Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
Devi Prasad Roy Choudhury

‘মন যা খোঁজে তা আনন্দ’

চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী সারা জীবন ক্লান্তিহীন অন্বেষণ চালিয়েছেন অজানার উদ্দেশে আনন্দকে বহমান রাখার জন্য। অবনীন্দ্রনাথ শিষ্যকে পাঠিয়েছিলেন নন্দলাল বসুর কাছে, বাংলার পটচিত্রের সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য।

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫৯
Share: Save:

নিজের সদ্য আঁকা ছবির দোষত্রুটিগুলি চিহ্নিত করে শিষ্য দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীকে অঙ্কনশিক্ষার দীক্ষা দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গুরু-সান্নিধ্যে নিত্য যেতেন দেবীপ্রসাদ। দক্ষিণের বারান্দায় তন্ময় ধ্যানে ছবি আঁকতেন অবনীন্দ্রনাথ, তাঁকে বিরক্ত না করে গুরুর তুলি-চালনা, রং প্রক্ষেপণ দেখে যেতেন শিষ্য। এক দিন অবনীন্দ্রনাথ সদ্য আঁকা ছবিটি দেখিয়ে জানতে চাইলেন ত্রুটিগুলি সে চিহ্নিত করতে পারছে কি না। তরুণ দেবীপ্রসাদ বাক্‌রুদ্ধ, কী বলবেন তিনি! আলোচ্য ছবিটির নাম ‘কমরেডস’, একটি বাঁদর একটি ছাগলের রোঁয়া থেকে উকুন বেছে দিচ্ছে। ছাত্রকে নিরুত্তর দেখে অবনীন্দ্রনাথ কোথায় কী বাদ পড়েছে, কোথায় কী ত্রুটি আছে বলে যেতে লাগলেন। নিজের কাজের ভুল দেখিয়ে শিষ্যকে শিক্ষাদানের এই ঔদার্য দেবীপ্রসাদকে সে দিন মুগ্ধ, বিস্মিত করেছিল।

অনেক পরে, দেবীপ্রসাদ যখন বিখ্যাত, তখন গুরু-শিষ্য-সংবাদের বিবরণ ও ছবি-দেখা বিষয়ে লিখেছেন: “সব কিছু জানার মধ্যে কী একটা অজানার সন্ধানে মন দৃশ্যরূপের বাইরে চলে যেতে চায়। মন যা খোঁজে তা আনন্দ, নিরবচ্ছিন্ন উপলব্ধির বস্তু, বিবরণ দিয়ে প্রকাশ করবার উপায় নেই।… তাঁর (অবনীন্দ্রনাথের) ছবিকে সূত্র করে এই আনন্দ ভোগের অধিকার পেয়েছিলাম।… তাঁর মিহি কাজের মধ্যেই যে শক্তি আত্মগোপন করে থাকে ধীরে ধীরে আমার কাছে তা প্রকাশিত হচ্ছিল।”

চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী সারা জীবন ক্লান্তিহীন অন্বেষণ চালিয়েছেন অজানার উদ্দেশে আনন্দকে বহমান রাখার জন্য। অবনীন্দ্রনাথ শিষ্যকে পাঠিয়েছিলেন নন্দলাল বসুর কাছে, বাংলার পটচিত্রের সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য। পটচিত্রের রেখায় আছে শক্তি, উদ্দেশ্য এবং বহু দিনের সাধনার দৃষ্টান্ত। ভ্রাতৃপ্রতিম দেবীপ্রসাদকে ‘নন্দদা’ দিয়েছিলেন বীজমন্ত্র: “ছবির রূপকে ভয় কোরো না। ওদের নিয়ে খেলা করতে শেখো, ভারি মজা পাবে।” ওই সময়েই একটা পর্বে মূর্তি রচনার বাসনা পেয়ে বসল দেবীপ্রসাদকে। গুরু হিসাবে পেলেন হিরন্ময় রায়চৌধুরীকে: রাজা প্রফুল্ল ঠাকুরের শ্যালক, পাথুরিয়াঘাটায় তাঁর স্টুডিয়ো করে দিয়েছিলেন স্বয়ং রাজাবাহাদুর। সেখানে ‘খাঁটি সাহেবি চালে মাটি দিয়ে মাংসের রূপ গড়তে’ শিখলেন দেবীপ্রসাদ।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, আরও অনেক শিক্ষকের নাম স্মরণ করেছেন এই শিল্পী, অথচ হেঁটেছেন নিজের তৈরি পথে। তবে তাঁর চিত্রকর পরিচয় ঢাকা পড়েছে ভাস্কর পরিচয়ের খ্যাতিতে। কিন্তু সেই দেবীপ্রসাদকেও কি আমরা মনে রেখেছি? তাঁর জন্ম ১৮৯৯-এর ১৫ জুন, ১২৫ বছর পেরিয়ে গেলেন সম্প্রতি। সে ভাবে তাঁকে মনে করলাম কই?

নরেন্দ্র মোদী সরকারের নোটবন্দির কারাগারে পুরনো পাঁচশো টাকার নোট নিক্ষেপ করতে না হলে আজ‌ও আমরা পকেটে দেবীপ্রসাদের ‘কাজ’ নিয়েই ঘুরে বেড়াতাম। ওই নোটে মহাত্মা গান্ধী ও আর‌ও দশ ব্যক্তিত্বের যে ছবি আমাদের পরিচিত ছিল, তার মূল ভাস্কর্যটি আছে দিল্লিতে। জীবনের শেষ দশ বছর ধরে এই কাজটি শিল্পী করেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলার স্টুডিয়োতে। জাতীয় সংহতির মূর্ত প্রতীক এই শিল্পে গান্ধীজির অনুগামী রাজপুত, অসমিয়া বৃদ্ধ ও পুত্র, ওড়িয়া ও বাঙালি মেয়ে, খ্রিস্টান ফাদার, বিহারি বালক, মাদ্রাজি ও মুসলমান পুরুষ। আবার পটনায় দেখা যাবে সাত স্বাধীনতা সংগ্রামীর অকুতোভয় এগিয়ে চলার ভাস্কর্য, গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেও তেরঙ্গা হাতে অবিচল। ভারত সরকার ১৯৬৭-র ১ অক্টোবর এই মূর্তির ছবি দিয়ে পনেরো পয়সার একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রজত জয়ন্তীতে। চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে আছে ভাস্কর্য ‘শ্রমের জয়যাত্রা’, চার শ্রমিক প্রাণপাত শ্রমে একটি বিরাট পাথরকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

কলকাতায় যে গান্ধীমূর্তির পাদদেশ প্রতিবাদের সমাবেশস্থল, সেও দেবীপ্রসাদের গড়া। ১৯৫৮-র ১ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, আগের দিন পাঁচ লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন জওহরলাল নেহরু। চৌরঙ্গি ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থলে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ব্রোঞ্জমূর্তিটিও তাঁর তৈরি। কার্জ়ন পার্কে ১৯৪১-এ প্রতিষ্ঠিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাস্কর্যে উদ্ভাসিত বাগ্মী রাষ্ট্রগুরু।

দেবীপ্রসাদের পিতামহ-মাতামহ দু’জনেই ছিলেন জমিদার। চিত্রকরবৃত্তি তাঁদের চোখে ‘কুলাঙ্গারের কাজ’ ছিল, তাই পরিবারের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি। শিল্প বিষয়ক নানা চাকরি করেছেন, থিতু হয়েছেন মাদ্রাজে, শেষ জীবন নানা কর্মোদ্যমে কাটিয়েছেন কলকাতায়। জীবনীকার প্রশান্ত দাঁ শিল্পীর ৬২টি ভাস্কর্য, ১৩০টি চিত্রশিল্পের তালিকা তৈরি করেছেন সযত্নে; দেবীপ্রসাদের গ্রন্থতালিকাও। আনন্দবাজার পত্রিকা-র ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের শারদীয় সংখ্যায় পোড়োবাড়ি উপন্যাস, বা জঙ্গল, বুভুক্ষু মানব-এর মতো গল্পগ্রন্থের শিকার কাহিনিগুলি একদা পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। নিজের সাহিত্যচর্চা বিষয়ে প্রিয় বন্ধু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন: “আত্মপ্রকাশের নিত্যনতুন পথের সন্ধান করতেই আমি ভালোবাসি।” এই উক্তিতে মিশে তাঁর জীবনের প্রথম পর্বের সেই শিক্ষা— আনন্দকে বহমান রাখতে ক্লান্তিহীন অন্বেষণ‌ই শিল্পীর যাত্রাপথের সারসত্য। তার মাধ্যম কখন‌ও তুলি, কখন‌ও ছেনি-হাতুড়ি, কখনও কলম।

অন্য বিষয়গুলি:

artist Painter Sculptor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE