পরীক্ষার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কবিহীন জানাচেনা আর উপস্থিত-বুদ্ধি সম্বল করে ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বাজিমাত না করলেও মোটামুটি উতরে গেছে, এ কোনও নতুন কথা নয়। পরীক্ষকদের মধ্যে খুব বেশি গম্ভীর যাঁরা, এমন উত্তরপত্র দেখে তাঁরা বলেন, পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে এমন লিখেছে যে, কিছু নম্বর দিতেই হল!
সে আজকের কথা নয়, যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান শাখায় স্নাতক সাম্মানিক স্তরে সাম্মানিক বিষয়টির সঙ্গে একটি বিষয়ে সাধারণ পাঠ্যক্রম, আর ইংরেজি ও বাংলা, দু’টি ভাষাই পরীক্ষা দিতে হত। বাংলা-ইংরেজি পড়ার অবসর বহু পরীক্ষার্থীরই বড় একটা মিলত না। তখনকার এক বাংলা পরীক্ষার দিনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাম্মানিকের দুই ছাত্রীর এক জন দেখে যে, অন্য জন হইহই করে লিখে চলেছে। পরীক্ষার পরে কথা হয়, “কী এত লিখছিলি?” “সাহিত্যের ইতিহাসের টীকা, ফুল্লরার বারোমাস্যা।” “বাবা! হায়ার সেকেন্ডারির পড়া এত মনে আছে তোর?” হেসে উঠল অন্য জন, “ফুল্লরার কত কষ্ট, সে কি ভুলবার? গ্রীষ্মের রোদে পুড়ে পুড়ে ছাগল চরাত, বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ছাগল চরাত, শীতকালে ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে ছাগল চরাত। বুঝলি? বারো মাস ছাগল চরাতে ফুল্লরার কত বিচিত্র অসুবিধে, এটাই আমার ফুল্লরার বারোমাস্যা।” খুব হাসাহাসি হল দুই বন্ধুতে।
‘ফুল্লরার বারোমাস্যা’ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা ছিল বলেই ওরা জানত, ফাঁকি দিয়ে কতটা সারা যায়। পুরনো উচ্চমাধ্যমিকে (নবম-দশম-একাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচিভিত্তিক) ইতিহাসের খাতায় পাওয়া গিয়েছিল, প্রয়াগের মেলায় হর্ষবর্ধন নিজের অঙ্গের শেষ আবরণটুকু পর্যন্ত দান করে ভগিনী রাজশ্রীর থেকে একটি কোট নিয়ে পরিধান করেছিলেন। যতই হাসাহাসি হোক নিরাবরণ হর্ষবর্ধনের কোট পরা নিয়ে, পরীক্ষার্থী অন্তত জানত প্রয়াগের মেলার কথা, হর্ষবর্ধনের দানের কথা।
জানাটা যত কমবে, বানানোটা তত কিম্ভূতকিমাকার হবে, তা স্বাভাবিক। অবিশ্বাস্য হলেও, পরের জমানার ইতিহাসের উত্তরপত্রে পাওয়া গিয়েছে যে, গৌতম বুদ্ধ নারীপাচার আর আফিমের চোরাচালানে লিপ্ত ছিলেন, বা ‘বিদ্যাসাগর বিধবা দেখিলেই বিবাহ করিতেন’। মুদ্রিত পাঠ্যের পরিবর্তে হাতে লেখা নোটের উপর নির্ভরতা, কানে শুনে এমনকি চোখে দেখেও সেই নোট নিতে গিয়ে ভ্রান্তি, জ্ঞান হওয়া ইস্তক বুদ্ধদেব বা বিদ্যাসাগর নামগুলির সঙ্গে তেমন পরিচয় না-থাকা— এগুলো শিক্ষার্থীর পরিবেশের পরিণাম; সে-পরিবেশের দায় তার একার নয়। শ্রেণিকক্ষে পড়ানো আর পড়া শোনা, এই ঘটনা দু’টির যোগাযোগ যে ক্রমেই বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠছে, সে দায়ও তো এক জন পড়ুয়ার উপর পুরো বর্তায় না। এ সব অবশ্য দু’আড়াই বছরের পুরনো কথা। শ্রেণিকক্ষের ধারণাটাই তো কেমন অস্পষ্ট আজ।
১২৯৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি লিখেছিলেন। দৈবদুর্বিপাকে সে গল্প কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে বাংলার পাঠ্যক্রমে ঠাঁই পায়। পরাধীন বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে জীবনের প্রথম রুজির উদ্দেশ্যে গিয়ে পোস্টমাস্টারের মতো কলকাতার ছেলের দুর্গতির শেষ নেই। ইতিমধ্যে শ্রাবণমাসের ঘোর বর্ষায় তাঁকে ম্যালেরিয়ায় ধরল। বাপ-মা-মরা যে-বালিকাটি পোস্টমাস্টারের কাজ করে দিয়ে দু’বেলা খেতে পেত, সেই নিরক্ষর রতনের উপস্থিতি নির্বান্ধব নির্জন প্রবাসে কলকাতার যুবকটির একমাত্র ভরসা। তাকেই বললেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না— দেখ্ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।” গল্পে আছে, ‘এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে… রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন, এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে। এবং এ স্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”’
এই অনুচ্ছেদে যে বাঙালির ইতিহাস কতখানি বিছিয়ে আছে, তা একুশ শতকের গড়পড়তা পড়ুয়াকে বোঝানো সহজ নয়। কিন্তু বাংলাভাষার এক হতভাগ্য অধ্যাপক উত্তরপত্রে রতন চরিত্রের বিশ্লেষণে পেলেন, “সারারাত রতন শাঁখা-সিঁদুর পরে পোস্ট্মাস্টারের সেবা করল।” পরীক্ষার্থী কি তাদের বর্তমান অভ্যাসের বাইরে গিয়ে গল্পটি পড়ার চেষ্টা করেছিল? আর তাই ‘বালিকা আর বালিকা রহিল না’-র একমাত্র অর্থ, যা সে অর্জন করতে পারল, তা হল— ‘বালিকা শাঁখা-সিঁদুর পরিল’? বিশেষত যখন জননীর বা দিদির শাঁখা-পরা কোমল হাতের উল্লেখ গল্পকার করেছেন! রতনের সেবায় সেরে উঠে ওই গণ্ডগ্রাম ছেড়ে পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়া একাধারে যেমন স্বাভাবিক, তেমনই নির্মম— এত কথা পরীক্ষা পাশের জন্য সাতপুরনো গল্প পড়ে বোঝা না-ই গেল। তাই বলে রতনের ওই অসামান্য তৎপর মানবিক রূপটিতে শাঁখা সিঁদুর জুড়তে হল কেন? গল্প-উপন্যাস পড়ার ব্যাপারটা কি কমতে-কমতে লোপাটের মুখে? আর অন্য দিকে টেলিভিশনের পর্দায় শাঁখা-সিঁদুরের প্রবল দাপট। বাংলা সিরিয়ালে বড় মাপের বিপর্যয়ের ইঙ্গিতে দেখি, যথেষ্ট আধুনিকাদের হাত ফস্কে সিঁদুরকৌটো মাটিতে পড়ে সিঁদুর ছড়িয়ে যায়। নায়িকারা শার্ট-প্যান্ট বা স্কার্টের সঙ্গে শাঁখা-পলা পরতে ভোলে না। ছল-চাতুরি করে তার কাঙ্ক্ষিত— কিন্তু তাকে বিবাহ করতে অনিচ্ছুক— পুরুষের হাতে আধুনিকার সিঁদুর পরা বা নিজে-নিজে সিঁদুর পরে কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির পত্নীত্ব দাবি করা, এ সবের চল বাংলা সিরিয়ালের লেখাপড়া জানা আর চাকরি করা মেয়েদের মধ্যে হুহু করে বাড়ছে। গল্পের শুরুতেই রতনের প্রসঙ্গে ছিল, ‘বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না’। পোস্টমাস্টার স্বেচ্ছায় তার অক্ষরপরিচয়ের দায়িত্ব নিলেন। তাই কি পরীক্ষার্থী বিনোদনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজস্ব ইচ্ছাপূরণ মিলিয়ে-মিশিয়ে রতনকে শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে দিল?
সত্যজিৎ রায় তিন কন্যা চলচ্চিত্রে ‘পোস্টমাস্টার’ অংশে রতনকে যে ভাবে পড়েছিলেন, সে বিন্যাসও খুবই সম্ভব আজকের শিক্ষার্থীদের নাগালে নেই। পোস্টমাস্টারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জল ভরা বালতি হাতে রতনের সেই চলে যাওয়া আর তার পর আবহে তার কণ্ঠস্বর— ‘নতুনবাবু, তোমার জল দিয়েছি’। রতনের ওই অসহায় কিন্তু নিশ্চিত প্রত্যাখ্যানের কোনও অর্থ-নিরর্থ কি আজকের নতুন দর্শক সাদা-কালো ছবি দেখে অনুভব করে? না কি, ও সিনেমা আজকের সমাজমনকে তেমন টানে না? বাপ-মা-মরা মেয়েটার বিষাদের সমাধানে তাকে শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে দিলেই ল্যাঠা চোকে!
বাংলা-ইংরেজি-ইতিহাসের তুলনায় অর্থনীতিতে বানিয়ে লেখার সুযোগ কম, এমন ধারণার চল আছে। সে বিষয়ের উত্তরপত্রেও অবশ্য পাওয়া যায়, ‘অলিতে-গলিতে যে পলিদের চোখে পড়ে, তারাই অলিগোপলি’। কিংবা ছদ্ম বেকারত্বের সংজ্ঞায় দেখা গেছে, যে বেকাররা মুখে মুখোশ পরে রাতের অন্ধকারে ভয় দেখায়, তারাই ছদ্ম বেকার। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর জনসংখ্যাবৃদ্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনায় বছর আড়াই আগে এক বার পরীক্ষার খাতায় পাওয়া যায়, ভারতে সাধারণত সব মানুষই বিয়ে করে, কারণ বিয়ে না-করলে আত্মার শান্তি হয় না। এর পিছনেও কি টিভি সিরিয়ালের ভূমিকা আছে? ভাবতে গিয়ে শিক্ষকরা কেউ কেউ অসহায় বোধ করেন। তাঁদের একাংশ ঘণ্টা পড়ার মিনিট কুড়ি পরে ক্লাসে গিয়ে “তোমরা গল্পগুচ্ছ-র নামই শোননি, ‘পোস্টমাস্টার’ তোমাদের কী পড়াব”, বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসেন ঠিকই। কিন্তু তাঁরাই কি সব? এমন বেঅকুফ শিক্ষকও সম্ভবত আছেন, যিনি শ্রেণিকক্ষে বোঝাতে চান, রতনের মতো প্রাক্-আধুনিক মানুষ পোস্টমাস্টারের মতো ইংরেজিশিক্ষিত পরাধীন বাঙালির পরবাসী জীবনে লালন আর উপশমের উৎস ছিল। সে লালন কোনও স্বীকৃতি পায়নি। প্রত্যন্ত গ্রামকে প্রত্যাখ্যান করা পোস্টমাস্টারের পক্ষে স্বাভাবিক। যে পৃথিবীর দিকে তার কাঙ্ক্ষিত যাত্রা, সে জগৎ রতনের দেশ নয়। এই অসঙ্গতির বিধান আরও পোক্ত করতে-করতেই তো উনিশ শতক থেকে একুশ শতকের পথ কাটা।
এত কথায় কাজ কী? পরীক্ষায় লাগবে? পড়ুয়ারা তবে আসবে কেন ক্লাসে? তা হলে কি পোস্টমাস্টার-এর তুল্য আপাতসরল জটিল গল্পদের পরীক্ষার বাইরে রাখাই ভাল? এ সব অবশ্য পুরনো কথা। বর্তমানে পড়াশোনা, পরীক্ষা দেওয়া-নেওয়া, সবেরই মানে নতুন করে শিখছি।
অর্থনীতি বিভাগ, বাসন্তী দেবী কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy