বাঙালির সার্বিক সাংস্কৃতিক অধঃপতনের একটি দিক দেখিয়ে দিয়ে গেল সঙ্গীতশিল্পী কেকে-র মৃত্যু। কলেজের ‘ফেস্ট’ আয়োজনের দায়িত্বে কে বা কারা ছিলেন; যাঁরা ছিলেন তাঁদের আয়োজনের অধিকার ছিল কি না; কলেজের ফেস্ট কলেজের বাইরে প্রেক্ষাগৃহে কেন— প্রশ্ন উঠতেই পারে। কোনও ক্লাবের অনুষ্ঠান আর কলেজের অনুষ্ঠান একই গোছের হওয়াও কি দরকার? চারিদিকে এত ক্লাব সারা বছর বিবিধ মোচ্ছবে মেতে আছে, সমধর্মী অনুষ্ঠান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও দরকার কেন? আবার কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, দেশ জুড়ে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিরাট ফেস্ট হয়— এই দুর্ঘটনা ঘটল বলেই কি এত কথা বলছি আমরা?
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ফেস্ট-কে ক্লাবের পর্যায়ে ঠেলে দেয়নি। ‘নাক’-এর মূল্যায়নে ভালই নম্বর পায় তারা। নির্বাচিত সংসদ এই সব অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকে, থাকেন শিক্ষকদের একাংশও, আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট অফিসার। কিন্তু এ রাজ্যে দীর্ঘ ছয় বছর ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি, ফলে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাসক দলের অনুগামী ছাত্রদের, যাদের অধিকাংশ আবার প্রাক্তন ছাত্র। ফলত ক্লাব পরিচালনের যে রীতি এবং ক্লাবের যে ‘উৎপাদনশীল’ ভূমিকা, এ রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নামক অধুনা অসংসদীয় পরিসরটির ভূমিকাও তা-ই। এই জমানায় বাস্তবিকই দলই তন্ত্র, দলই মন্ত্র। ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ‘সরকার’ নামক আপাত নিরপেক্ষ, সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক পরিসর সঙ্কুচিত হয়েছে সার্বিক ভাবে। এই মোক্ষম উপায়ে ‘সরকার’-এর উপরে ‘দল’-কে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে। সরকারি ভাবে সরকারকে গুরুত্বহীন করে দলকে এ ভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া নজিরবিহীন। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রশক্তি তথা ক্ষমতা সবাইকে অনুগত বলে ভাবতে শুরু করে। মুষলপর্বের সূচনা এখান থেকেই।
রাষ্ট্রব্যবস্থার এই আস্ফালনের যুগে নতুন আলো দেখাতে পারে ছাত্ররাজনীতি তথা প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি। শেষ এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, সবেই নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররাজনীতি। শাহবাগ আন্দোলন হোক বা এ দেশে লিঙ্গসমতার আন্দোলন, কৃষক-শ্রমিক-দলিত আন্দোলন— সব কিছুতেই ছাত্রআন্দোলন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এ রাজ্যে কিন্তু ছাত্ররাজনীতির এই ভূমিকার অবনতি ঘটেছে। রাজ্যের ছাত্ররাজনীতিতে নতুন ভাষা নতুন বয়ান তৈরি হয়নি, যত ক্ষণ না সে লড়াই প্রগতিশীল চরিত্র পেয়েছে বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়েছে— যেমন ‘হোক কলরব’।
এ রাজ্যে ২০১০-১১ সালে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদের হাতে বার্ষিক বরাদ্দ ছিল সত্তর-আশি হাজার টাকা, ২০১২-১৩’তে তা হয়ে যায় চার-পাঁচ লক্ষ টাকা। বিজ্ঞাপনদাতাদের ভিড় বাড়ে, বাজেটও বাড়তে থাকে, প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের উৎসব-অনুষ্ঠানে, ফুর্তি-মজায় খরচ বাড়ানোয় উৎসাহ দেয়। ছাত্ররাজনীতি হয়ে ওঠে বিপুল আর্থিক লেনদেনের জায়গা। কেউ নির্বাচিত নয়, নেতাদের কেউ ছাত্রও নয়— তারাই ভোট করায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসকরা কিছু বলতেও পারেন না। এ এক ধরনের পচন, যা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রাজ্যে। পায়ে-হাঁটা বাসে-চাপা ছাত্রনেতা আর নতুন চারচাকা চেপে ঘুরে বেড়ানো ছাত্রনেতার মধ্যে ফারাকটা সেই পচনের।
ছাত্ররাজনীতি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের অনুগত হলেও, সার্বিক ভাবে সে দলের নির্বাচনী অ্যাজেন্ডাই যদি ছাত্ররাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তা ভবিষ্যৎকে নিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে। এ দেশে বহু দশক ধরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সেরা প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃত, সেখানে ক্লাসরুমের ভিতরে ও বাইরে একই ভাবে শেখার সুযোগ থাকে। সেই পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বশাসন দেয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসক ছাত্রদের নির্ভীক ও স্বাধীন হতে শেখান, ছাত্ররাও তার্কিক হতে শেখে। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রসংসদ ও সার্বিক ভাবে ছাত্ররাজনীতি ক্লাসের বাইরে এই পরিসর তৈরি করে, তৈরি করে নিরন্তর নতুন বয়ান।
অন্তঃসারশূন্য কাঠামোর বাইরেটা ঝকঝকে করে তোলা আসলে সস্তা রাজনীতির নির্বাচনী প্রচারের মতো। তা না করে বরং সারবস্তু জড়ো করলে সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মেধা ও যুক্তির চর্চায় সবাইকে পথ দেখাবে, প্রতিষ্ঠানের নাম গেঁথে যাবে সমাজের চেতনায়। এ দেশের আনুগত্যহীন গুটিকয় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা পেরেছে। আনুগত্য ও উৎকর্ষের এক সঙ্গে পথ চলা মুশকিল।
ভারত-সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় অসৎ রাজনীতিতে যুক্তি আজ বিপর্যস্ত। দেশ জুড়ে তাই ছাত্ররাজনীতির জ্বলে ওঠা দরকার। ছাত্ররাজনীতিই উচ্চশিক্ষার চিন্তা-চেতনাকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘অ্যাক্টিভিজ়ম’-এর মধ্য দিয়ে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারে। সমাজও শিখতে পারে তা থেকে, গণচেতনার সামগ্রিক মান বাড়ে, গণমাধ্যমেরও। ভবিষ্যতের ভালর জন্যই আজ তা প্রয়োজন।
তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy