বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামির মাটির তলায় মজুত কয়লাকে ঘিরে রাজ্যে নতুন শিল্পের সম্ভাবনার সূচনা দেখছে রাজ্য সরকার। কয়লা উত্তোলনে এক লক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চপ ও পকোড়া শিল্প-সংস্কৃতিতে কয়লাখনি কর্মসংস্থানের আশা জাগায় বটে। নিজের রাজ্যে নতুন কাজের সম্ভাবনা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে জনসমর্থন তৈরি করতে পারে। তবে ডেউচা-পাঁচামিতে কাজের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে গেলে দু’টি বিষয় চিন্তা করা প্রয়োজন। এক, কয়লা উত্তোলনে নিযুক্তির সম্ভাবনা। দুই, কয়লা খনিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের হালহকিকত।
প্রথম বিষয়টি, অর্থাৎ কবে খনিতে নিয়োগ আশা করা যায়, কত জন নিযুক্ত হবেন, তা এখনও ধোঁয়াশা। কারণ, কয়লা উত্তোলন কোন পদ্ধতিতে হবে, সেই পদ্ধতি প্রধানত শ্রমিক-নির্ভর না কি যন্ত্রনির্ভর, তার উপর নির্ভর করে কর্মসংস্থান। এর কিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। কোল ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন ডেউচা-পাঁচামি অঞ্চলের দু’টি কয়লা ব্লকে (ডেউচা-পাঁচামি এবং হরিণশিঙা দেওয়ানগঞ্জ) জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই) দু’দফায় ড্রিলিং করে সমীক্ষা করে। উদ্দেশ্য, কত কয়লা রয়েছে, এবং কয়লার উপর কত মাটি ও পাথর রয়েছে, তার সমীক্ষা। ওই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়ার কথা ‘মাইন প্ল্যানিং’— অর্থাৎ কী ভাবে ওই কয়লার স্তরে ঢোকা হবে, তার পরিকল্পনা। মাটির অনেক নীচে কয়লা থাকলে কুয়োর মতো গর্ত কেটে ভূগর্ভে খনি হবে (লংওয়াল আন্ডারগ্রাউন্ড), উপরের দিকে থাকলে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়, বা খোলামুখ খাদান (ওপেন কাস্ট মাইনিং) তৈরি হয়।
সেই পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজ়াইন ইনস্টিটিউট’-এর সদস্যরা গত দশকে ডেউচা-পাঁচামিতে এসেও, স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায় ফিরে যান। এখনও অবধি কোনও অনুসন্ধান ও পরিকল্পনা হয়নি। ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার এক প্রাক্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ারের মতে, এখনই সে কাজ শুরু করলেও, অন্তত বছর পাঁচেক লাগবে শেষ হতে। গত বছর জুলাই মাসে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, পুজোর পরে কয়লার অনুসন্ধানের কাজ শুরু হবে ও তার দেড় বছর পর কয়লা উৎপাদন শুরু হবে। কারা অনুসন্ধান করবে আর কবে উৎপাদন শুরু হবে, তা আজও স্পষ্ট নয়। বাড়তি সমস্যা হল কয়লার উপর ব্যাসল্ট পাথরের স্তর, যা কোনও কোনও জায়গায় একশো মিটার পুরু। কয়লা তুলতে গেলে হয় এই ব্যাসল্টের আচ্ছাদনটিতে একাধিক কুয়ো করে তবে কয়লার স্তরে পৌঁছতে হবে, না হলে ব্যাসল্ট স্তর অবধি খোলামুখ খাদান করে, তার পরে সুড়ঙ্গ তৈরি করতে হবে। দু’ক্ষেত্রেই বিপুল বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও দক্ষতা প্রয়োজন, যা ভারতে পাওয়া দুঃসাধ্য।
তাই ডেউচা-পাঁচামির পরিকল্পিত কর্মক্ষেত্রে ‘কবে চাকরি’— এই প্রশ্নের উত্তর অনিশ্চিত। তেমনই প্রশ্ন থাকছে, কত চাকরি? মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এক লক্ষ চাকরি হবে। হরিণশিঙা দেওয়ানগঞ্জে কয়লা আছে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি, তাই এখান থেকেই কয়লা উৎপাদন শুরু হবে, ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সেখানে কত নিয়োগ হতে পারে? এই ব্লকের কয়লার সঞ্চয় আনুমানিক কুড়ি কোটি টন, যা রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলের চাইতে অনেক কম— চার শতাংশ। রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে কয়লা শিল্পে কর্মসংস্থান প্রায় পঁচাত্তর হাজার, তার মধ্যে তিপ্পান্ন হাজার স্থায়ী শ্রমিক। হরিণশিঙায় যদি খোলামুখ খনি হয়, তা হলে পাঁচ-ছ’শো ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমেই উৎপাদন সম্ভব, বলছেন কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞ আধিকারিকরা। গোটা প্রকল্পে বড়জোর লাগবে তার দশগুণ। কোনও বৃহৎ বেসরকারি সংস্থাকে যদি কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা হলে যন্ত্রের অধিক ব্যবহারই প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সঙ্গে মজুর নিয়োগ, তথা অন্যান্য স্থানীয় দাবি নিয়ে যে দরাদরি চলে, বৃহৎ বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সেটুকুও চলে না।
যদি সরকারের ঘোষণার উপর আস্থা রেখে ধরে নেওয়া যায়, কয়লাখনি প্রচুর নিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি করবে, তা হলেও প্রশ্ন থাকে, কেমন হবে সেই কাজ? তা কি শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারবে? আসানসোল-রানিগঞ্জের দিকে তাকালে সংশয়ের মেঘ ঘনিয়ে আসতে চায়। গত তিন দশকে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে ঠিকা মজুরি। নতুন নিয়োগের সত্তর শতাংশই ঠিকা শ্রমিক। তাঁদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, তাঁরা এক অনন্ত আন্দোলন চালাচ্ছেন— মজুরি বৃদ্ধির নয়, সরকার-নির্দিষ্ট মজুরি হাতে পাওয়ার। কোল ইন্ডিয়ার হাই পাওয়ার কমিটির সুপারিশ অনুসারে ঠিকা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি সর্বনিম্ন ৯৪০ টাকা। আসানসোলে ইসিএল খনির ঠিকা শ্রমিক চন্দ্রশেখর পাল জানালেন, তিনি ২০১৯ সালে পেয়েছেন ২৮০ টাকা, ২০২০ সালে ৩৫০ টাকা, এ বছর পাচ্ছেন ৪৫০ টাকা। ইসিএল-এর সমস্ত কোলিয়ারি জুড়ে এই চিত্র— ঠিকা শ্রমিকের মজুরি লুট হয়ে যাচ্ছে খনির আধিকারিক, ঠিকাদার আর ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের যোগসাজশে। অধিকাংশ খনিতে মজুরি ঘোরাফেরা করে আড়াইশো থেকে চারশো টাকার মধ্যে। পুজোর বোনাস দেওয়া বাধ্যতামূলক, এ বছর তার অঙ্ক ৭২০০ টাকা। কোলিয়ারির প্রায় কোনও ঠিকা শ্রমিক তা পাননি।
শ্রমার্জিত ন্যায্য মজুরি পেতে ঠিকাদার, ম্যানেজার, স্থানীয় নেতার কাছে ক্রমান্বয়ে ঠোক্কর খেতে হয় শ্রমিকদের— ইসিএল বলে তারা মজুরির টাকা ছেড়ে দিয়েছে। ঠিকাদার বলে, চেক ফিনান্স থেকে ছাড়ছে না, কর্তাব্যক্তিদের চেক ছাড়ানোর জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে। নেতা আশ্বাস দিচ্ছে, সব পাওয়া যাবে। বেতন পেতে বিলম্ব হচ্ছে মাসের পর মাস, কয়েকটি কোলিয়ারিতে এই বিলম্বই নিয়মে পরিণত হয়েছে। ‘সোজার মাথায় বোঝা’, বলছিলেন চন্দ্রশেখর পাল। বি এ পাশ করে তাঁকে খনিতে কোদাল চালাতে হচ্ছে, তার পরেও সৎ ভাবে ডিউটি করার পর ন্যায্য মজুরি আদায় করতে চপ্পলের সুখতলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। এই লাঞ্ছনার পেশায় আর তিনি থাকতে চান না।
পুণ্য বাদ্যকর বলছিলেন, ঠিকা কাজের কোনও গ্যারান্টি নেই, সব মিলিয়ে বছরে হয়তো দেড়শো দিন কাজ মেলে। শ্রমজীবনের নিরাপত্তাহীনতায় তিনি চাষের কাজ করতে বাধ্য হন। অন্যদের অনেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, টিউশনি করেন, বাড়িতে গো-পালন করেন, একশো দিনের কাজ খোঁজেন, এটা-সেটা করেন। সম্প্রতি এক আলোচনায় ঠিকা শ্রমিকরা জানালেন, প্রতি মাসে দেড়শো টাকা পিএফ বাবদ ঠিকাদার কেটে নিচ্ছে গত এক বছর। কোথায় সেই টাকা জমছে, সেটা শত জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাঁরা জানতে পারেননি। কাঞ্চন বাউরি পনেরো বছর ইসিএলের ঠিকা শ্রমিক, বিষাদের সঙ্গে বললেন, এক ঠিকাদার তাঁর পিএফ-এর হাজার চল্লিশ টাকা গায়েব করে ফেলেছে, তিনি মেনে নিয়েছেন চুপচাপ। “একই পাড়ায় থাকি, কী আর বলব!”
ডেউচা-পাঁচামিতে প্রস্তাবিত কয়লাখনির প্রসঙ্গে যেমন পরিবেশ সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পুনর্বাসনের প্যাকেজ সম্পর্কে আলোচনা প্রয়োজন, তেমনই দরকার শ্রমিকের আর্থিক নিরাপত্তার আলোচনাও। কত কাজ, কেমন কাজ, এ প্রশ্নগুলো না করলে প্রকল্পের গণ-আলোচনা শেষ অবধি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy