পুরস্কার থাকলে বিতর্কও থাকবে— কে পেলেন, এবং কে পেলেন না, দুটো নিয়েই। দুনিয়ার সবচেয়ে নামকরা পুরস্কারের কথাই ধরা যাক— শান্তিতে হেনরি কিসিঞ্জার, সাহিত্যে উইনস্টন চার্চিল, অর্থশাস্ত্রে মুক্তবাজারপন্থী অর্থনীতিবিদদের রমরমা, ও দিকে জোন রবিনসন বা নিকোলাস ক্যালডোরের মতো অর্থশাস্ত্রের বিকল্পধারার পথিকৃৎদের অগ্রাহ্য করা— নোবেল পুরস্কার নিয়েই বিতর্কের অন্ত নেই।
আসলে এর মূলে আছে পুরস্কারের চরিত্রগত কাঠামো। পুরস্কার মেধা বা উৎকর্ষের স্বীকৃতি, কিন্তু সেই মেধা বা উৎকর্ষ যদি সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক বা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে মাপা যেত, তা হলে পুরস্কারের দরকারই হত না, বা পুরস্কার থাকলেও তার গুরুত্ব বেশি হত না। যে সব ক্ষেত্রে কৃতিত্বের নৈর্ব্যক্তিক পরিমাপ করা অসম্ভব, পুরস্কার সেখানেই মূল্যবান।
কথাটা একটু ভেঙে বলা যাক। অলিম্পিকস-এর দৌড়ে ফিনিশিং লাইনে সবার আগে কে পৌঁছলেন, আজকের প্রযুক্তির যুগে সেটা নিখুঁত ভাবে বলা সম্ভব। ফলে, ঘড়ির সেকেন্ড-মিলিসেকেন্ডের হিসাবই সেই দৌড়ের কৃতিত্বের চূড়ান্ত নির্ণায়ক, তার জন্য আর কোনও বিচারকের প্রয়োজন নেই। দৌড়ের শেষে বিজয়ীদের যে মেডেল পরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সেই কৃতিত্বের স্বীকৃতিমাত্র— কৃতিত্বের কথাটা তার আগেই জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, জীবনের বেশির ভাগ জিনিসই অলিম্পিকস-এর দৌড়ের মতো নৈর্ব্যক্তিক ভাবে পরিমাপযোগ্য নয়। কবি হিসেবে কে কার চেয়ে এগিয়ে, সামরিক কৃতিত্ব হিসেবে কোনটা সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, বা শান্তির কর্মসূচি হিসেবে কোন কাজটার গুরুত্ব বাকিগুলোর চেয়ে বেশি, তা নিখুঁত ভাবে মাপতে পারে, এমন কোনও যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেরাটা বাছার জন্য নির্ভর করতে হয় বিচারকদের বিবেচনার উপর। আমরা ধরে নিই যে, এঁরা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং নিরপেক্ষ ভাবেই উৎকর্ষের বিচার করে সিদ্ধান্তে আসেন। কোনও ব্যক্তির যোগ্যতা বা কৃতিত্ব বুঝতে হলে তাই সাধারণ মানুষের ভরসা বিচারকদের দেওয়া পুরস্কার। সেটাই হয়তো পুরস্কারের গুরুত্ব।
সমস্যা হল, যে হেতু কোনও নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি নেই, ফলে পুরস্কারের মধ্যে বিচারকের ব্যক্তিগত বিবেচনা মিশে থাকবেই। সেখানে কোনও ধরনের পক্ষপাত ঢুকে পড়ছে কি না, তাতে কখনও নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। তাই উৎকর্ষের মাপকাঠি হিসেবে পুরস্কারের যেমন গুরুত্ব, সেই মাপকাঠির অস্বচ্ছতার কারণে সত্যিই উৎকর্ষ মাপা হল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাওয়া— এই দ্বন্দ্ব পুরস্কারের মৌলিক চরিত্রের মধ্যেই অন্তর্নিহিত আছে।
উৎকর্ষের মাপকাঠি নিয়ে অস্বচ্ছতা থাকলেও, এবং কিছু কাঠামোগত পক্ষপাত থেকে গেলেও (যেমন, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে সব ভাষায় সাহিত্যচর্চা সমান গুরুত্ব পায় না বা মূলধারার সব পুরস্কারই লিঙ্গ-জাতি-বর্ণ-শ্রেণিনিরপেক্ষ, তা বলা যায় না), কোনও পুরস্কারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সম্মান বজায় রাখার তাগিদেই বিচারকমণ্ডলীর উপর একটা দায়বদ্ধতার চাপ থাকে। কোনও ক্ষেত্রে উৎকর্ষের বিচার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হলেও, বিচারকমণ্ডলীর বাইরেও অনেকেই থাকেন যাঁরা সেই বিষয়ে কৃতী, কিংবা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাঁদের মতামতের গুরুত্ব আছে। তাঁরা যদি বার বার প্রশ্ন তোলেন পুরস্কারপ্রাপকের যোগ্যতা নিয়ে এবং পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতেই থাকে, তখন পুরস্কারটি আর প্রাপকের যোগ্যতা, কৃতিত্ব বা তাঁর গুণগত মান সম্বন্ধে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হলে সেই পুরস্কার এবং যে প্রতিষ্ঠানটি পুরস্কার দেবে, দুটোরই গুরুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাবে।
তবে আর সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মতোই পুরস্কারপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সমাজেরই অঙ্গ। তাই সমাজের সর্বত্র যে সমস্যাগুলো বিরাজমান, তাদের প্রভাব থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও মুক্ত হবে, তা আশা করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাই দায়বদ্ধতার যে বন্ধন এই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে, সেগুলো শিথিল এবং অকেজো হয়ে পড়তে পারে। যেমন দায়বদ্ধতা, প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতা এই প্রক্রিয়াগুলি কাজ করতে পারে একটা গণতান্ত্রিক পরিসরের মধ্যেই। গণতন্ত্র মানে শুধু কয়েক বছর অন্তর ভোট দিয়ে সরকার গড়া নয়— গণতন্ত্র মানে সমাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত স্বশাসনের ক্ষমতা বজায় থাকা। যদি সেই শর্তটি তুলে নেওয়া যায়, তা হলে গোটা ছবিটাই পাল্টে যায়। সমাজ যদি আনুগত্যের শর্ত মেনে চলতে থাকে, ক্লায়েন্টেলিজ়ম বা পৃষ্ঠপোষণতন্ত্রই যদি যুগধর্ম হয়, এবং সাধারণ মানুষ যদি সেই পরিস্থিতিকে মেনে নিতে থাকেন— যে যাঁর নিজের মতো করে এর সুবিধা নিচ্ছেন বলে অন্যদের সুবিধা নেওয়া বা দেওয়াকে যথেষ্ট আপত্তিজনক মনে না হয়— তা হলে পুরস্কারের মানেও পাল্টে যায়। কখনও তা হতে পারে মতাদর্শগত নৈকট্যের ইনাম, কখনও আনুগত্যের পুরস্কার, কখনও বা নির্জলা তৈলমর্দন। প্রতিষ্ঠান যে হেতু শাসকের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে ব্যস্ত— এবং যে হেতু সেই আনুগত্যই তার মূল ‘পুঁজি’, পুরস্কারের গুরুত্ব বা সম্মান নয়— ফলে, পুরস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, বা ভারতের মতো দেশে, রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে, পৃষ্ঠপোষণতন্ত্রের বদান্যতায় চার পাশের কার্যত সব কিছুতেই অযোগ্য লোকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা দেখেও আমরা নির্বিকার থাকব, অথচ পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করব সম্পূর্ণ নৈতিকতা এবং উৎকর্ষের সম্মান, তা সম্ভবত হয় না।
আর একটা ব্যাপার হল, পুরস্কার ব্যাপারটাকে কোন সমাজে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। সব দেশ, বা সব জাতি কিন্তু পুরস্কার বিষয়টাকে সমান গুরুত্ব দেয় না। ভারতীয়রা দেয়, তার মধ্যে বাঙালিরা সম্ভবত আরও বেশি করে দেয়। পুরস্কার ও সম্মান নিয়ে এই অত্যধিক উৎসাহের পিছনে বাঙালির স্বাভাবিক উৎসবপ্রিয়তার নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা আছে। মোট কথা, আঞ্চলিকই হোক বা জাতীয়— আন্তর্জাতিক হলে তো কথাই নেই— পুরস্কার বা সম্মান নিয়ে এত মাতামাতি কিন্তু সর্বত্র হয় না। কেন ভারতীয় বা বাঙালিরা এত বেশি পুরস্কার-ভক্ত, তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়— কিন্তু, দু’একটা কথা বলাই যায়। একটা বড় কারণ হল, আমাদের দেশে সাফল্য, বিশেষত বড় মাপের, আন্তর্জাতিক স্তরের সাফল্য— এখনও ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাতে এমনিতে কোনও অসুবিধা নেই, কিন্তু পুরস্কার বা সম্মানের মতো সাফল্যের বিরল উপসর্গের উপর এতটা মনোযোগ দিলে কোন পরিবেশে সাফল্য ও উৎকর্ষের পরিসর প্রসারিত হতে পারে, তার উপর থেকে নজর চলে যেতে পারে। যে কোনও ক্ষেত্রে উৎকর্ষের পিছনে মেধা এবং পরিশ্রমের মেলবন্ধনে যে দীর্ঘমেয়াদি সাধনার যাত্রাপথ তাকে অগ্রাহ্য করে, তার সহায়ক পরিকাঠামো এবং পরিবেশে বিনিয়োগ না করে শুধু সাফল্যের পাদপ্রদীপের প্রতি আকৃষ্ট হলে আখেরে সেই ব্যবস্থা থেকে সাফল্য অর্জন করার সম্ভাবনা কিন্তু কমে, বাড়ে না।
ক্ষতি এখানে শেষ নয়। যেখানে কাজের প্রক্রিয়ার থেকে ফলাফলের গুরুত্ব বেশি; কী ভাবে সাফল্য এল, তা জানতে চাওয়ার বদলে যে কোনও ভাবে সফল হওয়াকেই যেখানে আসল কথা বলে ধরা হয়, সেখানে যে কোনও উপায়ে সাফল্যের তকমাগুলো আয়ত্ত করার প্রবণতাও বাড়ে। সত্যিকারের শিক্ষার থেকে যদি ডিগ্রির মূল্য বেশি হয় তা হলে যেমন টোকাটুকির প্রবণতা বাড়ে, সত্যিকারের উৎকর্ষকে সম্মান করার থেকে পুরস্কারের মূল্য যদি বেশি হয়, তার অবধারিত ফল হল পুরস্কারপ্রদানের প্রক্রিয়াটি আর নিরপেক্ষ থাকে না।
ব্রেখ্ট-এর কথা ধার করে বলা যায়, দুর্ভাগা সেই জাত, যেখানে পুরস্কারের এত দরকার হয়।
মৈত্রীশ ঘটক, অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুলঅব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy