Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
নাকামুরায়ার বসু মশাই
Rash Behari Bose

জাপানে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করতেন

৯৪৫-এ জাপানেই প্রয়াত হন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর হৃদয়ে যেমন রইল ভারত, তেমনই রয়ে গেল জাপান।

দম্পতি: জাপানি স্ত্রী তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারী বসু।

দম্পতি: জাপানি স্ত্রী তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারী বসু।

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২১ ০৬:০১
Share: Save:

জাপানের জগদ্বিখ্যাত এক খাবারের নাম ‘সুশি’। সে দেশের গিন্‌জা এলাকার অভিজাত ‘সুশি’ রেস্তরাঁ কিউবেই। বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শেষার্ধে প্রিয় সেই আস্তানায় নিয়মিত প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে সুশি খেতে খেতে ভারতের স্বাধীনতার পথ খুঁজে বেড়াতেন, ইংরেজের তাড়া খেয়ে জাপানে আশ্রয় নেওয়া এক অসীম সাহসী, চরমপন্থী বাঙালি বিপ্লবী। জাপানে তিনি পরিচিত ‘নাকামুরায়া নো বোস’ অর্থাৎ ‘নাকামুরায়ার বসু’ হিসেবে। ইতিহাসে তাঁর নাম রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৫)। সেই সুশি রেস্তরাঁয় তাঁকে এক বার ‘ভারতীয়’ বলে চিহ্নিত করার জন্য তিনি এক খদ্দেরের গায়ে হাত তুলেছিলেন। রাসবিহারী তত দিনে জাপানের নাগরিক হয়ে গিয়েছেন। জাপানের ভাষা আর আদবকায়দাও অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছেন। এক জাপানিকে বিয়ে করে এক পুত্র এবং এক কন্যার পিতা হয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন তাঁকে আমৃত্যু উতলা করে রেখেছিল। রাসবিহারী আর তাঁর প্রায় অজানা জাপানি-জীবনকে চিনিয়ে দিয়েছিল নাকাজিমা তাকেশির এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা-গ্রন্থ। তার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন প্রেম মোতোয়ানি। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই বইয়ের বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ওয়াতানাবে কাজুহিরোর অপূর্ব বঙ্গানুবাদে। রাসবিহারী শুধু এক দুঃসাহসী ভারতীয় বিপ্লবীই নন, প্রথা ভেঙে অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখা মেধাবী, প্রত্যয়ী, বেপরোয়া, ত্যাগস্বীকারে সদাপ্রস্তুত এক বাঙালির চির-অনুসরণীয় মুখ। এই বিপ্লবীর ছেড়ে যাওয়া জন্মদেশে তাঁর জীবন আর দুঃসাহসী উদ্যমের আলোচনার প্রয়োজন।

উত্তর ভারতে বন দফতরের সরকারি চাকরি তাঁকে বোমা বানানোর সরঞ্জাম সংগ্রহে প্রাণিত করে। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে গেলে শুরু হয় রাসবিহারীর পলাতক জীবন। তাঁর সন্ধান চেয়ে ছবি দেওয়া পোস্টারে ছেয়ে গেল ভারত। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষিত হল মোটা টাকার পুরস্কার। সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল হিসেবে রাসবিহারী বেছে নিলেন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জেতা জাপানকেই।

১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণের চেষ্টা করছিলেন। সংবাদপত্রে সেই খবর দেখে, ১৯১৫-র মে মাসে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুরের পরিচয়ের আড়ালে কলকাতা থেকে সানুকিমারু জাহাজে রাসবিহারী ভেসে চললেন জাপানের পথে। জীবন আর ভবিষ্যৎ অনির্দিষ্টের হাতে সঁপে দিয়ে ঊনত্রিশ বছরের তরুণ সেই যে দেশের মাটি ছেড়ে গেলেন, আর ফিরলেন না কোনও দিন। পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং হয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে দিতে তিনি পৌঁছেছিলেন জাপানে। কোবে বন্দরে কাস্টমস-এর জাপানি কর্মী সানন্দে তাঁর হাতে তুলে দিলেন রবীন্দ্রনাথের নামে আসা কয়েকটি চিঠি। ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়’ পরিচয় দিতেই কোনও তল্লাশি ছাড়াই রাসবিহারী প্রবেশাধিকার পেয়ে গেলেন জাপানে। প্রবাসী ভারতীয় এবং জাপানি সাংবাদিকদের সহায়তায় তিনি অল্প সময়ে জাপানে গড়ে তুলেছিলেন এক শক্তিশালী জনসংযোগ। তিনি পরিচিত হন চিনের বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেন এবং জাপানের প্রথম সারির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। রাসবিহারী বুঝেছিলেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে গেলে ভারতীয়দের হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রের দরকার। জাপান থেকে ভারতে অস্ত্র পাঠানোর সময়, তাঁর সহযোগী সিঙ্গাপুরে গ্রেফতার হলে ব্রিটিশ পুলিশ জেনে যায় রাসবিহারীর জাপানে লুকিয়ে থাকার কথা। ছদ্মপরিচিতিতে জাপানের সংবাদপত্রে ভারতের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে রাসবিহারী ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সে দেশে একটা জনমত গঠনের চেষ্টা করতে থাকেন।

জাপানের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা এবং জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান গেন্‌ইয়োশার দাপুটে মুখ তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে পরিচয় না হলে সম্ভবত জাপানি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ভারতে ফিরে রাসবিহারী গলায় পরতেন ফাঁসির দড়ি। তাঁকে গ্রেফতার করে প্রত্যর্পণের জন্য ইংরেজ সরকার মিত্র দেশ জাপানের উপর ক্রমাগত চাপ বাড়াতে থাকলে তোয়ামা গোপনে পরিকল্পনা করে রাসবিহারীকে লোকচক্ষুর অন্তরালে পাঠিয়ে দেন। প্রত্যর্পণের আগের রাতে পুলিশের ঘিরে রাখা একটি বাড়িতে বিদায়ী নৈশভোজের অনুষ্ঠানের ছলে রাসবিহারী আর তাঁর সহযোগী হেরম্বলাল গুপ্তকে যে তৎপরতা আর কৌশলে শিন্‌জুকুর নাকামুরায়া রেস্তরাঁর মালিক সোমা আইজোর বাড়িতে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী কোক্কোর উৎসাহে চালান করে দেন তোয়ামা, তা হার মানাতে পারে যে কোনও রুদ্ধশ্বাস অন্তর্ধান রহস্যকে। যে পুলিশ কর্মীদের চোখে ধুলো দিয়ে রাসবিহারী আর হেরম্বলালকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন তোয়ামা, তাঁরা চাকরি হারাবার ভয়ে তাঁর দ্বারস্থ হলে, জানা যায় তিনি তাঁদের বলেছিলেন, তাঁদের চাকরি চলে গেলেও উপকৃত হবে তিরিশ কোটি ভারতীয় এবং দৃঢ় হবে জাপান-ভারত সম্পর্ক।

জাপানি জাহাজ তেন্‌নো মারুর উপর এক ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ বোমা নিক্ষেপ করলে, তার প্রতিবাদে রাসবিহারীকে প্রত্যর্পণের নির্দেশ তুলে নিল জাপান সরকার। শেষ হল রাসবিহারীর প্রায় সাড়ে তিন মাসের গুপ্ত বন্দিজীবন। কিন্তু পুলিশ তাঁর পিছু ছাড়েনি। অবিবাহিত রাসবিহারী পুলিশের নজরদারি এড়াতে ঘন ঘন বাড়ি বদল করে জাপানে থাকছিলেন। তোয়ামার অনুরোধে, ভবিষ্যৎ বাজি রেখে নিপীড়িত ভারতের বন্ধু হয়ে ওঠা এই সোমা পরিবার রাসবিহারীর সঙ্গে ১৯১৮-য় বিয়ে দিলেন তাঁদের মেয়ে তোশিকোর। এক বার তাঁর প্রতি ভালবাসার প্রমাণ দিতে তোশিকোকে চোখ বন্ধ করে রেলিং থেকে নীচে ঝাঁপ দিতে বলেছিলেন রাসবিহারী। অশ্রুসিক্ত চোখে তোশিকো তাঁর স্বামীর সন্দেহের অবসান ঘটাতে উদ্যত হলে রাসবিহারী তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। ১৯২৩-এ অকালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর যেন সোমা পরিবারের রেস্তরাঁ নাকামুরায়ার সঙ্গে আর এক গভীর বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন রাসবিহারী। ঝিমিয়ে পড়া নাকামুরায়াকে ‘ইন্দো কারে’ অর্থাৎ ভারতীয় ‘কারি’ রান্না করে বিক্রি করা শিখিয়ে বিপুল জনপ্রিয় করে তুললেন তিনি। নাকামুরায়ার ভারতীয় ‘কারি’র হাত ধরে তাঁর বিপ্লব আর ভালবাসার উপাখ্যানও ক্রমে ছড়িয়ে গেল জাপানের প্রায় সর্বত্র। জাপানে রাসবিহারী হয়ে উঠলেন ‘নাকামুরায়া নো বোস’। জাপানের ব্যস্ত শহর শিন্‌জুকুতে আজও রমরম করে চলছে নাকামুরায়া আর তার প্রসিদ্ধ ‘ইন্দো কারে’। তাকেশি নাকাজিমা মনে করেছেন, জাপানে সেই সময় সহজলভ্য ইংরেজ ‘কারি’র প্রতিবাদী বিকল্প হিসেবে রাসবিহারী জাপানে প্রবর্তন করেছিলেন তুলনায় অনেক সুস্বাদু, দামি ভারতীয় ‘কারি’।

রবীন্দ্রনাথের জাপানভ্রমণের সময় তাঁর সঙ্গে কয়েক বার দেখা হয়েছিল রাসবিহারীর। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্নেহই করতেন। চিনের সঙ্গে জাপান যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে মহাত্মা গাঁধী, রবীন্দ্রনাথ, জওহরলাল নেহরুর সহানুভূতি চিনের অনুকূলে এবং জাপানের বিপক্ষে যায়। জাপানের ঔপনিবেশিক ‘মতলব’ সন্দেহ করে ওই সময় ভারতে যে জাপান-বিরোধী হাওয়া বইতে থাকে, তা জাপানের সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতার পরিকল্পনায় প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে দেখে রাসবিহারী রবীন্দ্রনাথকে নিজের খরচে জাপানে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু রাসবিহারী, প্রকারান্তরে চিনের উপর জাপানের আগ্রাসী নীতি সমর্থন করছেন বুঝে, রবীন্দ্রনাথ পিছিয়ে আসেন। জাপান সরকারের ইচ্ছেকে মূল্য দিয়ে জাপানেই সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে ভারতীয় স্বাধীনতা সঙ্ঘ আর আজ়াদ হিন্দ ফৌজের ভার তুলে দিয়ে হালকা হন অসুস্থ রাসবিহারী।

ভারতের মুক্তি নিজে দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৫-এ জাপানেই প্রয়াত হন তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর হৃদয়ে যেমন রইল ভারত, তেমনই রয়ে গেল জাপান। আর পুলিশের খাতায় রয়ে গেল তাঁকে চেনার মোক্ষম চিহ্ন— বাম হাতের মধ্যমায় বিস্ফোরণের এক অভ্রান্ত ক্ষত।

অন্য বিষয়গুলি:

Rash Behari Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy