একটা বড় পরিবর্তন যে ঘটে গিয়েছে, এ বারের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সেটাকে স্পষ্ট করে সামনে এনে দিল।
বিজেপি আর বাংলা সমাজ-সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা শোনা গিয়েছে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতির প্রতি বিজেপির আক্রমণ শোনা গিয়েছে। ‘তুমি আমাদের কথা বলো না’ গানে ‘তুমি’ যে কারা, বুঝতে অসুবিধে হয়নি। একটা প্রশ্ন তবু থাকে। এই বিজেপি বাঙালি আসলে কারা? এবং তাদের ‘সংস্কৃতি’টা ঠিক কী?
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে প্রায় দুই দশকের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে কয়েকটা কথা বলতে পারি। কাছ থেকে দেখেছি, ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-র দশকে বাঙালিদের মধ্যে কী ভাবে আরএসএস আদর্শ প্রচারিত হয়েছে, শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। দেখেছি, ওই যুগের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের অফিসে থাকত হেডগেওয়ার-গোলওয়ালকরের ছবি। হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী মানুষের বাড়িতেও। দশ ফুট বাই দশ ফুট ফ্ল্যাটের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি, জগদীশ বসু, বিদ্যাসাগর অথবা বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ-সারদার ছবি কোনও দিন জায়গা পেত না। স্কুল-কলেজের যে বন্ধুরা রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-সত্যজিৎ নিয়ে কথা বলত, তারা এই সব বাড়ি দেখলে নাক সিঁটকাতো। স্বাভাবিক। যেটাকে স্কুল-কলেজে বাঙালিত্ব বলে চিনলাম, সেটা ওই সঙ্ঘ-সদস্যদের বাড়িতে তেমন ভাবে ঢোকেনি কখনও। বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির নবজাগরণ, রামমোহন, ডিরোজ়িয়ো, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধূসূদন, ঠাকুর পরিবার কিংবা রায় পরিবার, জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বসু কিংবা প্রফুল্লচন্দ্রের মেধা, এমনকি কলকাতার হিন্দু বাঙালির দুর্গাপুজো, কালীপুজো, পৌষ পার্বণ অথবা সরস্বতী পুজোর মতো একেবারে সাধারণ জীবনচর্যা— এই সবই হিন্দুত্ব-নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি প্রৌঢ়ের বাড়িতে টাঙানো খাকিপ্যান্ট, কালো টুপি, কালো বুট আর লাঠি কাঁধে জঙ্গি কুচকাওয়াজের আধা-ফ্যাসিস্ট ছবির তলায় সব সময়ে ঢাকা পড়ে থেকেছে।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে একটা কথাও হত না সেই পরিবেশে। আরএসএস-বিজেপির সেই সংস্কৃতিবৃত্তে ‘বাংলাদেশ’ মানেই শত্রু মুসলমান, ‘পূর্ববঙ্গ’ মানেই হিন্দু মেয়েদের উপর মুসলিম নির্যাতন। হীরক রাজার দেশের মগজধোলাই যন্ত্র, রোপণ করে মন্ত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নরেন্দ্র মোদী আজ যখন তাঁর সত্যাগ্রহ এবং জেল খাটার গল্প বলেন, তাই বেশ কৌতুক জাগে।
ছিল উগ্র পুরুষতান্ত্রিকতা। মেয়েদের গ্রুপ ‘রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি’ বলে যা ছিল, সেটা হল অন্দরমহলের দুর্বল, পৃথক অস্তিত্ব জানানোর পন্থা। সেই মেয়েদের কাজ পুরুষ সৈনিকদের সম্পূর্ণ আড়াল থেকে। হিন্দুত্ববাদীদের তিন প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতি দিনের বিদ্বেষবচন ছিল: মুসলমান-বিদ্বেষ, খ্রিস্টান-বিদ্বেষ, আর সমাজবাদ-বিদ্বেষ। তবে একটা জিনিস তখন ছিল বলে মনে পড়ে না। সেটা হল কোটি কোটি কালো টাকা, কর্পোরেট টাইকুনদের সঙ্গে ওঠাবসা, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আর পাঁচতারা হোটেলে বসে থাকা, সোনার চেন পরা, ভয়ঙ্কর-দর্শন মোটরবাইক আরোহী, বডিগার্ড-পরিবৃত রক্তচক্ষু নেতারা। তাই হয়তো পুরনো আর নতুন সঙ্ঘের সংঘাতও চোখে পড়ছে। এই সে দিন বিজেপির নতুন আইনে কৃষকদের ফসল লুট করে কর্পোরেট ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন গোবিন্দাচার্য ও আরও কিছু নেতা। এখনও সঙ্ঘের অনেক নেতা আছেন যাঁরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী এবং সাম্প্রদায়িক হয়েও ব্যক্তিগত জীবনে বেশ নিঃস্বার্থ, এবং এক ধরনের প্রাগৈতিহাসিক ‘ভারতীয়ত্ব’-র আদর্শের প্রতি নিষ্ঠ।
এক জায়গায় কোনও পার্থক্য ঘটেনি অতীত ও বর্তমানে। তীব্র রক্ষণশীলতা, বিজ্ঞানবিরোধিতা, অশিক্ষা-কুসংস্কার, এবং উদারবাদী বাঙালি জীবনদর্শনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা ও উপহাস সে দিনও যেমন ছিল, আজও তেমন— না, আজ আরও অনেক পুষ্ট। আজ বাংলায় এসে ভোটের স্বার্থে বিজেপি নেতারা যা-ই বলুন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে স্বদেশ পর্যায়ের গান-কবিতার বাইরে অচ্ছুত। দেবী, গণশত্রু, সদগতি-র মতো চলচ্চিত্র বানানো সত্যজিৎ রায় তাঁদের কাছে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস থেকে সুচিত্রা মিত্র, মৃণাল সেন থেকে ঋত্বিক ঘটক সেখানে অজ্ঞাত ও পরিত্যাজ্য। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস বৃত্তে আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, লীলা মজুমদারের নাম কেউ শোনেনি, শুনলেও পাত্তা দেয়নি।
না, আরএসএস ক্যাম্পে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি শহিদদের অবদান নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা হয় না। কিন্তু শিবাজি আর আফজল খাঁ নিয়ে হয়। এবিভিপির মিটিংয়ে আজও বাঙালি ভাবনাচিন্তার কোনও ছোঁয়া পৌঁছয়নি। আরএসএস শাখায় জাতীয় পতাকা ওড়ে না। ওড়ে শিবাজির ভগোয়া ঝান্ডা। নমস্কার বা হাততালি নিষিদ্ধ, চলে হিটলার মুসোলিনির বাহিনীর কায়দায় অভ্যর্থনা। আরএসএস-এর ছুটির তালিকায় স্বাধীনতা দিবস অনুপস্থিত। বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি ইতিহাস মানে এক জনই— শ্যামাপ্রসাদ।
সংস্কৃতির এক অপার, অসেতুসম্ভব বিভেদ, সেই তখন থেকেই। তখনই মনে হত, এ কি আলাদা শ্রেণি? আলাদা সমাজ? জানি না। তবে আলাদা রক্ত। কথাটা আসলে খুব সহজ: রক্তের মধ্যে হয় বাঙালিয়ানা থাকে, নয়তো থাকে না। আজকে সেই রক্তের যুদ্ধ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy