১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকার রাজপথে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রদের প্রথম দশ জনের দলে। ছিলেন ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশেও। দুই দফা কারাবরণ শেষে, চলচ্চিত্রের পোকা মাথায় নিয়ে এলেন কলকাতা। অর্থাভাবে মাঝপথেই ছাড়লেন ‘প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট অব সিনেম্যাটোগ্রাফি’-র কোর্স। ষাটের দশকে ঢাকায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগেও যুক্ত ছিলেন। এই অদম্য তরুণই জহির রায়হান, বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, পত্রিকা-সম্পাদক।
১৯ অগস্ট তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৫-এর নোয়াখালিতে জন্ম। মাদ্রাসা-শিক্ষক পিতার কর্মসূত্রে পড়াশোনা কলকাতার মডেল স্কুল, মিত্র ইনস্টিটিউশন ও আলিয়া মাদ্রাসায়। অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রভাবে বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন বাল্যেই, কাজ পার্টি-মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ বিক্রি করা আর গোপন খবর নেওয়া। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও সক্রিয়, দেশভাগের কারণে সপরিবার পূর্ব পাকিস্তানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৫৩-তে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্য হন। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসক উর্দু হরফে বাংলা ভাষা চালুর পাঁয়তারা করে। রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান-মিছিলে গুলি ও ছাত্র-গণহত্যার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের লিখিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন তিনি, ’৭১-এর মার্চে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সমাজ’-এর ব্যানারে শপথ নেন গণহত্যার প্রতিকারের।
পদ্মা নদীর মাঝি অবলম্বনে ঢাকায় জাগো হুয়া সভেরা (১৯৫৯) তৈরির সময় সিনেমায় হাতেখড়ি সহকারী পরিচালক হিসেবে। ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির পরিচালক, এ ছাড়াও বহু ছবির প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার। পাকিস্তানের বয়োকনিষ্ঠ চিত্রপরিচালক তিনি, প্রথম ছবি কখনো আসেনি (১৯৬১) তৈরি করেন ছাব্বিশ বছর বয়সে। নারীর বন্দিজীবনের আর্তনাদ, স্বপ্নের ট্র্যাজিক পরিণতি চিত্রায়িত এ ছবিতে। দ্বিতীয় ছবি কাচের দেয়াল-এ দেখা মেলে এক বিদ্রোহী-তরুণীর, ঢাকার ছবিতে সেই প্রথম অচলায়তন-ভাঙা এক নারীর উপস্থিতি।
উর্দুতে তৈরি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি সঙ্গম (১৯৬৪) ও প্রথম সিনেমাস্কোপ-ছবি বাহানা (১৯৬৫) তৈরি করে সমগ্র পাকিস্তানের চিত্রজগতে সাড়া ফেলেন তিনি। ১৯৬৬-তে তৈরি করেন বেহুলা, লোককাহিনি-ভাঙা এ ছবিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপমৃত্যু, জনবিদ্রোহ ও অপহৃত আকাঙ্ক্ষার পুনর্জন্ম-সম্ভাবনা উদ্ভাসিত। বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রাভিনেতা আবদুর রাজ্জাকের অভিষেক এ ছবিতেই।
তাঁর জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) পাকিস্তান আমলের প্রথম রাজনৈতিক ছবি, যার শুরু ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানে প্রভাতফেরির দৃশ্য-দিয়ে, আর শেষ ভাষারাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মবার্তা, নবজাতক ‘মুক্তি’র চিৎকারে। এ ছবিতে ব্যবহৃত পাঁচটি গানের মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরে হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। জীবনের শেষ এই কাহিনিচিত্রে জহির রায়হান বাঙালির স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন সহজ সাধারণ পরিবারিক ঘটনার মাধ্যমে। বড় বোনের আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের রূপক হয়ে ওঠে। এ ছবির নির্মাণকালে সরকারি নজরদারি, শুটিং ফ্লোর বন্ধ করে দেওয়া, পরিচালক ও প্রধান অভিনেতাকে গ্রেফতার, কী হয়নি! পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা সেন্সর বোর্ডে ছবিটি আটকানোরও ষড়যন্ত্র করে। গণরোষে প্রথমে মুক্তি দিলেও, সে দিনই ছবি নিষিদ্ধ করে সরকার। ফের গণবিক্ষোভে মুক্তি পায় ছবিটি। ১৯৭১-এর কলকাতায় জীবন থেকে নেয়া দেখে প্রশংসা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ।
১৯৭১-এর ২১ এপ্রিল কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন জহির রায়হান। ক্যামেরা-কাঁধে রণাঙ্গন থেকে পাকিস্তানি বর্বরতা তুলে ধরেন, তৈরি করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল স্টপ জেনোসাইড, আ স্টেট ইজ় বর্ন, লিবারেশন ফাইটার্স, ইনোসেন্ট মিলিয়নস। ইন্দিরা গাঁধী ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন স্টপ জেনোসাইড ছবিটির, আন্তর্জাতিক মহলেও পুরস্কৃত হয় এ ছবি।
একাত্তরের মাঝামাঝি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পী ও কুশলী সমিতি’-র সভাপতি এবং ‘বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক জহির রায়হান কলকাতায় আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বাঙালি-নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের-প্রাক্কালে তাঁর ও আলমগীর কবীরের নেতৃত্বে দু’টি চলচ্চিত্র-ইউনিট বাংলাদেশের রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা ও মিত্র বাহিনীর অগ্রাভিযান ক্যামেরায় ধরে রাখে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরেন তিনি। পাক সেনাবাহিনীর দোসর আল বদর বাহিনীর হাতে অপহৃত সহোদর শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বেরিয়ে, ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারি ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণে নিহত হন প্রতিভাবান এই চলচ্চিত্রকার। জহির রায়হানের বয়স তখন মাত্র ছত্রিশ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy