এক যুবক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে স্নাতক হয়েছেন। খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কিছু সংস্থায় চাকরি হয়েছিল, কিন্তু তিনি বড় কোম্পানির ভরসায় ছিলেন। সেই কোম্পানি তাঁকে নির্বাচন করলেও বলেনি, কবে কোথায় চাকরিতে যোগ দিতে হবে। যুবকটি সেই চিঠির অনন্ত অপেক্ষায়।
আর এক তরুণ ২০১৭-য় টেট পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কৃতকার্যদের মেধাতালিকাতে নাম সত্ত্বেও তাঁর চাকরি হয়নি। তিনি শুনেছিলেন, তাঁর মতোই বহু যুবক-যুবতীরও চাকরি হয়নি। কারণ, বহু অযোগ্য প্রার্থীকে নাকি চাকরিতে নেওয়া হয়েছে, দুর্নীতি করে। নেতা-মন্ত্রীরা গ্রেফতার হলেও যোগ্যদের চাকরি হয়নি। ২০১৬ থেকে অনেকেই এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এখন ২০২২। মাঝে কোভিড, পুলিশি নিপীড়ন সব হয়েছে, হয়েছে মিছিল, অবস্থান, অবরোধ। তবুও চাকরির আশা দেখা যায়নি। মামলায় মামলায় সব একাকার হয়ে গিয়েছে। কোনটা যে চাকরির দাবিতে মামলা, কোনটা যে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে ধরার মামলা, আজকাল আর বুঝতে পারেন না এই যুবক-যুবতীরা। কখনও মনে হয়, বিচারপতির হাত ধরেই হয়তো শিক্ষক হিসেবে কোনও স্কুলে পড়াতে যেতে পারবেন, কখনও মনে হয়, কোনও বিচারব্যবস্থাই এই দুর্নীতি রুখে চাকরি দিতে পারবে না।
আইআইটির এক প্রাক্তনী বিরাট সমাজমাধ্যম সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন। হঠাৎ দু’দিনের মাথায় শুনলেন যে, তাঁর আর চাকরি নেই। তাঁর মতো আরও এগারো হাজার যুবকের চাকরি গিয়েছে সেখান থেকে। তাঁদের অনেকেই এখন ভিসা সমস্যায় ভুগছেন। চাকরি না থাকলে কোনও দেশই বেশি দিন থাকতে দেবে না। এই ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা কর্মী সঙ্কোচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত হয়তো এক দিনে হয়নি।কিন্তু এই ধরনের সংস্থাগুলোর মালিক, বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিরা কাকতালীয় ভাবে একযোগে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন! নিজের ঘরে চেয়ারে আরাম করে বসে যখন অনেকেই বলেছেন, “অ্যালেক্সা, পাখাটা কমিয়ে দাও তো”, তখন কি ভাবা গিয়েছিল, এমন দিন আসতে পারে, প্রযুক্তির এই রমরমার দিনে সেই সব সংস্থা থেকেই রাতারাতি এত কর্মী ছাঁটাই হবে!
এই ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর সংস্থায় চাকরি করার সুযোগ পেলে অনেকেই হয়তো ভাবেন, এর পর সমস্ত কিছুই খুব রঙিন হবে। ভাবতেই পারেন না যে, তাঁদের সঙ্গে কোভিডের সময়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের কোনও পার্থক্য নেই। বিশ্বপুঁজির মাথারা একযোগে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সংস্থাগুলোকে বাঁচাতে গেলে, এই কঠোর অবস্থান নিতেই হবে। অন্য এক সমাজমাধ্যম কোম্পানি থেকে দলে দলে কাজ হারানো যুবক-যুবতীরা জানিয়েছেন, কী ভাবে তাঁদের স্বপ্ন হঠাৎ চুরমার হয়ে গিয়েছে। আমরা জানতাম, আইআইটি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর সেরা মেধাদের স্বপ্ন বড় নামী সংস্থায় চাকরি। চাকরিপ্রার্থী, কর্মীরা তো বটেই, নিয়োগকর্তাদেরও অনেকেরই সেই মোহটি ভাঙছে। কর্তারা ভেবেছিলেন, কোভিডের দৌলতে দুনিয়াটা এখন ড্রয়িংরুমের বোকাবাক্স থেকে হাতের মুঠোফোনে এসে শেষ হবে। ভেবেছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মানুষের পছন্দ-অপছন্দকে তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। এখন কিন্তু ততটা ছড়ি ঘোরানো আর সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দকে এখনও চালনা করা যাচ্ছে, কিন্তু তাও বেশি দিন করা যাবে কি না সন্দেহ। এই ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর সংস্থাগুলির ভবিষ্যৎ যে নিরাপদ নয়— হয়তো মালিকেরা এটাই বুঝেছেন। তাই এই কর্মী সঙ্কোচন।
অনেকে ভাববেন, প্রযুক্তি নির্ভর সংস্থাগুলোর কর্মী সঙ্কোচনের সঙ্গে বাংলার শিক্ষক-দুর্নীতির কী সম্পর্ক? খেয়াল করুন, কোভিডকাল থেকেই শিক্ষাকে ক্রমশ অনলাইন করার প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছে। যে-হেতু শিক্ষা সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়, তাই শিক্ষক নিয়োগও সাধারণত রাজ্য সরকারগুলোই করে। রাজ্য সরকারগুলি এই সময় মোবাইল-নির্ভর নানা শিক্ষণ-অ্যাপ সংস্থাকে দেদার ছাড়পত্র দিয়েছে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের অভিভাবকেরা সন্তানদের জন্য অ্যাপ-নির্ভর শিক্ষাকে বেছে নিয়েছেন। ও দিকে সরকারি বিদ্যালয়গুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। কোভিডে অভিভাবকদের কাজ যাওয়ায় স্কুলছুট বাড়ছে। এমতাবস্থায় শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি প্রক্রিয়াটিকে আরও গুলিয়ে দিয়ে, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকেই যদি তুলে দেওয়া যায়— তা হলে কার লাভ বুঝছেন? ভবিষ্যতে কোনও স্থায়ী চাকরিই আর থাকবে না, অস্থায়ী চাকরিগুলিরও কোনও নিশ্চয়তা থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো তখন সামরিক বাহিনীতে শুধু অনিশ্চিত অগ্নিবীরদের নিযুক্ত করবে আর রাজ্য সরকারগুলি চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে চলবে। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে শিক্ষাকে নব্যপ্রযুক্তি-নির্ভর করে তোলা হবে। প্রথমে শিক্ষকদের উপর কোপ পড়বে, তার পর ছাত্ররাও শিক্ষার বৃত্ত থেকে হারিয়ে যাবে। কিছুরই নিশ্চয়তা থাকবে না।
আজ দেশের প্রথম, দ্বিতীয় সারির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে যা যা ঘটছে, কাল তা শিক্ষাক্ষেত্র এবং অন্য সব ক্ষেত্রেও হতেই পারে। এইটাই এখন বুঝে নেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy