রীতা পাল গ্র্যাজুয়েট, চটকলে কাজ করতে তাঁকে পাঠিয়েছিল এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ। কথা ছিল, ট্রেনিং-এর সময়টা মাসে মাসে ভাতা (‘স্টাইপেন্ড’) পাবেন, তার পর পাকা চাকরি। স্টাইপেন্ড এক বারের জন্যও জোটেইনি, খাতায় ‘নাম-নম্বর’ও হয়নি। প্রথম চটকল ছাড়লেন পুরুষ কর্মীদের উপদ্রবে। দ্বিতীয় চটকলে এমন ‘টার্গেট’ দিতে শুরু করল যে, রীতা কাজ ছাড়তে বাধ্য হলেন। তৃতীয় চটকলে এক জন ‘বাবু’-র আচরণে রীতা চেঁচিয়েছিলেন, “জুতোপেটা করব।” চিঠি দিয়েছেন মহিলা কমিশনকে, চটকল মালিকদের সংগঠন আইজেএমএ-কে। বর্তমান কর্মস্থলের ছোটবাবুর কাছে নালিশ করতে গিয়েছিলেন এক বার। গিয়ে দেখেন, উত্ত্যক্তকারী আগেই সেখানে বসে রয়েছে। “আমাকে এক কোনায় একটা মেশিন দিয়েছে। ফাইট করে টিকে আছি।”
কলকাতার একটি সভায় রীতার (আসল নাম নয়) এক-একটা কথা যেন এক-একটা পেরেকের মতে বিঁধছিল। শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন সাত-আট জন শ্রমিক নেতাও। যদিও সভার বিষয় ছিল চটকলে মহিলাকর্মীদের নিরাপত্তা, কিন্তু প্রতিটি ইউনিয়ন থেকেই এসেছিলেন প্রবীণ পুরুষ। চটকলে মেয়েদের অবস্থানের কিছুটা ধারণা এ থেকে মিলল। আরও কিছুটা পাওয়া গেল সমীক্ষার ফল থেকে। ‘নিরাপদ কর্মস্থল: পশ্চিমবঙ্গের চটকলে কথোপকথন’ শীর্ষক ওই রিপোর্ট তৈরি করতে দু’টি সামাজিক সংগঠন হুগলি আর উত্তর ২৪ পরগনার ছ’টা চটকলের ছেচল্লিশ জন মেয়েমজুরের সঙ্গে কথা বলেছিল। রিপোর্ট বলছে, রীতা ব্যতিক্রম নন। অধিকাংশ মেয়ে তাঁরই মতো দিনমজুর, কুড়ি-পঁচিশ বছর কাজ করেও। প্রতিটি মিলেই মেয়েরা বলেছেন, যৌন হয়রানি মেনে নেওয়া বস্তুত কাজ পাওয়ার শর্ত। না হলে হয় কাজ মেলে না, না হলে এমন ‘টার্গেট’ দেওয়া হয়, যা পূরণ করা দুঃসাধ্য। ফলে বহু মেয়ে নিগ্রহ নীরবে হজম করে। চটকলে গোটা পঁচিশ ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয়। তবু মেয়েদের নিগ্রহ করে সহজে পার পাওয়া যায়।
চটকলে মেয়েদের মর্যাদা কতটা, তা বুঝিয়ে দেয় প্রচলিত ভাষাতেই— ওয়াইন্ডিং (সুতো জড়ানো), সেলাই, তাঁতকল, ফিনিশিং— যে বিভাগগুলোতে প্রধানত মেয়েরা কাজ করেন, সেগুলোকে বলা হয় ‘মাগিকল’। সমীক্ষকদের দিনমজুর মেয়েরা বলেছেন, শৌচাগারে গেলেও কথা শোনায় সুপারভাইজ়ার। ফিরতে একটু দেরি হলে ঢুকতে দেয় না। অথচ শৌচাগারের সামনে নিত্য-জটলারত, টোন-টিটকিরি বিতরণকারী পুরুষ শ্রমিকদের সরতে বলেন না কেউ। হয়রানির ঘটনা সামনে এলে নিগ্রহকারীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনারও উল্লেখ আছে সমীক্ষায়।
এই সমীক্ষা, অতীতের এমন নানা গবেষণা, এবং অজস্র মেয়ের অভিজ্ঞতা বলে, খেটে-খাওয়া মেয়েদের যৌন হয়রানিকে সমাজ-সংসার দেখে, যেন গ্যাস-অম্বল। বিরক্তিকর, তবে খুব বড় কিছু নয়। ট্রেড ইউনিয়নের এক নেতা সভায় বললেন, “আমাদের ফোকাস হল ন্যূনতম বেতন, পেনশন আর গ্র্যাচুইটি।” এগুলি জরুরি। কিন্তু কাজ করতে পারলে তবে না মজুরি, পেনশন? যৌন হয়রানির জন্য কত মেয়ে কাজ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, কুপ্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় কত মেয়ে কাজ পাচ্ছেন না, তার হিসাব হয়েছে কি? আর যে মেয়ে পেটের তাগিদে অফিসে-কারখানায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন? তাঁদের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়, যৌন হয়রানি প্রান্তিক বিষয় নয়। শ্রমিকের মর্যাদা শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রের বিষয়। জগদ্দলের একটি চটকল থেকে আগত এক শ্রমিক নেতা বললেন, “এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে এখনও অবধি মেয়েদের যতগুলো ব্যাচ এসেছে, অধিকাংশই টিকতে পারেনি।” কেন শিক্ষিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা কাজ করতে এসেও চটকল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন?
চটকল আর চা-বাগান বাংলায় শিল্পে মেয়েদের নিয়োগের সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র। চটকলে মেয়েদের কাজের ইতিহাস দীর্ঘ। চটকল আন্দোলনেও মেয়েদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়— বিশ শতকের গোড়ায় সন্তোষকুমারী দেবী ছিলেন অবিসংবাদী নেতা। ঘোড়ার গাড়ির চাবুক হাঁকিয়ে মালিক-প্রেরিত গুন্ডাদের হটিয়েছিলেন, বার করতেন শ্রমিক পত্রিকা। পঞ্চাশের দশকের গোড়াতেও প্রায় ষাট হাজার মেয়ে কাজ করতেন বাংলার চটকলে। ক্রমে মেয়েদের সংখ্যা এতই কমে আসে যে, আজ বহু চটকল দাবি করে, মেয়ে শ্রমিক নেই। কথাটা নিপাট মিথ্যে। সভাতেই জানা গেল হাওড়ার একটি চটকলের ছ’টা তাঁতকল (‘লুম’) চালাচ্ছেন কেবল মেয়েরা। তেমনই ভ্রান্ত ধারণা, চটকলে মেয়েরা রাতে কাজ করেন না। মালিক সংগঠনগুলো গত বছর সরকারের কাছে আবেদন করেছে, যেন রাতে মেয়েদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয়। প্রকৃত ছবি আলাদা। “তিনটে শিফটে কাজ করতে রাজি না হলে কাজই মেলে না মেয়েদের,” বললেন রীতা। সমাজকর্মী নব দত্ত মনে করেন, বাংলার সাতান্নটার মতো চটকলে অন্তত হাজার কুড়ি মেয়ে কাজ করছেন। কয়েকশো মেয়ে রাতের শিফটে কাজ করেন।
গত তিন-চার বছরে ফের চটকলে মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। কম মজুরির (দক্ষ মজুরেরও দিনে মজুরি চার-পাঁচশো টাকা) জন্য পুরুষরা চটকল ছাড়ছে। মেয়েদের কাজে যত্ন বেশি, ফাঁকি কম, টাকার খাঁইও কম। তাই রীতার মতো মেয়েরা আসছে চটকলে। মালিকরাও তাদের নিতে আগ্রহী। কিন্তু কাজের সংস্কৃতি রয়ে গিয়েছে সাবেক। বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম-এর অতনু চক্রবর্তী সভায় বললেন, “যৌন হয়রানি প্রতিরোধক আইন (২০১৩) পাশ হওয়ার প্রায় এক দশক পরেও চটকলগুলিতে অভিযোগ নিষ্পত্তির কমিটি তৈরি হয়েছে কি না, আমরা জানি না। আজ পর্যন্ত সরকার-মালিকপক্ষ-শ্রমিক সংগঠনের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে চটকলের মেয়ে শ্রমিকদের বিষয় আলোচিত হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। ট্রেড ইউনিয়নগুলির আত্মসমীক্ষা করা উচিত। কোভিড-পরবর্তী সময়ে মেয়েরা যে ভাবে কাজের জগৎ থেকে উৎখাত হল, তাতে আরও বেশি করে এ দিকে নজর দেওয়া চাই।”
প্রাপ্তি এইটুকুই যে, অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন তাদের দাবিসনদে যোগ করেছে আরও মেয়ে কর্মীদের দাবি: আরও মহিলার নিয়োগ, বৈষম্যের নিরসন, মেয়েদের শৌচাগার, ক্রেশ, এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধক আইনের রূপায়ণ। তবে সমীক্ষাকারী সংস্থার পক্ষে সমাজকর্মী সোমা সেনগুপ্ত বলেন, যৌন হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তির কমিটি তৈরি করাই যথেষ্ট নয়। “বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি দফতর, সংবাদসংস্থার দফতরে দেখা যাচ্ছে, কমিটি প্রায়ই কর্তৃপক্ষের হাতের পুতুল। নিজের কর্মস্থলে কমিটি আছে কি না, অনেক মেয়ে জানেন না। জানলেও ন্যায্য বিচার পাওয়ার ভরসা করেন না বলে অভিযোগ নিয়ে যান না।” একটি সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের বহু সাংবাদিক জানিয়েছেন, হয়রানির প্রতিবাদ করে কাজ ছাড়লে অন্যত্র কাজ মেলা দুষ্কর হয়, এমনই সংগঠিত নিগ্রহের ‘নেটওয়ার্ক’। সাংবাদিক ইউনিয়ন, ব্যাঙ্ক-কর্মী ইউনিয়ন, শিক্ষক ইউনিয়ন কোথায়? কী তাদের অবস্থান?
চটকলের মেয়েরা যেখানে, সেখানে বাংলার সব মেয়ে। উচ্চশিক্ষা, নাচ-গান-পিয়ানো, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বা বাপ-বরের পরিচয়, কোনও কিছু তাঁদের আড়াল করতে পারে না ছেঁদো কথা, অশ্লীল মেসেজ, অযাচিত স্পর্শ থেকে। মুখ বুজে সইলে জোটে মতলববাজ, দুশ্চরিত্র মেয়ের তকমা। না সইলে শুনতে হয়, তারা কাজে অপটু, ঝামেলাবাগীশ, বেয়াড়া। ভারতে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে, অথচ কাজে যোগদানের হার কমছে কেন, তার উত্তরের অনেকটা রয়েছে রীতার মতো মেয়েদের অভিজ্ঞতায়। মাগিকলের চৌহদ্দি কেবল চটকলে আটকে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy