১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি আমরা এক স্ববিরোধী জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের সাম্য থাকবে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে থাকবে অসাম্য।
আম্বেডকর (২৫ নভেম্বর, ১৯৪৯, গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃত)
সংবিধানের খসড়া গৃহীত হওয়ার জন্য পেশ করে, গণপরিষদের অতি গুরুত্বপূর্ণ খসড়া রচনা কমিটির সভাপতি ভীমরাও আম্বেডকরের সেই সংবিধানেরই কার্যকারিতা সম্পর্কে এই অতীব তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণটি যাত্রা শুরুর দিন থেকেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ গঠনতান্ত্রিক দলিলটির ‘সীমা’ বিষয়ে আমাদের সচেতন করে। এমন ‘স্ববিরোধ’ অবশ্য বিশ্বের সব সংবিধানেই কমবেশি আছে। ব্রিটেনের সুপ্রাচীন ‘অলিখিত’ সংবিধানের উৎসমুখ, বিদ্রোহী ভূস্বামী ব্যারনদের ও চার্চের সঙ্গে রাজার বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য, কিছু অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে, ইংল্যান্ডের রাজা জন-এর জারি করা ১২১৫ সালের সনদ ‘ম্যাগনা কার্টা’; কিংবা ১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে প্রস্তুত হওয়া ও ১৭৮৯-এ প্রণীত আমেরিকার সংবিধান; অথবা, ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) সময় গৃহীত ‘মানুষ ও নাগরিকদের জন্য অধিকারসমূহ’; বা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাজতন্ত্রের অবসান হলে জার্মানির হ্বাইমার প্রজাতন্ত্রের সংবিধান, সবেতেই খুঁজলে ছোট-বড় নানা অসঙ্গতি-সীমাবদ্ধতা চোখে পড়বে।
ভারতের সংবিধান প্রণয়ন ও চালু হওয়ার মুহূর্তে অবশ্য দু’টি লক্ষণীয় বিপরীত প্রতিক্রিয়া ছিল। এক দিকে, দেশভাগের যন্ত্রণা বহন করেও সংবিধান-রচনার জটিল গুরুভার পালন করে শেষ অবধি ২৬ নভেম্বর তা গৃহীত হওয়ায় উচ্ছ্বাস ছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, দেশের এই মৌলিক আইনগুচ্ছ এবং তার প্রস্তাবনায় বলা, ‘ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব’-এর আদর্শ মেনে নতুন রাষ্ট্র সুবিচার ও সার্বিক সমৃদ্ধির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে। অন্য দিকে, ছিল তীব্র অবিশ্বাসের ভ্রুকুটি। ১৯৪৮ সালে নিষিদ্ধ হওয়া, বি টি রণদিভের নেতৃত্বাধীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলেছিল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’! তবে কি সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা উপরে উদ্ধৃত বক্তৃতায় এমন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? পুরো বক্তব্য খুঁটিয়ে পড়লে অবশ্য স্পষ্ট হয়, অসঙ্গতির কথা বললেও আম্বেডকর কিন্তু ‘রক্তাক্ত বিপ্লবের’ পথকেও সমর্থন করেননি, বরং এই পন্থাকে ‘নৈরাজ্যের ব্যাকরণ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন যখন সামাজিক ও আর্থিক লক্ষ্যপূরণের জন্য সাংবিধানিক উপায় রয়েছে, তখন তাকে ধরেই এগোতে হবে, এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে সামাজিক গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে হবে। এই ভাবে, সংবিধানের কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেও শেষ পর্যন্ত আম্বেডকর তাকে কাজে লাগিয়েই আর্থসামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন। ফলে, কেবল নেহরু-পটেল প্রমুখ কংগ্রেসের বড় নেতারা নন, বা সম্পত্তিমান শ্রেণির মানুষই নন, যুগসঞ্চিত শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানুষদেরও একটা বড় অংশ সাংবিধানিক অধিকারকে হাতিয়ার করেই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন।
আম্বেডকর-বর্ণিত বৈপরীত্য ছাড়াও একাধিক বিতর্ক বেধেছে সংবিধানকে ঘিরে। যে হেতু স্বাধীনতার পরও ভারত ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর সদস্য, তাই ভারতকে কি প্রকৃত অর্থে ‘স্বাধীন’ বলা যায়, না কি কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতোই সে স্বায়ত্তশাসনভুক্ত (ডোমিনিয়ন) দেশ? বা, সংবিধানের প্রথম থেকেই ভারতকে যে ভাবে রাজ্যদের ‘সঙ্ঘ’ (ইউনিয়ন) বলা হয়েছে (১ নং ধারা); নতুন রাজ্যগঠন, রাজ্যের সীমানা/নাম পরিবর্তনে যে ভাবে কেন্দ্রীয় আইনসভার পাল্লা ভারী (২-৪ নং ধারা); সপ্তম তফসিল-এ প্রদত্ত কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম তালিকায় বর্ণিত সরকারের নানা বিভাগের কাজ ও দায়িত্বের ভাগাভাগিতেও যে ভাবে কেন্দ্রমুখিতা প্রকট— তাতে কি ভারতকে আদৌ ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বলা যায়? কিংবা, প্রথম ধারায় বলা ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ় ভারত’ কি আসলে শহুরে ক্ষমতাবান ‘ইন্ডিয়া’ আর গ্রামীণ (প্রান্তিক) ‘ভারত’-এর বৈপরীত্যময় সহাবস্থানের দ্যোতক?
আম্বেডকর ওই বক্তব্য পেশের পর বাহাত্তরতম ২৫ নভেম্বর আমরা পেরিয়ে এলাম। কিন্তু এই হাজারো প্রশ্ন/বিতর্ক প্রথম থেকে আজও চলেছে। একটা কথা ঠিক। এ দেশে সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টগুলি অনেক সময়েই যুগান্তকারী, কুর্নিশ-যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, গোড়ায় মৌলিক অধিকারগুচ্ছের মধ্যে ২১ নং ধারায় উল্লিখিত নাগরিকের ‘জীবন ও ব্যক্তিগত অধিকার’-এর তেমন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু ১৯৮১ সালে এই ধারারই সম্প্রসারিত ব্যাখ্যায় বিচারপতি পি ভগবতী একে ‘গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবিধানিক দিক থেকে অসীম মূল্যের’ আখ্যা দেন। বিচারপতি আইয়ার একে ১২১৫ সালের ব্রিটিশ ‘ম্যাগনা কার্টা’-র সমতুল মনে করেন। এই ভাবে এই ধারা কেবল সাধারণ অর্থে ‘জীবনের অধিকার’-এ আটকে না থেকে হয়ে দাঁড়ায় শান্তি ও মর্যাদা-সহ জীবনধারণের; পছন্দমতো জীবিকা নির্বাহের; সামাজিক, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার; অদূষিত পরিবেশ রক্ষার; তথ্যের অধিকারের; কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের এবং আরও একরাশ অধিকারগুচ্ছ— যা মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীদের কাজের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তেমনই ‘গোলকনাথ বনাম পঞ্জাব রাজ্য’; ‘কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরল রাজ্য’ বা ‘ইন্দিরা গাঁধী বনাম রাজনারায়ণ-এর নির্বাচন সংক্রান্ত’ মামলায় বার বার বিচারপতিরা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, কোনও কিছুর দোহাই দিয়েই পার্লামেন্ট এমন কোনও আইন বা সংশোধনী প্রণয়ন করতে পারবে না, যাতে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামোয়’ আঘাত লাগে। ‘মৌলিক কাঠামো’র ধারণাটি অবশ্য পাল্টেছে, কিন্তু তার কয়েকটি মূল নীতি, যেমন সংবিধানের সার্বভৌমত্ব; ব্যক্তি স্বাধীনতা; আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য; সংসদ প্রণীত আইন পুনর্বিচারের ক্ষমতা প্রভৃতি প্রায় সর্বসম্মতি পেয়েছে।
স্বভাবতই ক্ষমতায় ডগমগ শাসকের কানে এ সব ভাল ঠেকেনি, ফলে, সবার আগে আক্রান্ত হয়েছে সংবিধানই। ১৯৭৫-এর জুন থেকে উনিশ মাস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী রাষ্ট্রপতি মারফত ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেন নাগরিক ও বিচারালয়ের সমস্ত সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত রেখে। বিভিন্ন দেশে যুগে যুগে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর থেকে এ ভাবেই স্বৈরতন্ত্র মাথা তুলেছে, যেমন, ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে নির্বাচনে জিতে তৃতীয় নেপোলিয়ন চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পর, প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান খারিজ করে ‘সম্রাট’ হয়ে ওঠেন। বিশ শতকে হিটলার অবশ্য অন্য কায়দা ধরেন। সম্প্রতি, জার্মানির আইনের তত্ত্বকার কার্ল স্মিট-কে অনুসরণ করে, এই মুহূর্তের অন্যতম সেরা ইটালীয় ভাবুক জর্জিয়ো আগামবেন দেখিয়েছেন যে, হিটলার কখনওই হ্বাইমার প্রজাতন্ত্রের সংবিধান বাতিল করেননি। জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে কেবল স্থগিত/সাসপেন্ড করে স্বৈরতান্ত্রিক ‘তৃতীয় রাইখ’-এর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতের সৌভাগ্য সাংবিধানিক পথেই ১৯৭৭-এ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়, নাগরিকরা ফের অধিকার ফিরে পান।
জরুরি অবস্থা জারি না করেও অবশ্য বিনা বিচারে আটক রাখার চল ছিল প্রথম থেকেই। ১৯৫০ সালেই দেশে প্রথম আটক আইন, প্রিভেনশন ডিটেনশন অ্যাক্ট পাশ হয়। এর পর অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার জন্য ১৯৭১ সালে চালু হওয়া ‘মিসা’ জরুরি অবস্থায় কুখ্যাত দমনমূলক চেহারা নেয়— সাতাত্তরে জনতা সরকার তা বাতিল করলেও, ১৯৮৫ সালে জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে ‘টাডা’, একই উদ্দেশ্যে ২০০২ সালের ‘পোটা’ বা ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া কিন্তু বর্তমানে আরও অনেক শক্তিশালী বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধের জন্য প্রণীত ‘ইউএপিএ’: সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে! বিশেষত, শেষোক্ত আইনটি কেন্দ্রের ও কিছু কিছু রাজ্য সরকার মুড়িমিছরির মতো ব্যবহার করে সরকার-বিরোধী যে কোনও কণ্ঠস্বর বা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার যে-পন্থা নিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট তার তীব্র ভর্ৎসনা করেছে।
কিন্তু স্বাধীনতা ও ন্যায়ের দাবিতে ভারতীয় নাগরিকরা লড়াই থামাননি। সংবিধানকে সামনে রেখেই তাঁরা শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছেন। সম্প্রতি নৈতিক ভাবে জয়ী দিল্লির সিংঘু সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকসমাজ বা তার কিছু দিন আগে ‘বৈষম্যমূলক’ জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করে দিল্লির শাহিন বাগ থেকে দেশের নানা জায়গায় আন্দোলন চালানো সাধারণ মানুষ নতুন করে দেশের সংবিধানের গুরুত্ব আবিষ্কার করেছেন। প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক কল্পনা কান্নাবিরন সম্প্রতি সংবিধান ও সাধারণ জনের এই অন্বয়ের বিষয়টিকেই ‘কনস্টিটিউশন অ্যাজ় কমন্স’ বলেছেন, যেখানে দিনের পর দিন হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের উচ্চকোটির ‘বাইরে’ উপচে পড়া পথসভায় মানুষ মন্ত্রের মতো সংবিধানের প্রস্তাবনা আবৃত্তি করেছেন, আর শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন: ‘হাম দেখেঙ্গে’!
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy