এক চিলতে খেলার মাঠ। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ খানিকটা আগেই। মাঠের আলো-আঁধারিতে ছোট ছোট দলে বসে থাকা বেশ কিছু মানুষ, যারা অন্য সময়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কিন্তু এখন কেবল বন্ধু। জমে উঠেছে বন্ধুদের আড্ডা। উজাড় হচ্ছে মনের কথা। ওরা আজ এক সঙ্গে রাতও কাটাবে। সম্প্রতি এমনটাই ঘটল দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘি শ্রীফলতলা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা মিলিত হল দু’দিনের আবাসিক কর্মশালায়। গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যেই।
কেন তাঁদের এই উদ্যোগ? কী ধরনের কাজ করতে পারলেন তাঁরা? মাসকয়েক পিছিয়ে যাওয়া যাক। শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ ও বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী মানুষদের নিয়ে গঠিত সংগঠন শিক্ষা আলোচনা সোসাইটির বার্ষিক সভা ছিল গত মার্চে। সেখানে সদস্যরা ঠিক করেন যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্ব-ক্ষমতার ধারাবাহিক চর্চা প্রয়োজন। আর তা শুরু করতে হলে সবার আগে তাদের মনটাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পরস্পরের কাছে জেনেও নিতে হবে নানা বিষয়। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়েই যেন অকপট আলোচনা ও প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়েই একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারে। এই পরস্পর ও উভমুখী শিক্ষার কথা ভেবে কিছু কর্মশালা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাম দেওয়া হয়: শিক্ষার সন্ধানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক কর্মশালা।
আমাদের সমাজে ভাবনাটা ব্যতিক্রমী। নিরক্ষর থেকে উচ্চশিক্ষিত, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে ধনী, প্রায় সব ধরনের মানুষই সাধারণত মনে করেন, ছেলেমেয়েদের ধমকে, চমকে, তাদের চার পাশে নানান হ্যাঁ-না’এর বেড়াজাল এঁটে ‘লেখাপড়া’ শেখাতে হয়। তাঁদের মতে নিয়মিত কড়া অনুশাসন আর চোখ কান বন্ধ করিয়ে যন্ত্রের মতো শিক্ষার্থীকে ‘রোল প্লে’ করানোটাই হল শিক্ষা।এঁরাই দলে ভারী, ক্রমশ আরও ভারী হচ্ছেন। এই চলতি স্রোতের উল্টো দিকে দাঁড়িয়েই শিক্ষা আলোচনা-র উদ্যোগ। কর্মশালায় যোগ দিয়েছিল পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী, ছিলেন ৩০ জন শিক্ষিকা-শিক্ষক। ছিলেন কয়েক জন আধিকারিক, বিভিন্ন জেলার উৎসাহী শিক্ষক বন্ধুরা।
কর্মশালার জন্য নির্দিষ্ট কোনও সময়-বাঁধা সূচি ছিল না। সিলেবাস এবং পাঠ্যবই দূরে সরিয়ে রেখে হাতেকলমে করা যেতে পারে এমন সাধারণ কয়েকটা কাজের কথা শুধু ভেবে রাখা হয়েছিল। তার সুফল মিলল হাতে হাতে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় সমবেত নাচ দিয়ে। একটা বাংলা গানের তালে তালে শিক্ষার্থী-শিক্ষক’সহ উপস্থিত সবাই সেই নাচে যোগ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল পরস্পরের সম্পর্কের মাঝের বরফটুকু গলিয়ে ফেলা। কথা ছিল, গানটিতে কী কী মাছের নাম আছে, তা লিখে ফেলতে হবে। সেই অনুসারে গানের শেষে বসে গেল সবাই। সেখানেই আলোচনা করে ঠিক হল, গানের বাইরেও যে যার পছন্দের মাছের নামও লিখতে পারে।
সেই পর্ব চুকলে শুরু হল নিজের পরিচয় দেওয়া। ঠিকানা বলতে গিয়ে হঠাৎই এক জন দেওয়ালে ঝোলানো ম্যাপ দেখিয়ে বলল, “আমার বাড়ি এই জেলায়।” ব্যস, অন্যদেরও মনের বাঁধ ভাঙল। উঠে আসতে লাগল নিজের গ্রাম, পাশের গ্রাম, কাছের রেল স্টেশন, নদী, নানান প্রসঙ্গ। বিকেলে রোদ পড়ে এলে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই মাঠে এল। শুরু হল গণিতের সমস্যা তৈরির খেলা। ছোট্ট বর্ণালি তার নতুন বন্ধু তথাগত স্যরকে বলল, “তুমি মনে মনে একটা সংখ্যা ধরো।” স্যর মাথা নাড়তেই সে বলল, “এ বার ওই সংখ্যাটির সঙ্গে ৪ গুণ করে ফেল দেখি! কত হল?” স্যরের উত্তর জেনে নিয়ে সে এ বার প্রসেনজিৎ স্যরের দিকে আঙুল তুলে বলল, “তুমি নতুন সংখ্যাটা থেকে ৫ বিয়োগ করে দেখো তো কত হচ্ছে?” তাঁর উত্তর নিয়ে সে নাজির স্যরের দিকে ফিরে বলল, “বলো তো, তথাগত স্যর মনে মনে কোন সংখ্যা ধরেছিল?” এই খেলা ফুরোলে শুক্লাম্বর বলল, “চলো এ বার সবাই মিলে যোগ-ভাগের খেলা শুরু করা যাক।” একে একে পিউ, প্রিয়ব্রতরা আরও বেশ কয়েকটা সমস্যা তৈরির খেলা খেলার পরে নতুন পর্ব শুরু হল। মূকাভিনয় দেখে শব্দ খোঁজা, তার পর সেই শব্দ দিয়ে ডায়ালগ তৈরির খেলা।
দু’দিন জুড়ে শেখা আর বোঝার এমন নানা খেলায় শিশুদের চমৎকার মিশে যাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে, ছোট বলে তাচ্ছিল্যের পাত্র তারা কখনওই নয়। বাস্তবিকই তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। শিশুর মনের হদিস নিলে দেখা যাবে কী বিরাট একটা পৃথিবী তাদের বুকের মাঝে লুকিয়ে আছে। আর কাজটা মোটেও কঠিন নয়। বরং তাদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলতে চাইলেও প্রতিটি শিশু কী ভাবছে সেটা জানা জরুরি। অথচ এই বিরাট মানবজমিন আবাদ হচ্ছে কই? দিনগত আলস্যে বহুফসলি জমিগুলো কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না?
প্রথম দিন সন্ধ্যায় কর্মশালায় উপস্থিত শিক্ষকরা ঠিক করলেন প্রতিটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা দরকার। প্রাথমিক কাজ হল, ওদের মনের কথা শোনা। ওরা কেমন আছে, পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ওদের মনের উপর কেমন প্রভাব ফেলছে সেটা বোঝার চেষ্টা করা। প্রতিটি শিক্ষিকা-শিক্ষক এক জন করে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল মাঠে বসে পড়লেন। কেউ কেউ আবার সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কাছাকাছি কোথাও। কোনও বাঁধা প্রশ্নমালা নয়, গল্প করতে করতে যে দিকে অগ্রসর হওয়া দরকার সেই পথেই চলতে হবে— এটাই ছিল প্রাথমিক ভাবনা। দেখা গেল নানান তথ্য এবং সূক্ষ্ম অনুভূতির কথা জানা যাচ্ছে। কেউ বলল, বড়রা তার কথা শোনে না। অন্য এক জনের বক্তব্য, “মাস্টারমশাই যদি আর একটু বেশি ভালবাসেন তা হলে খুব ভাল হয়।” কেউ কেউ অভিভাবকদের অতিরিক্ত নজরদারির শিকার। মেয়েদের কারও কারও এই ছোট্ট বয়সেই ‘ব্যাড টাচ’-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর সেটা ঘটেছে খুব পরিচিত মহলেই। বাবা-মায়ের কলহ অনেকের মনেই আঘাত দিয়েছে। এ সব কথা ওরা বলেছে একেবারে বন্ধুর মতো। আবার অনেকেই পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে, শিক্ষকের কষ্ট কোথায়। এবং শিশুরা লেখাপড়া করতে চায় না এমন ধারণাকে অনায়াসে ভুল প্রমাণ করে ওরা সবাই রাতের খাওয়ার পরে সে দিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলল। আবার, কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে সকালবেলায় কয়েক জন শিক্ষার্থী যখন শিক্ষকের হাত ধরে রায়দিঘি হাসপাতালের ম্যাপ খুলে নিজেদের বাড়ির অবস্থান দেখিয়ে দেয়, তখন শিক্ষককে অবাক হয়ে ভাবতে হয়, এই স্বশিখন তারা এই গ্রামীণ সমাজ থেকে পাওয়া প্রজ্ঞার জোরেই রপ্ত করেছে।
আমরা শিক্ষকরা এখন প্রতি দিন নানান খবরে থাকি। খবরে নানা দাবির কথা থাকে, দাবির সপক্ষে আন্দোলন, চাকরি পাওয়া বা না-পাওয়ার প্রসঙ্গ, চলতেই থাকে। এই বিষয়গুলি নিশ্চয়ই দরকারি। কিন্তু এর পাশাপাশি শিক্ষার যেটা মূল উদ্দেশ্য, সেই শিশুদের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা বা তাদের মনের সুস্থ বিকাশ ঘটা, তার খবর আমরা ক’জন রাখতে চাইছি? এক দিন আমাদের আজিজা, আবীর, শুভম, বৈশাখীরাই তো চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?” রাজারা না হয় এই প্রশ্নের সামনে আসবেনই না, কিন্তু আমরা, বাকিরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy