দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনার মতো জেলায়, সমুদ্র ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলিতে প্রতি বছর বর্ষায় ও ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে, সমুদ্রের লোনা জল ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম ভাসে। ভাঙা বাঁধ ফের মেরামত হয়, বিপর্যস্ত এলাকার মানুষ প্রতি বছর একেই ভবিতব্য মেনে ঘরে ফেরেন, বা সব হারিয়েও আবার গড়ে তোলেন ঘর, জীবন। ফের পরের বছর বাঁধ ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা। প্রতি বছর নিয়ম করে বিপর্যয় আর তার পর সরকারি-অসরকারি ত্রাণ, কোনও স্থায়ী সুরাহা কি হতে পারে না? অনেকের মতে, মাটির বাঁধ মজবুত হয় না, জলের তোড়ে ভেঙে যায়, তাই কংক্রিটের পাকা বাঁধ করা দরকার। কিন্তু বিপর্যয় সামলানোর সেটাই কি একমাত্র সমাধান?
ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক চেহারাটা এক বার দেখে নেওয়া যাক। উপমহাদেশের ভূ-স্তর ঢেউ খেলানো, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রয়েছে কতকগুলো ছোট-বড় ভাঁজ। দেখা যায়, ৯ ডিগ্রি অক্ষরেখা থেকে উত্তরাভিমুখী আনুমানিক প্রতি চার ডিগ্রি অন্তর তিনটে বড় ভাঁজ এবং সংলগ্ন বড় নদী। পূর্ব ও পশ্চিম তটরেখার আকৃতি অনেকটা হারমোনিয়াম রিডের মতো। ভাঁজের উত্তল অংশ সমুদ্রের তটে গিয়ে প্রসারিত, আর অবতলের ভিতরে সমুদ্র ঢুকে এসেছে। পূর্ব দিকের ছবিটা বেশি স্পষ্ট। আর ২১ ডিগ্রি অক্ষরেখার উত্তরে দু’দিকেই স্থলভাগ অনেকটা ছড়ানো, পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র আর পূর্বে সাগর দ্বীপপুঞ্জ। ভূগাঠনিক প্রক্রিয়াই এর জন্যে দায়ী। এ ছাড়াও, ভূবিজ্ঞানীরা বলেন গোটা ভারতীয় প্লেট পূর্ব দিকে হেলে রয়েছে, যে কারণে সে দিকের সমুদ্রজলের মাত্রা একটু একটু করে বাড়ছে (তামিলনাড়ুর কিছু অংশ ছাড়া), আর পশ্চিমে মাত্রা আপেক্ষিক ভাবে কমছে। ২১ ডিগ্রির উত্তরে অক্ষরেখা বরাবর দুই উপকূলেই একটা চ্যুতিরও (ফল্ট) খোঁজ পাওয়া গেছে। এ দিকে পূর্ব ও পশ্চিম দু’দিকেই উপতট থেকে স্থলের ভিতর পর্যন্ত দ্রাঘিমা বরাবর বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে একাধিক চ্যুতি রয়েছে। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম দুটো মহাদেশীয় উপতটেই সমুদ্রতল ও সংলগ্ন স্থলভাগের কিছু অংশের অবনমন। পূর্ব উপতটে এই অবনমনের পরিমাণ বছরে ১.৩ সেন্টিমিটার, কলকাতার দক্ষিণে একটু বেশি, ১.৫ সেন্টিমিটার। এর জন্য সমুদ্রের জলের মাত্রা আপেক্ষিক বৃদ্ধি পায়। হিমালয় থেকে উদ্ভূত গঙ্গা সাগরের কাছে এসে একাধিক শাখানদীতে ভাগ হয়ে বিশাল পরিমাণ পলি এনে ফেলে সমুদ্রে। নদীবাহিত পলি সমুদ্রে পড়ে আবার সমুদ্রোচ্ছ্বাসে ফিরে আসছে নদীর প্লাবনভূমিতেই। নদীর পলিও দু’কূল ছাপিয়ে সেই প্লাবনভূমিতেই জমা হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসের সময় মাটির বাঁধ এই অতিরিক্ত পলির চাপ ধরে রাখতে পারে না, ভেঙে যায়। এই প্রক্রিয়ায় কিছু চর যেমন তৈরি হচ্ছে, আবার কিছু চর ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙা-গড়ার এই খেলা চলছে হাজার হাজার বছর ধরে, আজকের মানুষ বড়জোর দু-একশো বছরের ইতিহাস নিয়ে তোলপাড় করছে। দ্বীপ, চর এ সবের ভাঙন রোখার সাধ্য ওই বাঁধের নেই। সমুদ্রের জল ক্রমশই ভিতরে ঢুকে আসবে। চার হাজার বছর আগেও সমুদ্রের জলের মাত্রা প্রায় চার মিটার বৃদ্ধি পেয়ে স্থলভূমির অনেকটা অংশ প্লাবিত করেছিল, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ভূবিজ্ঞানীরা সেই চিহ্ন পেয়েছেন।
সুন্দরবন উপকূলবর্তী এলাকায় মাটির বাঁধ বন্যা রোধে অক্ষম। ম্যানগ্রোভ ও কংক্রিটের লম্বা, উঁচু বাঁধ জলের তোড় কিছু সময়ের জন্যে আটকাতে পারলেও এই অঞ্চলের ভূগাঠনিক কারণে অবনমন আটকানো যাবে না। ধীরে ধীরে সমুদ্রের জল ঢুকে গ্রাস করবে, এই সত্যকে মেনে পরবর্তী পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে। দ্বীপবাসীদের অনেকে এ সত্য বুঝেছেন, বছরের পর বছর জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন দেখে অভিজ্ঞ হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিতে কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে আপাতত বিপর্যয় আটকানোর ব্যবস্থা করতে হবে, সঙ্গে এলাকার মানুষদেরও বোঝাতে হবে, এখানে আর বেশি দিন বাস করা যাবে না। সরকারি-অসরকারি সাময়িক ত্রাণ স্থায়ী সুরাহা নয়। পুনর্বাসন ও জীবিকার পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে, তার কাজও শুরু করতে হবে। প্রথমে সাগরের নিকটবর্তী মানুষদের উপযুক্ত জায়গায় পুনর্বাসন করতে হবে, ক্রমে ভিতরের দিকের মানুষদের। এ ভাবে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা করতে হবে। যে হেতু উপতট ও সংলগ্ন স্থলভাগের ঢাল অনেক কম, আগামী পাঁচ দশকের মধ্যে সমুদ্র অনেকটাই ভিতরে চলে আসতে পারে বলে অনুমান। অনেকে সমুদ্রজলের মাত্রার নীচে থাকা সিঙ্গাপুর ও নেদারল্যান্ডসের সমুদ্র-বরাবর কংক্রিটের দেওয়াল তুলে জল আটকানোর পদ্ধতির উল্লেখ করে সে ব্যবস্থা এখানেও প্রয়োগের কথা বলেন, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের উত্তর ভাগে এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও পলির চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। তাই এই অঞ্চলের সমাধানও আলাদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy