বার্তা: 'গাজায় আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় অবশিষ্ট নেই'। নেদারল্যান্ডসের এক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ, মে ২০২৪। ছবি রয়টার্স।
কয়েক দিন আগে সমাজমাধ্যমে চোখে পড়ল একটা পোস্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে কেউ টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। সেখানে লেখা, “আজ যখন তুমি ক্লাসে যাবে, স্মরণে রেখো যে গাজ়ায় আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই।” শুধু জরুরি বার্তা বললে এই পোস্টারের সঠিক মূল্যায়ন হয় না, এই বার্তার মর্মে রয়েছে অনেক সত্য। যুদ্ধের সত্য, ইতিহাসের সত্য, সংস্কৃতির সত্য। এই বার্তার একটা স্পষ্ট নৈতিক মাত্রা রয়েছে। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক উভয়কেই তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়ার বার্তা। রাষ্ট্রের শক্তি, পেশি আস্ফালন, শক্তিশালী রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার পরিচায়ক হয়ে রয়ে যায় এই কথাগুলো। প্রত্যেককে প্রত্যেক মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া যে, একটা ঘোরতর অন্যায় এই মুহূর্তে, এই যখন তুমি ক্লাস করতে চলেছ, ঠিক তখনই সংঘটিত হয়ে চলেছে। তুমি এই ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে রইলে, তুমি ভুলো না, অন্যকে ভুলতে দিয়ো না। আর যদি তুমি এই বার্তা ভুলে যাও, এড়িয়ে যাও, তার দায় শুধুমাত্র তোমারই।
গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ এই প্রতিবাদ চলছে। আমেরিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধ। সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছেন তাঁদের শিক্ষকেরা। অনেকে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছেন। রাষ্ট্র বা তার পুলিশের তোয়াক্কা না করেই এঁরা নেমে এসেছেন রাস্তায়। এই স্বতঃস্ফূর্ত, প্রায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের একটা তাৎক্ষণিক ও ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে নিঃসন্দেহে। এটা পৃথিবীর জন্য সার্বিক ভাবেই মঙ্গলজনক।
এই সব সত্ত্বেও, এক-এক সময়, এই ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতেই কিছু বিক্ষিপ্ত মুহূর্তে, কিছু শব্দচয়ন (ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ‘রেটরিক’), কিছু সংলাপের অংশ, এক-একটা প্রতিবাদের ভাষা অথবা ধরন মনের মধ্যে খানিক শঙ্কার অবকাশ দেয়। লড়াইটা ঠিক কার বিরুদ্ধে, তা আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের ক্ষমতা আর আক্রোশের বশে গ্রহণ করা কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই লড়াই। এই প্রতিবাদ যেন কোনও ভাবেই রাষ্ট্র ও দেশ-এর তফাত ভুলে, একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় আর কিছু উপায়হীন মানুষকে বাতিল করে দেওয়ার লড়াই না হয়ে যায়। ইজ়রায়েল নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে ইহুদি নামক জাতিকে ক্রমাগত এক করে নিয়ে একটা সার্বিক ও সহজপাচ্য মিশেল তৈরি করে নেওয়ার ভুল যেন কোনও ক্রমেই না হয়ে যায়। কাল যদি কোন দুর্দৈবে ‘ইন্ডিয়া’ নামের রাষ্ট্র একটা হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষিত হয়, আম হিন্দু নাগরিককে দায়ী করা যেমন হঠকারিতা হবে, এও তেমনই।
আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিক, এই সময়কালের হিসাব কষে একটা লম্বা দাগ টানি যদি, দেখব আদতে মানুষ বিষয়ে যে সব দার্শনিক বা সমাজতাত্ত্বিক সন্দর্ভ নিয়ে চর্চা চলেছে তার মূল উপজীব্য মানুষের একাকিত্ব আর মানবমনের বিবিধ চলাচল। এই সব গবেষণার নির্যাস যদি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি তবে যে সত্যে উপনীত হব তা বুঝি এই যে, আজকের সময়ে মানুষ মূলত একা, নিঃসঙ্গ। ক্রমাগত, প্রতি দিন সে একা হয়ে পড়ছে। সমষ্টি, তা সে রাষ্ট্র হোক বা জাতি, ধর্ম হোক বা বর্ণ, বা আরও যা কিছু কল্পনা করা সম্ভব, এর ভিতরে থেকেও ক্রমাগত আধুনিক মানুষ তাঁর নিজস্ব কোটরে ঢুকে পড়ছে। ‘আমি’র সাত্তিক ধারণার মধ্যে আদতে ধর্ম, রাষ্ট্র, জাতি কিছুই নেই, আছে কেবল প্রতি দিনের ক্ষয় বা দুঃখ, যা একান্ত ব্যক্তিগত, দুঃসহ, অব্যক্ত। আমাদের বিবিধ যৌথ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ যেন শুধুমাত্র রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধতা করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের রাজনীতিকে ধিক্কার জানায়, বিশ্বব্যাপী হিংসার নিন্দা করে, ব্যক্তিকে তাঁর জাতি, ধর্ম বা বর্ণের কারণে একঘরে না করে দেয়। আমাদের মনে যেন এই প্রতীতি থাকে যে, গাজ়ায় আজ কোনও বিশ্ববিদ্যালয় অবশিষ্ট নেই ভেবে ক্ষতবিক্ষত হন তেল আভিভ বা হাইফার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা ছাত্র। তিনি লজ্জা পান, ক্রুদ্ধ হন, ক্ষোভে ফেটে পড়েন, অথচ এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করার ক্ষমতা তাঁর নেই। মনের কোথাও সূক্ষ্ম এই ধারণাকে স্থান দেওয়া প্রয়োজন— এক জন মানুষ একটা দেশ হতে পারে, কিন্তু এক জন মানুষ একটা রাষ্ট্র হতে পারে না।
প্রিমো লেভি, পরিচিত ইহুদি বুদ্ধিজীবী। নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা। এক জায়গায় বলছেন ‘কাপো’দের কথা। ক্যাম্পের সেই সব ইহুদি বন্দি, যাঁদের সাহায্যে গোটা ক্যাম্প পরিচালনা করতেন নাৎসি অফিসাররা। এই কাপোরাই অন্য বন্দিদের নিয়ে যেতেন গ্যাস চেম্বারে। তার পর দগ্ধ মৃতদেহ পরিষ্কার করে, কবর দিতেন। তার পর গ্যাস চেম্বার পরিষ্কার করে তৈরি করতেন পরের এক দল বন্দিকে নিয়ে আসার জন্য। এই সব কাজের বিনিময়ে তাঁরা হয়তো পেতেন আরও কয়েক দিন বেঁচে থাকার প্রাণভিক্ষা। এই অপারগ পারঙ্গমতা বিষয়ে লিখতে গিয়ে লেভি এক কাপোর বয়ান তুলে ধরছেন তাঁর পাঠকের কাছে, “ইউ মাস্ট নট থিঙ্ক দ্যাট উই আর মনস্টারস; উই আর দ্য সেম অ্যাজ় ইউ, অনলি মাচ মোর আনহ্যাপি।” মিকলোস নিসলি বলে আর এক এই রকম বন্দির কথা বলছেন লেভি। বলছেন, কী ভাবে নিসলি ক্যাম্পের ভিতরে একটা ফুটবল ম্যাচের বর্ণনা করছেন। দিনের কাজ শেষ। সারা দিন গ্যাস চেম্বারে অগণিত ইহুদি নিধনের পর বিকেলের পড়ন্ত সূর্যালোকে নাৎসি অফিসাররা আর কাপোরা জড়ো হয়েছেন ফুটবল খেলার জন্য। টিম হয়েছে দুটো। মিলিয়ে মিশিয়ে। তার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উঠতি বয়সের ছেলেরা যেমন দু’দলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলে, তেমনই চলে এঁদের ফুটবল খেলা। যেন বলার মতো কিছুই হয়নি সারা দিনে। যেন পৃথিবীর আর যে কোনও প্রান্তের মতোই পোল্যান্ডের একটা ছোট শহরে সবাই ফুটবল খেলছে। যেন সব কিছু যেমন থাকার তেমনই রয়েছে।
এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে খ্যাতনামা ইটালীয় দার্শনিক আগামবেন আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন একটা জরুরি কথা, “দিস ম্যাচ মাইট স্ট্রাইক সামওয়ান অ্যাজ় আ ব্রিফ পজ় অব হিউম্যানিটি ইন দ্য মিডল অব ইনফাইনাইট হরর... ইফ উই ডু নট সাকসিড ইন আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্যাট ম্যাচ দেয়ার উইল নেভার বি হোপ।” এই কথাগুলো স্মরণ করা আজ আমাদের সকলের প্রয়োজন। জটিল কথা সন্দেহ নেই। এই ফুটবল খেলা বাইরে থেকে দেখলে চলবে না। সম্পূর্ণ ‘এমপ্যাথি’ বা সমমর্মিতা দিয়ে বুঝতে হবে এই ফুটবল ম্যাচ। যে খেলছে, সে খেলছে বলেই বেঁচে রয়েছে তার মনের ভিতরে। এই খেলা থামিয়ে দিলে মনুষ্যত্বের আশা ক্রমাগত ক্ষীণ হতে থাকবে। একই ভাবে, আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে ইজ়রায়েলে আজ যে মানুষটা তাঁর সন্তানকে নিয়ে অথবা যে মাস্টার তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ফুটবল খেলছেন তিনি বা তাঁরা কোনও ভাবেই অপর পক্ষ নয়। ওই শুরুতে উল্লেখ করা পোস্টারের বার্তা তাঁদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছে নিশ্চিত। গাজ়াতে আবার বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এই আশায় তাঁরা আজ ফুটবল খেলছেন।
এই যে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিবিশেষের তফাত করতে চাইছি ক্রমাগত, রাষ্ট্রের হিংসা ও লোভের গহ্বর থেকে উদ্ধার করতে চাইছি ব্যক্তি একককে, এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। মুরিদ বারগুতি, প্যালেস্টাইনের বিখ্যাত কবি। ১৯৯৬ সালে ঠিক ত্রিশ বছর নির্বাসনের পর তাঁর নিজের দেশে ফিরছেন। অনুমতিপত্র, আরও নানাবিধ কাগজ সংগ্রহ করে শেষে এসে দাঁড়িয়েছেন রামাল্লা শহরে অ্যালেনবি ব্রিজের সামনে। নিজের জন্ম, বেড়ে ওঠার শহরে দীর্ঘকাল পরে পা রাখবেন, স্মৃতিরা ভিড় করে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে এক ইজ়রায়েলি সৈনিক, তাঁর কাগজপত্র মিলিয়ে দেখছেন। আর বারগুতি তাঁর দার্শনিকের দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন ছেলেটিকে। মাথায় ইয়ামুল্কা (ইহুদিদের বিশেষ ধরনের টুপি), হাতের বন্দুক প্রায় তার থেকে লম্বা। মুখ দেখে তার মনের ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করেন কবি। ও কি উদাসীন না তটস্থ? রোজ তো ছেলেটি কতশত প্যালেস্টাইনিকে যাতায়াত করতে দেখে। ও কি বুঝতে পারছে এই লোকটি আলাদা? কবি, নির্বাসিত ছিলেন, আজ ফিরছেন দীর্ঘকাল পরে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন মুরিদ এর পর। তিনি কি আলাদা হতে চান? “ডাজ় আ ম্যান ওয়ান্ট টু বি ডিফারেন্ট ইভন ইন লস? ইজ় ইট ইগোটিজ়ম দ্যাট উই ক্যানট শেক ফ্রি অফ? হাউ উড হি নো দিস? অ্যান্ড হোয়াই ডু আই ওয়ান্ট হিম টু নো?”
অপর পক্ষের সৈনিকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেন মুরিদ। উৎকণ্ঠা, ক্রোধ, উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে আসে। ভাবতে থাকেন ছেলেটির কথা। কোত্থেকে এসেছে ছেলেটি? সাস্কাচুয়ান, মধ্য ইউরোপ, ব্রুকলিন? ভাবেন ছেলেটির মনুষ্যত্বের কথা। ও কি হত্যা করতে সক্ষম? ওর মনুষ্যত্বের পরীক্ষা কি হয়েছে? ও কি আমার মনুষ্যত্ব বুঝতে সক্ষম? ও কি এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে? এই যে ছেলেটি, “দ্য গার্ড গার্ডিং আওয়ার কান্ট্রি— এগেন্সট আস?” এমন একটা তীব্র ভাবে রাজনৈতিক মুহূর্তেও নিজের ‘এমপ্যাথি’ খুঁজতে থাকেন কবি। খুঁজতে থাকেন প্রত্যেক মানুষের ভিতরের মঙ্গলকে। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ চলতে থাকুক, তবু এই সমমর্মিতার সম্ভাবনাই বুঝি আজকের সময়ে আমাদের প্রধান ভরসা।
লেখক: ইংরেজি বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy