Advertisement
E-Paper

খয়রাতির আসল দাম

মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ফের রাজ্যের মাথায় ধারের বোঝার জন্য বাম সরকারকে দোষারোপ করলেন। তাঁর দাবি, এই ক্রমবর্ধমান দেনার বোঝা বাম সরকারের ‘উপহার’।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:০৫
Share
Save

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যের মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা চাপিয়ে যাওয়ার জন্য বামেদের নিয়মিত দোষারোপ করতেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে রাজ্যের মাথায় বিপুল ঋণের বোঝা চাপিয়ে গেল— তার সুদ মেটাতে গিয়ে সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই যুক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্থিক প্যাকেজ ও ঋণের সুদ-আসল মেটানোর উপরে স্থগিতাদেশ দাবি করতেন তিনি।

রাজ্যে ক্ষমতার ‘পরিবর্তন’-এর পরে কেটে গিয়েছে প্রায় দেড় দশক। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে ফের রাজ্যের মাথায় ধারের বোঝার জন্য বাম সরকারকে দোষারোপ করলেন। তাঁর দাবি, এই ক্রমবর্ধমান দেনার বোঝা বাম সরকারের ‘উপহার’।

সন্দেহ নেই, এই দেনার আসল কারণ নানা রকম অনুদান প্রকল্প বা খয়রাতি। কোভিড-লকডাউনের পরে সুরাহা দিতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে শুরু করেছিল রাজ্য সরকার। ভোটে তার সুফল মিলতে শুরু করে। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোট তো বটেই, গত লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেস তার ফয়দা তুলেছে। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এ বারই ছিল শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। নির্বাচনকে পাখির চোখ করে এ বারও খয়রাতির পথেই থেকেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

মজার কথা হল, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলতে পারছে না। কারণ বিজেপি মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো যে সব রাজ্যে ক্ষমতায়, সেখানে বিজেপি গদিতে টিকে থাকতে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতোই একই রকম খয়রাতি প্রকল্প চালু করেছে। অথবা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে একই রকম খয়রাতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কংগ্রেস বা অন্য আঞ্চলিক দলও একই খয়রাতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে সেই সব রাজ্যেও একই ভাবে দেনার বোঝা বাড়ছে।যদি চলতি অর্থ বছরের বাজেট অনুমান দেখা যায়, তা হলে ১৮টি বড় রাজ্যের মধ্যে ১২টিতেই রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিএসডিপি-র তুলনায় দেনার বোঝার হার ছিল ২৫ শতাংশের উপরে। এই মাপকাঠিতে পঞ্জাবের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

এখন দেখা যাক, কেন এত দিন পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন করে বামেদের দোষারোপ করার প্রয়োজন পড়ল? কারণ জিএসডিপি-র তুলনায় রাজ্যের মোট দেনার পরিমাণ ২০২৪-২৫ সালে প্রায় ৩৯ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। কোভিডের ধাক্কায় সব রাজ্যেরই দেনার বোঝা বেড়েছিল। তার পরে পশ্চিমবঙ্গ জিএসডিপি-র অনুপাতে মোট দেনার হার কিছুটা কমিয়ে এনেছিল। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে ফের তা বাড়তে শুরু করেছে। ২০২২-২৩’এ এই হার ছিল ৩৭.৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪’এ তা বেড়ে ৩৮.৪ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থ বছর বা ২০২৪-২৫’এর সংশোধিত হিসেবে তা ৩৮.৯ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে এই জিএসডিপি-র তুলনায় দেনার বোঝার হার ৪০ শতাংশের ঘরে ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তা কমিয়ে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে এনেছিল। এখন আবার তা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।

এর থেকেও বেশি চিন্তার কারণ হল, এখন পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি যে হারে বাড়ছে, দেনার পরিমাণ তার থেকে বেশি হারে বাড়ছে। ২০২৩-২৪’এ মূল্যবৃদ্ধি-সহ পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি-র বৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। সে বছর দেনার বোঝা ১০.৪ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থ বছরে জিএসডিপি বৃদ্ধির হার ৯.৯ শতাংশ। এ দিকে দেনার বোঝা বৃদ্ধির হার ১১.৪ শতাংশ। সহজ কথায় এর অর্থ, বছরে আপনার বেতন বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে, কিন্তু আপনার ঋণের বোঝা বেড়েছে ১১ শতাংশ হারে। এই হারে চলতে থাকলে আপনি এক সময় ধার শোধ করার অবস্থাতেই থাকবেন না। তখন আপনাকে বাধ্য হয়ে খাইখরচ কমাতে হবে। একই ভাবে রাজ্য সরকারের দেনা মাত্রাছাড়া হয়ে গেলেও বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের খরচ কাটছাঁট করতে হবে।

কেন্দ্র বা রাজ্য, সব সরকারই বাজার থেকে ধার করে। তাতে কোনও সমস্যা নেই, যদি সেই ধারের টাকা সঠিক জায়গায় বা পরিকাঠামো তৈরিতে খরচ হয়। কারণ, পরিকাঠামো তৈরি বা সম্পদ তৈরিতে টাকা খরচ হলে অর্থনীতিতে গতি আসে। আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। যেমন মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের পরে দাবি করেছেন, মধ্যবিত্তকে আয়করে ছাড় দিলেও তিনি ধারের টাকার সিংহভাগ পরিকাঠামো তৈরিতেই ব্যয় করছেন। তার প্রমাণ হল, কেন্দ্রের রাজকোষ ঘাটতি জিডিপি-র ৪.৪ শতাংশ। পরিকাঠামোয় খরচ জিডিপি-র ৪.৩ শতাংশ।

উল্টো দিকে রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতি চলতি অর্থ বছরে জিএসডিপি-র ৪.০২ শতাংশ। কিন্তু পরিকাঠামোয় খরচ জিএসডিপি-র মাত্র ১.৬৫ শতাংশ। রাজ্য বাজেটের নথিই বলছে, চলতি অর্থ বছরে রাজ্য সরকার যে পরিমাণ টাকা ধার করছে, তার মাত্র ৪১ শতাংশের মতো অর্থ পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয় হবে। তা হলে ধারের বাকি টাকা কোথায় যাবে? লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে কন্যাশ্রীর মতো অনুদান প্রকল্পে।

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অবশ্য সঠিক পথেই হেঁটেছিল। ধারের টাকার যতখানি সম্ভব অর্থ পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয় করা হয়েছিল। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরের বছর, ২০১২-১৩’তে রাজ্যের ধার করা টাকার মাত্র ২৯ শতাংশের কাছাকাছি অর্থ পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল; ২০১৫-১৬’তে তা বেড়ে ৬৩ শতাংশ ছাপিয়ে যায়। ২০১৮-১৯’এ ধারের ৭৩ শতাংশের বেশি টাকা পরিকাঠামোয় খরচ হয়েছে। এ বছর তা ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম এক দশকে দেনার বোঝা কমিয়ে আনতেও সফল হয়েছিল। দিল্লির ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চ’ সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০২২-২৩’এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জিএসডিপি-র তুলনায় দেনার বোঝার হার ১ শতাংশ-বিন্দু কমিয়ে এনেছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কেবল মহারাষ্ট্র, গুজরাত ও ওড়িশা এই চেষ্টায় সফল হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের বাজেট নথিই বলছে, ২০২২-২৩’এর পর থেকে ফের জিএসডিপি-র তুলনায় দেনার বোঝার হার বেড়েছে। রাজকোষ ঘাটতি ৩.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। আর সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন করে তার দায় বাম সরকারের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন।

এই পরিস্থিতিতে বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল তৃণমূলের খয়রাতি রাজনীতির দিকে আঙুল তুলতে পারত। এক সময় খোদ নরেন্দ্র মোদী একে ‘রেউড়ি’ বা তিল-গুড়ের মিষ্টি বিলি বলে নিশানা করতেন। এখন নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি নিজেই খয়রাতি করে বিভিন্ন রাজ্যের কোষাগারে দেনার বোঝা বাড়িয়ে তুলছে। যার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিজেপির জোট সরকার আগে থেকেই নানা খয়রাতি শুরু করেছিল। গদিতে টিকে থাকতে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মহিলাদের নগদ অনুদানের ‘লাডকী বহীণ’-এর মতো নতুন খয়রাতি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে। এত খয়রাতির জেরে বিজেপি সরকারকে এখন মহারাষ্ট্রে সমস্ত দফতরে ৩০ শতাংশ খরচ ছাঁটাই করতে হচ্ছে। মহিলাদের জন্য ‘লাডকী বহীণ’ প্রকল্পে টাকা বিলি করতে গিয়ে বয়স্ক নাগরিকদের নিখরচায় তীর্থযাত্রা করানোর ‘মুখ্যমন্ত্রী তীর্থ দর্শন যোজনা’য় টাকা ঢালা বন্ধ করতে হয়েছে।

ভোটের আগে খয়রাতি করতে গিয়ে দেনার বোঝা বাড়তে থাকলে এমনটাই হয়। ভোটের পরে জনমুখী প্রকল্পের টাকা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকে না। বিজেপি নেতৃত্ব তা জানেন। তৃণমূল নেতৃত্বেরও এ কথা অজানা নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Schemes grant

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}