অশ্লীলতা আর সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা এক, লিখেছিলেন মাইক কিংসলি, ২০০১-এ টুইন টাওয়ার ধূলিসাৎ হওয়ার পর। উদ্ধৃত করেছিলেন ১৯৬৪-র আমেরিকার উচ্চ আদালতের বিচারক পটার স্টুয়ার্টকে— চর্মচক্ষে অশ্লীলতা দেখতে পেলে তবেই তা অশ্লীল। তেমনই, যদি দেখতে পাই কেউ সন্ত্রাস সংগঠিত করছে তবেই তা সন্ত্রাস, নচেৎ নয়। যে অতিমারির ভিতর দিয়ে চলেছি, তার মূলেও কি সন্ত্রাসবাদ? একই প্রশ্ন কোভিডের উৎস নিয়েও। ট্রাম্পের সময় কেউ কেউ স্পষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, জো বাইডেন কমিটি গড়ে ভাইরাসের সূত্র খুঁজতে বলেছেন। ১৯১৮-তে স্প্যানিশ ফ্লু-র প্রথম আবির্ভাব আমেরিকায়; মুম্বই বন্দর দিয়ে তার ভারতে আগমন, পরে কলকাতা বন্দর দিয়ে শহর ও শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়া। ইতিহাসবেত্তারা সেখানে সন্ত্রাসবাদের ছায়া দেখেননি। একশো বছর পরের অতিমারির উৎপত্তি কিন্তু ঢাকা ধোঁয়াশায়।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, চিনের সাধারণ মানুষ তাঁদের সরকারকেই সমর্থন করছেন; অধিকাংশেরই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সায় নেই। এ দিকে আমেরিকান পণ্ডিতরা যতই বলুন সার্স কোভিড-২’এর জন্ম উহানের অত্যাধুনিক রসায়নাগারে, তাতে বিপত্তি আছে। যে গবেষণাগারে নেপথ্য সহযোগী আমেরিকা, ফ্রান্স ও কানাডা, চট করে তাকে ভাইরাসের আঁতুড়ঘর বলা মুশকিল। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কিন্তু দানা বেঁধেছে চিনা রাষ্ট্রশক্তির কার্যকলাপেই। চিনা প্রতিরক্ষা বিভাগের এক প্রতিবেদন নাকি বলেছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ তারা লড়বে একটি গোলাও না ছুড়ে। দেখা যাচ্ছে, চিনা সরকার এ ধরনের গবেষণাগার সেনাবাহিনীকেই ন্যস্ত করেছে, উহান রসায়নাগারের দায়িত্বে রয়েছেন এক মেজর জেনারেল। ফলে ভ্রুকুঞ্চন তো হবেই।
অতিমারির সময় সন্ত্রাসবাদের দৃশ্যমানতায় কি হেরফের হয়েছে? পরিসংখ্যান কিছুটা তেমনই বলছে। বিশেষজ্ঞ মত: যদিও নানা জায়গায় জঙ্গি রেখচিত্র নিম্নমুখী, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি বসে নেই, সদস্য বা আন্তর্জালের সাহায্যে জনমত বৃদ্ধিতে মন দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের মূল উদ্দেশ্য শুধু ক্ষতিসাধন নয়, আতঙ্ক সৃষ্টিও। বড় কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার নেপথ্যে দুরভিসন্ধি না থাকলেও দেখা গিয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদী দল তার দায় নিয়েছে। করোনাকালে এর বড় ব্যতিক্রম লেবাননের বেরুট বন্দরে গত বছর ৪ অগস্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ— ১৯০ জনের প্রাণহানি, কয়েক হাজার মানুষ আহত। যদিও কোনও রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠন (নন-স্টেট অ্যাক্টর্স) এ ঘটনার দায় নেয়নি, এ ক্ষেত্রে দায়ী বন্দর নিজে। আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মাবলিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গুদামে প্রচুর বিপজ্জনক কার্গো মজুত রাখা হয়েছিল। এহেন অপরিণামদর্শী কাজ সন্ত্রাসবাদীদের অভীষ্ট সাধনের আদর্শ পন্থা।
বেরুটের প্রসঙ্গে কলকাতা বন্দরের (নতুন নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর) কথা আসবেই। দুর্ভাগ্য, কাজের বাইরে প্রবীণতম এই বন্দরের খবর রাখেন খুব কম মানুষ। অতিমারিতেও আন্তর্জাতিক পণ্যবাহী জাহাজ আসছে বন্দরে, কাজ চলছে। আইএমও-র সামগ্রিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের একটি কার্যক্রম আছে, সব বন্দরকে তা মেনে চলতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ কলকাতা বন্দর ২০০৪-এই সফল ভাবে কলকাতা ও হলদিয়ায় এর বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এ দেশে যে কোনও ভাল কাজ শুরু হলেও, বজায় রাখা কঠিন। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যে রাজ্যের যৌথ সীমানা, সঙ্গে এক সুদীর্ঘ সমস্যাসঙ্কুল নদীপথ যা দিয়ে রোজ আন্তর্জাতিক জাহাজ-চলাচল হয়, সে রাজ্যের একমাত্র বন্দরের নিরাপত্তা মাথায় রাখা আবশ্যক।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০৮, পশ্চিম মেদিনীপুরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অল্পের জন্য ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। নানা পথে অস্ত্র ঢুকছে সেই উপদ্রুত অঞ্চলে। জঙ্গলমহলে অশান্তি তুঙ্গে। ২০১০-এর জুনে ডায়মন্ড হারবারের অদূরে ‘ইজিয়ান গ্লোরি’ নামে এক জাহাজকে নিতান্তই সন্দেহের বশে আটকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। দেখা যায়, রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষার কাজে পূর্বনির্দিষ্ট প্রায় ১৬ টন অঘোষিত পণ্য জাহাজে মজুত। কী নেই তাতে— রকেট লঞ্চার, স্মোক বম্ব, গ্রেনেড, বিমান-বিধ্বংসী কামানও। জাহাজের কোণে এক কন্টেনারে মজুত সব, গন্তব্য করাচি বন্দর। রাষ্ট্রপুঞ্জ পরে বলে, এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। এই আপাত-ভুলের খেসারত কিন্তু এ রাজ্যের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারত। বন্দরের প্রশিক্ষিত সতর্কতায় সে দিন তা রোধ করা গিয়েছিল। একই কারণে ভারতীয় কোস্ট গার্ড ও বিএসএফ, উপকূল নিরাপত্তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘কোস্টাল পুলিশ’-এর ভূমিকা আজ সমাদৃত। এই ক’বছরে প্রায় ১৪টি কোস্টাল পুলিশ স্টেশন হয়েছে। রাজ্যে এই সমন্বয়ে কোনও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না, এ অতি সুলক্ষণ।
ভুলকে দোরগোড়ায় আটকানোর মূলমন্ত্র বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়। করোনা সন্ত্রাসবাদের নমুনা হোক বা না হোক, অতিমারির ঢেউ কমলে সন্ত্রাসবাদ ফিরতেই পারে পুরনো রূপে।
প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা, কলকাতা বন্দর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy