অলীক: নিউ ইয়র্ক শহরের টুইন টাওয়ার্স এখন ইতিহাসের ছবি।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আবহমান সন্ত্রাসের ইতিবৃত্তে ৯/১১ নিঃসন্দেহে এক পরিবর্তন-বিন্দু। আধুনিক সন্ত্রাসের দু’দশক পূর্তি আজ। সে দিন সকাল ৮:৪৬’এ আমেরিকা পরিণত হয়েছে এক রূপান্তরিত দেশে। দু’দশক পেরোলেও এই রূপান্তরের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা অব্যাহত। হতভম্ভ আমেরিকানরা হাতড়ে চলেন ৯/১১-র নেপথ্য ঘটনাবলি, যার ইতিহাস বিস্তৃত সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে আধ শতক ধরে। ইসলামি মৌলবাদের বৃদ্ধি, আল কায়দার উত্থান, এবং গোয়েন্দা-ব্যর্থতার মধ্যে কোনটার কতটা প্রভাব তার হিসেব কষতেই তাঁরা হিমশিম। ৯/১১ কমিশনের রিপোর্ট বলছে, আমেরিকার প্রধান ব্যর্থতা ছিল কল্পনাশক্তির অভাব। তাঁরা ভাবতেই পারেননি এক ডজন সন্ত্রাসী প্লেন চালানো শিখবে, বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক বিমানকে বক্সকাটারের সাহায্যে ছিনতাই করবে, এবং সেগুলিকে ক্ষেপণাস্ত্রে পরিণত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, সন্ত্রাসীরা কী ভাবে বিভেদের বীজ বপন করতে পারে, তাও ভাবেননি তাঁরা।
এ যুগের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ নাসিম নিকোলাস তালেব অবশ্য ৯/১১-কে বলেছেন সভ্যতার ইতিহাসের এক ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ঘটনা। আন্তর্জাল কিংবা পার্সোনাল কম্পিউটারের আবিষ্কার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েটের ভেঙে যাওয়ার মতোই। প্রবল প্রভাবসম্পন্ন যে ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করা অত্যন্ত কঠিন, ঘটে যাওয়ার পরে যার কার্যকারণের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় মাত্র।
ঘটনা হল, দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধেও বিশেষ আঁচড় পড়েনি আমেরিকার গায়ে, পার্ল হারবারের ঘটনা ছাড়া। আর ৯/১১-পরবর্তী আমেরিকা? নিজের ছায়া দেখেও যেন সে আঁতকে ওঠে। অবিশ্বাসের সেই কুয়াশা ক্রমে আচ্ছন্ন করে বাকি দুনিয়াকেও। পূর্ণগ্রাস গ্রহণ পাকাপাকি ভাবে গ্রাস করে সভ্যতাকে।
জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য নাকি কেবলই সন্ত্রাস। আর ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীর উচ্চারণে, যক্ষপুরীতে ছিল ‘ভয় দেখানোর ব্যবসা’। ফলে ৯/১১ যারা ঘটিয়েছিল, তারা প্রবল ভাবে সফল। প্রতি দিন স্পষ্ট হয়, অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে এই লড়াই বাস্তবিকই কত কঠিন, প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ভুক্ত। রক্তবীজের মতো এক ফোঁটা রক্ত থেকে তৈরি হয় নতুন দানব। যেমন, আমেরিকা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে বটে, কিন্তু ইতিমধ্যে আল কায়দা বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে।
বহু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদীর সামাজিক কিংবা ধর্মীয় পরিচয় ব্যাহত করে সমাজের সুস্থিতি আর সহাবস্থানের পরিবেশ। যেমন ধরা যাক, আমানি অল-খাটাটবা’র কথা। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর তার নিউ জার্সির বাড়ি থেকেই ন’বছরের মেয়ে আমানি দুটো প্লেনকে আছড়ে পড়তে দেখে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। সে বছরেই সে প্রথম সম্মুখীন হয় জাতিবিদ্বেষের। দু’বছর পরে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে, আর এক বদলে যাওয়া আমেরিকান সমাজের বিচ্ছিন্নতার তীব্র অনুভব ক্রমে গ্রাস করে আমানিকে। ২০১৬-তে লেখা মুসলিম গার্ল: আ কামিং অব এজ শীর্ষক বইতে ৯/১১-পরবর্তী আমেরিকার সমাজে তার বড় হয়ে ওঠার অসাধারণ বিবরণকে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে আক্ষরিক অর্থে ‘আমেরিকান অভিজ্ঞতা’, আমেরিকান সমাজের ৯/১১-র শিশু-কিশোররা ওই একটা দিনের ধ্বংসাত্মক বোঝা বহন করে চলে তাদের বাকি জীবন ধরে। সমাজের গঠনশৈলী, তার বাঁধন, সব কিছু বদলে যায়। এক অবিশ্বাসের অচ্ছেদ্য নাগপাশে আটকে পড়ে হাঁসফাঁস করে মানুষের সভ্যতা।
দুনিয়া জুড়ে অবিশ্বাস এবং নিরাপত্তা-হীনতার আবহ বিস্তার করা ছাড়া আর কী চায় সন্ত্রাসীরা? জানান দিতে চায় নিজেদের অস্তিত্ব, চায় প্রচার আর পরিচিতি। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পর ঘটা করে তার দায়ভার স্বীকার করে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। ২০১৯-এর গোড়ার দিকে ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসবাদী ঘটনার পরে নিউ জ়িল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন ঠিক এই জায়গাতেই হারাতে চাইলেন সন্ত্রাসীদের। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন না, অপরাধীদের অবমাননা করার চেষ্টাও করলেন না। পর্দার আড়ালে থাকা সন্ত্রাসীদের স্বীকৃতি না দেওয়াটাই হল জেসিন্ডার যুদ্ধ। তিনি তাদের অগ্রাহ্য করলেন, সন্ত্রাসীর নামটাকেও পর্দার আড়ালে রেখে।
মানুষের ইতিহাসের আদি পর্ব থেকেই গদা হাতে, মুষল হাতে সন্ত্রাসবাদীরা চিরকালই লন্ডভন্ড করেছে সমুদ্র-পর্বত। ক্যালিগুলা থেকে রোবস্পিয়ার, নাৎসি জার্মানি থেকে স্তালিনের রাশিয়া, সবই সন্ত্রাসের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আয়ার্ল্যান্ড থেকে স্পেন, শ্রীলঙ্কা থেকে প্যালেস্টাইন, এল সালভাদোর থেকে গুয়াতেমালা, নাইজেরিয়া থেকে আফগানিস্তান— সন্ত্রাসের রকমফের রয়েছে নিশ্চয়ই। তবে প্রথম ও প্রধান মিল এদের প্রাণহানির চেষ্টায়। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের পরেও তো বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাস বড় কম ঘটেনি। মুম্বই, লন্ডন, প্যারিস, নিস, ব্রাসেলস, ক্রাইস্টচার্চ বার বার কেঁপে ওঠে সন্ত্রাসের প্রকোপে। ৯/১১-উত্তর দুনিয়াতে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াইটা হয়ে পড়েছে আরও কঠিন। নিরাপত্তা-বলয় যতই প্রবল হোক, লখিন্দরের বাসর ঘরে ছিদ্র থেকেই যায়। আর সন্ত্রাসের একমাত্র ধর্ম হয়ে ওঠে সন্ত্রাস, তার একমাত্র কর্ম সন্ত্রাস থেকে আরও সন্ত্রাস— মধ্যেই তার রূপরেখার বিন্যাস।
প্রত্যাঘাতেরও চেষ্টা হয়েছে বার বার। দানব-দমনের এই চেষ্টাকে বলা হয়েছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণের পরে পরেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ঘোষণা করে দিলেন যে, এর পিছনের কুশীলবদের খুঁজে বার করে শাস্তি দেবে আমেরিকা। অন্তরালে থাকা ‘সর্দার’দের খুঁজতে গিয়ে আমেরিকা কিন্তু নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও দু’দশকের আফগানিস্তান যুদ্ধ কোনওক্রমে শেষ করতে হয়, সন্ত্রাস থেকে যায় অধরা। এর মাঝে আমেরিকার বুকে আর কোনও বড়সড় হামলা হয়নি ঠিকই, কিন্তু বিশ্বের অন্যত্র সন্ত্রাসবাদ থেমে থাকেনি।
যা-ই হোক, ৯/১১-র পরে যখনই সন্ত্রাসের নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে কোনও দেশ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধানের কণ্ঠে শোনা গিয়েছে জর্জ বুশের উচ্চারণের প্রতিধ্বনি। যেমন, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী অ্যান্ডার্স ব্রেভিকের হাতে ৭৭ জনের হত্যার পরে ২০১১-তে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইয়েনস স্টলটেনবার্গ, ২০১৩-তে বস্টন ম্যারাথন বম্বিং-এর পরে বারাক ওবামা, ২০১৫-তে প্যারিসে শার্লি এবদো-র কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে ১২ জনের হত্যার পরে ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাই হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় এবং প্রথাগত স্টাইল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধটা যেন ছায়ার সঙ্গে কুস্তি— নিজের গা ব্যথা হওয়াটাই তার প্রধান পরিণতি।
সত্যি বলতে কী, এই অদৃশ্য ছায়া-সন্ত্রাস আজ সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। কুড়ি বছর পরে আফগানিস্তানের ঘটনাবলি, সেখান থেকে উৎসারিত অনাগত সন্ত্রাসের সম্ভাবনা বুঝিয়ে দেয়, কিছু কিছু ক্ষতের নিরাময় হয় না, কেবল বিষ ছড়িয়ে যাওয়াই তার কাজ, অন্তের দিকে এগোনোই তার অর্থ।
৯/১১ যেন অতিমারির থেকেও চিরস্থায়ী। অতিমারি নিশ্চয় এক দিন স্তিমিত হবে, মানুষ এগিয়ে চলবে জীবনের পথে। ৯/১১-র প্রভাব শেষ হবে না। এক নিরন্তর ভয় তাড়িয়ে ফিরবে সভ্যতাকে। ক্যালেন্ডারের একটা তারিখ বেঁচে থাকার অর্থটা বদলে দিয়েছে বিশ বছরে। সেই অর্থ হল ‘অবিশ্বাস’— ৯/১১-র উত্তরাধিকার।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy