কৈশোর থেকে বন্ধু হয়ে যাওয়া মেয়েটি বলেছিল, নিজের ক্রস নিজেকেই বহন করতে হয় রে। ক্রুশ কী ভাবে বহন করতে হয়, ছায়াছবিতে তার আগে দেখা হয়ে গিয়েছে। বেন-হার’এ ক্রুশ বইছেন যুবক, পাশ থেকে তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি এর পর ক্রুশে পেরেকবিদ্ধ হবেন তিনি, কাঁটার মুকুটে রক্তাক্ত হবেন এবং অবশেষে মারা যাবেন, তার আগে পাহাড় বেয়ে তাঁকে উঠতে হবে, চাবুক পড়বে হিসহিসিয়ে, জল পাবেন না।
“দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা, তোমারে যেন না করি সংশয়”, রবীন্দ্রনাথের গান শুনে মনে পড়বে স্কুলে উপহার পাওয়া ছবির বইয়ে অদ্ভুত নীল রঙের আকাশের রাত, বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ার আগে জলপাই বাগানে মানবপুত্রের একা, আকুল প্রার্থনা। তাঁর জন্মের পরেও তো তিন জন মানুষ একটি তারা দেখে পথ হেঁটেছিলেন, সেও তো এক অনন্ত নিঃসঙ্গ যাত্রা। শুধু একটি তারা পথ দেখায় আর একলা মানুষ চলে। রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন সেই যাত্রার কথা, “অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক, তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি। বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক, ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি। ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে, “আঁধারে পথ চিনবে কেমন ক’রে?’ আমি কইনু, “চলব আমি নিজের আলো ধরে, হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।’”
গোয়ালঘরে যাঁর জন্ম, রাজার রোষ থেকে বাঁচাতে যাঁর পরিবার হবে উদ্বাস্তু, তাঁর মৃত্যু তো অনিবার্যই থাকে, আর তাঁর জন্মদিনের সঙ্গে তো মিশে থাকবেই বিষাদবোধ। যে পড়েছে বিমল করের খড়কুটো, সে জানে, কী বিষাদ জড়িয়ে থাকতে পারে ২৫ ডিসেম্বরের সকালে, রাতে। ওই উপন্যাসে ভ্রমর বলেছিল, “যীশু নিজের জন্যে কিছু চাননি, সকলকে তিনি ভালবেসেছিলেন। তবু কত কষ্ট দিয়ে মানুষ তাঁকে মেরেছিল।... আমরা বড় নিষ্ঠুর। ভালবাসা জানি না।” অমল কথা বলল না। তার মনে হয়েছিল, “বাড়ির সকলে যদি ভ্রমরকে ভালবাসত, তবে ভ্রমর দুঃখী হত না, তার অসুখ হতো না। ভালবাসা পেলে অসুখ থাকে না— এই আশ্চর্য কথাটা অমলের মাথায় আসার পর সে নিজেই কেমন অবাক ও অন্যমনস্ক হয়ে থাকল।”
জিশু কে? মিশনারি স্কুলে পড়া, ক্যালেন্ডারের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখে বড় হওয়া, অসীম বিশ্বাসে নিজেকে সঁপে দেওয়া বাঙালি কন্যা জানে, তিনি মানুষ। তিনি এক সুদর্শন যুবক, যিনি ভালবাসেন, মুহূর্তের জন্য হলেও ভয় পান, কষ্ট পান, এবং বলেনও, ঈশ্বর এরা জানে না এরা কী করছে, এদের ক্ষমা কোরো। তিনি মানুষের ভাবনাপ্রসূত সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নন, ফলে তাঁর ক্ষমতায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে, তাঁর জীবনকথায় যে ‘মির্যাকল’ বা অলৌকিক আছে, তা আসলে ভালবাসার শুশ্রূষা, বাস্তবে তিনি মৃতকে জীবন দেবেন না।
ইতিহাস তো এসেছিল পরে। তার আগে বই, গল্প, ফ্রেমের ছবি, ছোট ছোট বাংলা বাইবেলে গড়ে ওঠা সুদর্শন ঈশ্বরপুত্র হয়ে উঠেছিলেন যথার্থ রক্তমাংসের মানুষ। স্কুলে পড়া বাংলা বাইবেলে অদ্ভুত ভাবে লেখা থাকত কিছু শব্দ। দুই বোন— মেরি আর মার্থার কথা, যাঁরা জিশুকে ‘প্রেম করিতেন’। সেই প্রেম নিয়ে কারও মনে অন্য কোনও ভাবনা ছিল বলে মনে পড়ে না, কৈশোরের উঁকিঝুঁকি সত্ত্বেও সেই প্রেম ছিল নিখাদ ভালবাসা। জিশুকে ভালবাসবে না, এ আবার হতে পারে না কি? সে পুরুষ, নারী, পশুপাখি যে-ই হোক। মার্থা, মেরি, আর পরে প্রিয় শিষ্যা মেরির সঙ্গে ভাগাভাগি করে যাঁকে ভালবাসতে কোনও অসুবিধা হয়নি।
তিনি রুটি আর মাছ ভাগ করে খাইয়েছেন হাজার হাজার লোককে, আশ্চর্য মনে হয়নি। ছোট ছোট টিফিন কেক কে গুঁড়ো করে খায়নি? অনেকটা খাচ্ছি, এই ভাবনা নিয়ে? তাঁর স্পর্শে জল হয়ে গিয়েছে দ্রাক্ষারস, আশ্চর্য মনে হয় না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে প্রাপ্তবয়স্করা তখন শিখে গিয়েছে।
তিনি নিজে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মারা যাবেন, আশ্চর্য মনে হবে না। কারণ তিনি মানবপুত্র। তাঁকে মরতেই হবে। তাঁর রক্তাক্ত পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবেন তাঁর নিঃসঙ্গ মা, প্রেমিকা— পুরুষ শিষ্যরা যাঁকে স্বীকৃতি দেবেন না। তাঁকে সমাহিত করা হবে এবং মৃত্যুর তিন দিন পরে যিনি জাগ্রত হবেন, পড়ে থাকবে তাঁকে ঢাকা দেওয়া সাদা কাপড়। রক্তমাংসের মানুষ দেহ না পেয়ে হাহাকার করবে আর তিনি উত্থিত হয়ে দেখা দেবেন, বলে যাবেন তিনি থাকবেন হৃদয়ে। মানুষই তো এই ভাবে চলে যায়, এই ভাবেই থেকে যায়। বাংলা বাইবেলে পড়া কথা অন্য মাত্রা পাবে, “তিনি মাংসে হত, কিন্তু আত্মায় জীবিত হইলেন।”
কেন তিনি মরবেন? এত কষ্ট পেয়ে? মরবেন, কারণ তাঁর মৃত্যু তো অন্যদের বোঝাবে জীবনের স্বরূপ। বোঝাবে তাঁদের জন্য, তাঁদের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ মারা যাওয়ার জন্য তৈরি থাকে সব সময়ে। যুগে যুগে বিদ্রোহী, বিপ্লবীরা এই ভাবে মারা যান। দ্য আওয়ারস ছবিতে ভার্জিনিয়া উল্ফের মুখে একটি সংলাপ আছে, তাঁর নির্মীয়মাণ উপন্যাসে একটি চরিত্র মারা যাবে। ছবিতে ভার্জিনিয়া বলছেন, “সামওয়ান হ্যাজ় টু ডাই, ইন অর্ডার দ্যাট দ্য রেস্ট অব আস শুড ভ্যালু লাইফ মোর।” কাউকে মারা যেতেই হবে, যাতে অন্যরা জীবনের অর্থ বুঝতে পারে। কে মারা যাবে? “দ্য পোয়েট উইল ডাই, দ্য ভিশনারি।” কবি মারা যাবেন, স্বপ্নদ্রষ্টা। কবি এই ভাবে মারা যাবেন, বিপ্লবী এই ভাবে মারা যাবেন, বিদ্রোহীকে এই ভাবে মেরে ফেলা হবে। বিশ্বাসঘাতকেরা তাঁদের ধরিয়ে দেবে। লোভে বা ভয়ে। এবং ইতিহাসে তর্ক থাকবে, জুডাসকে কি জিশুই বলেছিলেন তাঁকে ধরিয়ে দিতে, কারণ, তিনি জানতেন, তাঁকেই ‘শহিদ’ হতে হবে। ধর্মের যথেচ্ছাচার, রাজার যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে মৃত্যু হয়ে উঠতে হবে। মৃত্যু, প্রতিবাদ— যা থেকে যাবে আবহমান।
আর জীবন কী পাবে? কাঁটার মুকুট, রক্তাক্ত পথ, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সেই পথই ধরার সাহস। হ্যাঁ, দ্বিধা আসবে, সংশয় জাগবে, পালাতে ইচ্ছা হবে, আর পালিয়ে যাওয়ার রাতে, কেউ বলবে, কো ভাদিস। কোথায় যাচ্ছ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy