ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল একটা গান, ‘মাটিতে জন্ম নিলাম/ মাটি তাই রক্তে মিশেছে’। জীবনের শুরু মাটিতেই, কিন্তু আমরা খেয়াল করি না— প্রাণের অঙ্কুরকে আশ্রয় দেওয়া মাটি নিজেও সপ্রাণ। তার মধ্যেই অস্তিত্ব এক সম্পূর্ণ জীবমণ্ডলের। নানা ব্যাক্টিরিয়া, ছত্রাক, অণুজীবের সমৃদ্ধ মিশ্রণের সঙ্গে নেমাটোডের মতো অতি ক্ষুদ্র প্রাণী আর পোকা পিঁপড়ে সরীসৃপ ইত্যাদি নিয়ে তার জীববৈচিত্র। মাটির উপরের প্রাণিজগতের মঙ্গলামঙ্গল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে মাটির ভিতরের এই জীববৈচিত্র: উদ্ভিদের খরা ও লবণ-সহনশীলতা, কিংবা ফুল ফোটার মতো উদ্ভিদের জীবনচক্রের মৌলিক প্রক্রিয়ারও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয় মাটির নীচের জীববৈচিত্র সূত্রে। গাছপালার বাড়-বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক হরমোন বা তাদের পুষ্টির জোগান নিশ্চিত করে মাটির মধ্যে থাকা জীবন। গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও কাজ করে তা।
মাটির ভিতরের এই জীবজগৎকে কর্মক্ষম রাখতে তাদের সঠিক জৈব উপাদানের জোগান দিতে হয়, তার জীববৈচিত্রের যত্ন নিতে হয়। আমরা সেই যত্ন নেওয়ার কাজটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, ফলে মাটির প্রাণশক্তিতে টান পড়ছে আজ। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক-নির্ভর কৃষিব্যবস্থা ফসলের উৎপাদন বাড়ালেও বিপদ ডেকে এনেছে মাটির জীববৈচিত্রের। রাসায়নিকের ব্যবহার, জলাভূমি বা জঙ্গলের মতো প্রাকৃতিক জীবমণ্ডলকে রাতারাতি কৃষি বা আবাস-ভূমিতে রূপান্তরের ফলে দ্রুত কমতে শুরু করেছে মাটির জৈব কার্বন। কমছে মাটির জল ধারণের ক্ষমতা, নামছে জলস্তর। বাড়ছে মাটির লবণাক্ততা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও জমি লবণাক্ত হয়, চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে আমাদের সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
মাটির জীববৈচিত্র নষ্ট হলে তার বড় প্রভাব পড়ে মাটির স্বাস্থ্যে। মাটির স্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্ক তার ভিতরের অণুজীব, পোকামাকড় ও উদ্ভিদ নিয়ে গড়া জীবমণ্ডলের বৈচিত্রের। এই জীববৈচিত্রের ক্ষয়ের ফলে মাটির ভিতরের সূক্ষ্ম খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে, মাটির মধ্যে থাকা বন্ধু জীবাণুদের পুষ্টিচক্র বা নিউট্রিয়েন্ট সাইক্লিং করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাটির উর্বরতা কমে যায়, খাদ্য নিরাপত্তা বড় ঝুঁকির সামনে পড়ে। অন্য দিকে, মাটির জীবমণ্ডল সমৃদ্ধ হলে মাটি নিজের পূর্ণ শক্তি দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারে। মাটিতে উপস্থিত জীবমণ্ডলের বড় অংশ কার্বন অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
মাটির স্বাস্থ্য ও তার প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সাম্প্রতিক কালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কৃষক, বিজ্ঞানী ও নীতি-প্রণয়নকারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন মাটির স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র নিয়ে। সেই ভাবনা থেকে উঠে আসছে বিকল্প কৃষি দর্শনও। জাপানি কৃষিবিদ ও দার্শনিক মাসানোবু ফুকুওকা লিখেছেন দি ওয়ান-স্ট্র রেভলিউশন-এর মতো বই, সেখানে আমাদের তথাকথিত আধুনিক কৃষিব্যবস্থার খোলনলচে বদলে ফেলার ডাক দেওয়া হয়েছে। মাটিতে লাঙল দেওয়ার মতো প্রাথমিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, প্রচারিত হচ্ছে কৃষিতে ন্যূনতম মানব-হস্তক্ষেপের দর্শন।
মাটি নিয়ে কাজ করেন যে বিজ্ঞানীরা, তাঁদের কাছেও ফুকুওকার দর্শন জনপ্রিয় হচ্ছে। তাঁদের অনেকের মতে, একটা বিশেষ সময়ের দাবি মেনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক-ভিত্তিক চাষে জোর দেওয়া হয়েছিল। আবার নতুন সময়ের দাবি মেনেই এক দিন সেই কৃষিপদ্ধতিকে ধীরে ধীরে সরিয়ে জায়গা করে নেবে আরও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি।
মাটির সুস্বাস্থ্য ও জীবমণ্ডলের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫ ডিসেম্বর তারিখটি পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ হিসাবে। এ বছর তার উদ্যাপন করতে গিয়ে আয়োজকরা বলছেন মাটির যথার্থ চরিত্র বুঝতে মাটি সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার কথা। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে মাটি ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব বোঝাতে তৈরি হয়েছে এ বছরের ‘থিম’— ‘মাটির যত্ন: পরিমাপ, নিরীক্ষণ, ব্যবস্থাপনা’।
রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এই কাজে সাধারণ মানুষকেও যুক্ত করার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে, সংস্থার ওয়েবসাইটেও তা প্রকাশিত। মাটি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং সেই তথ্য ভাগ করে নিয়ে আরও গ্রহণযোগ্য ‘সয়েল ম্যানেজমেন্ট’ ব্যবস্থা গড়ে তোলায় মানুষকে উৎসাহিত করবে এই কর্মসূচি। অভিভাবকদের অনুরোধ করা হয়েছে, যাতে বাড়ির ছোট্ট বাগানের জন্য জৈব সার তৈরিতে শিশুরাও হাত লাগায়। মাটির যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারা আগামী দিনের নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই বিষয়টি ছোটদের কাছে আরও সহজ করে পৌঁছে দিতে তাদের মাতৃভাষায় পুস্তিকা ইত্যাদি তৈরির উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।
মানুষের জীবনধারণের একটি মৌলিক চাহিদা খাদ্য সংস্থান। এই চাহিদা মেটানোর বর্তমান প্রক্রিয়াটি সামগ্রিক ভাবে যে প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে, তার উত্তর খুঁজতে হবে নতুন জীবনদর্শনে। মৃত্তিকা দিবস ঘিরে সদর্থক ভাবনাই হতে পারে সেই উত্তর খুঁজে পাওয়ার পথে যোগ্য পদক্ষেপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy