ্যে পৃথিবী থেকে এত প্রাণ হারিয়ে গিয়েছে, ঠিক সেই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ৭৬০ কোটি হয়েছিল। ২০৫০ সালে আরও বেড়ে হবে ৯০০ কোটি। ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে ৭০ শতাংশ। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ যে ১৭টি ‘মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল’ ঘোষণা করেছিল, তার প্রথমেই বলা হয়েছিল ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীকে ক্ষুধা ও অনাহারের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গিয়েছে, তবু এখনও পৃথিবীর প্রায় ৮২ কোটি মানুষ অর্ধাহারে দিন কাটান, ১১০ কোটি মানুষ প্রয়োজনীয় পরিস্রুত জল পান না। অথচ, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১৩০ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়, যা ৩০০ কোটি মানুষের ক্ষুধা মেটাতে পারে। আমেরিকানরা প্রতি বছর ৬ কোটি টন ফল ও আনাজ ফেলে দেন। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ফেলে দেওয়া খাদ্য-বর্জ্য থেকে ৪৪০ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে মেশে।
প্লাস্টিক বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। আমরা প্রতি দিনের জীবনযাপনে নানা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করি এবং এই ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে ৫০ লক্ষ টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছিল, ২০১৫-য় যা বেড়ে হয়েছিল প্রায় ৪২ কোটি টন। সমস্যা হল, প্লাস্টিক মাটিতে মিশতে সময় লাগে অন্তত ৪০০ বছর, আর আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক-বর্জ্যের মাত্র নয় শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়। প্রতি বছর ১১৫-২৪১ লক্ষ টন প্লাস্টিক-বর্জ্য নালা-নদী-সাগরে চলে যায়। এখন সচেতন না হলে আর দুই দশক পরে বছরে ৬০ কোটি টন প্লাস্টিক-বর্জ্য ও মাইক্রো প্লাস্টিক সাগরে মিশবে।
বায়ুদূষণ এই সময়ের বৃহত্তম সমস্যা। আক্রান্ত নবজাতক থেকে প্রবীণতম নাগরিক। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ নাগরিক কমবেশি বায়ুদূষণের শিকার। এ প্রসঙ্গে ফিরে আসি ভারতের কথায়। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বলছে, রাজধানী দিল্লি-সহ দেশের ১৩২ শহরে শীতকালে বাতাস দূষিত হয়। তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি শহর— কলকাতা, হাওড়া, ব্যারাকপুর, হলদিয়া, দুর্গাপুর ও আসানসোল। বাতাসে ভাসমান ১২টি দূষক চিহ্নিত করা গেলেও, এ রাজ্যে সহনশীল মাত্রা অতিক্রম করে দুই ধরনের ধূলিকণা— পিএম ১০ ও পিএম ২.৫। শেষোক্তটি অতি সূক্ষ্ম, একটি পিঁপড়ের আকারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের সমান। ফুসফুস হয়ে রক্তে মেশে, মস্তিষ্কেও সঞ্চিত হয়। দূষিত বাতাসের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, চুলকানি, হার্ট, লিভার, স্নায়ু এবং ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেয়। বায়ুদূষণের জন্য ভারতীয়দের গড় আয়ু ১.৭০ বছর কমেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ ২০-৩০% কমানোর এক লক্ষ্য গৃহীত হয়েছে এবং দেশ জুড়ে নানা কর্মকাণ্ড শুরু হলেও সামগ্রিক সাফল্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গে কাজটি আরও কঠিন। আইআইটি দিল্লির গবেষণা বলছে, এই রাজ্যের বায়ুদূষণের ৫৩% উত্তরের বাতাসের টানে প্রতিবেশী রাজ্য ও বাংলাদেশ থেকে বয়ে আসে। তাই প্রয়োজন সমগ্র গঙ্গা অববাহিকা জুড়ে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা। প্রসঙ্গত, অতিমারির সময় ‘লকডাউন’ বায়ু গবেষণার ক্ষেত্রে এক অনন্য সুযোগ করে দিয়েছিল। ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পিএম ২.৫-এর পরিমাণ কমেছিল ৪৭%।
শুধু বাতাস নয়, এই মুহূর্তে দেশের ৩৫১টি নদীর নির্বাচিত অংশ দূষিত বলে ঘোষিত। এই দীর্ঘ তালিকায় আছে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিবেণী থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত গঙ্গা-সহ ১৭টি নদীর নাম। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা ও তার উপনদীগুলির পারে গড়ে উঠেছে ৪৩টি ছোট-বড় শহর। এই শহরগুলি থেকে প্রতি দিন প্রায় ১৪০ কোটি লিটার বর্জ্যজল বেরিয়ে আসে। এই বর্জ্য পরিশোধন করে আবার পুনর্ব্যবহারের যোগ্য করে তোলা কঠিন কাজ। সেই ঔপনিবেশিক পর্বে যে ৫৬টি নালা কেটে শহরাঞ্চলের বর্জ্যজল গঙ্গায় ফেলা হয়েছিল, সেগুলি আজও বহমান। মুর্শিদাবাদ থেকে ডায়মন্ড হারবারের মাঝে ৪৭টি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মিত হলেও সব বর্জ্যজল পরিশোধন করা যায়নি। আবার নদী ও বায়ুদূষণের সঙ্গে কঠিন বর্জ্যও যুক্ত। নদীপারের শহর থেকে প্রতি দিন ৮৫৩৬ টন কঠিন বর্জ্য জমা হয়। পরিশোধনের কাজ সব শহরেই শুরু হয়েছে। তবু নদীতে বর্জ্য ফেলার অপসংস্কৃতি আজও অব্যাহত। গত কয়েক বছর ধরে নানা ব্যবস্থার পর গঙ্গার গুণগত মানের কিছুটা উন্নতি হলেও, বহমান জলে এখনও কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা নির্ধারিত মাত্রার অনেক বেশি।
আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডে পরিবেশের অবক্ষয় গতি পায়। সেখানে তখন কোনও পরিবেশ বিধি ছিল না। ১৮৫৮ সালে দেখা গেল, শিল্পবর্জ্য ও শহরের বর্জ্য মিশে টেমস নদী বিষিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালে দেখা দিল অন্য সমস্যা। নিকৃষ্ট মানের কয়লা পোড়ানোর ফলে সালফার ডাইঅক্সাইড ও জলীয় বাষ্প মিশে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ৫ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢেকে থাকল লন্ডনের আকাশ। মৃত্যু হল ১২ হাজার মানুষের। সেই সময় থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে শিল্পায়নের সঙ্গে বাড়ল কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার। ১৯৪৬ সালে ডিডিটি’র আবিষ্কারক জন পল হেরমান মুলার নোবেল প্রাইজ় পেলেন। নিয়ন্ত্রণে এল ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য পতঙ্গবাহিত অসুখ। কিন্তু পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখে ১৯৬২ সালে রেচেল কারসন লিখলেন যুগান্তকারী গ্রন্থ সাইলেন্ট স্প্রিং। পরে ইউরোপ ও আমেরিকায় ডিডিটি নিষিদ্ধ হয়। আরও দশ বছর পর স্টকহোম সম্মেলনে পরিবেশের অবক্ষয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ ব্যক্ত করেন।
প্রতি বছর যে ৬০০০ কোটি টন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে, তার অনেকটাই নবীকরণ হয় না। ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বলেন— “গাছপালা জীবজন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে যে সম্পদ পাচ্ছে তা তারা ফিরিয়ে দিয়ে আবর্তন-গতিকে সম্পূর্ণতা দান করছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মানুষকে নিয়ে। মানুষ তার ও প্রকৃতির মাঝখানে আর-একটি জগৎ সৃষ্টি করেছে যাতে প্রকৃতির সঙ্গে তার আদান ও প্রদানের যোগ-প্রতিযোগে বিঘ্ন ঘটছে।... মাটির খাতায় যখন দীর্ঘকাল কেবল খরচের অঙ্কই দেখি আর জমার বড়ো একটা দেখতে পাই নে তখন বুঝতে পারি দেউলে হতে আর বড়ো বেশি বাকি নেই।”
এক শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। একদা সম্পদ ও বৈচিত্রে গরবিনি পৃথিবী ক্রমশ ‘দেউলে’ হয়ে যাচ্ছে।
সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy