পাশেই: দুর্গাপুজোর সময় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসার প্রতিবাদে মিছিল। ১৮ অক্টোবর, ঢাকা। রয়টার্স ।
কবি শামসুর রাহমানের পঁচাত্তরতম জন্মদিনে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের পাশে চারুকলা বিভাগের চত্বরে এক চমকপ্রদ অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই কাতারে কাতারে মানুষ আসছেন। ক্ষমতাবান বা প্রথম সারির মানুষ বাদ দিয়েও ধরা যাক ফরিদপুর আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র বা মাদারিপুর কচিকাঁচা দল— এমন অজস্র সংস্থার তরফ থেকে মঞ্চে উপবিষ্ট কবিকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। একটি ট্রাক ভরে উঠছে শুধু ফুলের উপহারে। খানিক ক্ষণের জন্য আলো চলে গেলে চার পাশে থাকা গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল এক মুহূর্তে। হতবাক আমি ভাবছিলাম, বাংলা ভাষার এক কবিকে কেন এ ভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়? পরে বুঝেছি হয় এই কারণে যে, ওই দেশে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বহু সংখ্যক কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে এসেছেন। সাধারণ মানুষের, ছাত্রদের আন্দোলনের পুরোভাগে থেকেছেন কবি লেখকরা। যে বার প্রথম সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত শহিদ গদ্যকার শহীদুল্লাহ কায়সার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক জহির রায়হানদের ব্যক্তিগত ব্যবহারসামগ্রী, চিঠিপত্র দেখেছিলাম, বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা শিলালিপি সম্পাদক, সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের পিছমোড়া লাশের ছবির সঙ্গে অগণিত অনামা করোটি হাড়ের স্তূপ দেখে বমি চাপতে হচ্ছিল, সে দিনই বুঝেছিলাম যে, অতি সরলীকরণে বাংলাদেশের মানসিকতা বিচার করলে ভুল হবে। ১৯৪৭ সালে যে দেশ আমরা অনেকেই ছেড়ে এসেছি, এ দেশ সেই দেশ নয়। নিজের ধর্মকে অস্বীকার না করেও তাকে পাশে সরিয়ে বাঙালি জাতি হিসাবে নিজের পরিচয় তৈরি করতে হয়েছে তাকে। এ বড় সহজ কাজ নয়।
ঢাকার জাতীয় কবিতা উৎসবের আমন্ত্রণে ঢাকা ক্লাবে প্রাতরাশ টেবিলে জমে উঠেছিল তুরস্কের এক কবি নাট্যকার বন্ধু ও তার এক মিশরীয় সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা। আরব বসন্তের সাক্ষী মিশরের সাংবাদিক নানা চিত্তাকর্ষক ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা শুরু করলেন। তুর্কি কবি বন্ধু যোগ দিলেন তাতে। উপমহাদেশের এক নেত্রী একটি ছোট দেশকে হেনরি কিসিঞ্জার কথিত ‘তলবিহীন ঝুড়ি’ থেকে তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে যথাসম্ভব সতর্কতায় ও কৌশলে উন্নয়নশীল দেশের দিকে নিয়ে চলেছেন, যেখানে মধ্য এশিয়া, আরব দুনিয়ার অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলিতেও দীর্ঘস্থায়ী সুস্থিতি, গণতন্ত্র বলে কিছুই নেই। আপেক্ষিক ও তুল্যমূল্য বিচারেই তাঁদের এই মন্তব্য ধরে নিলেও এর সারবত্তা অস্বীকার করা যায় না। আমার কাছে তাঁরা এই কবিতা উৎসব বিষয়ে জানতে চাইলেন, যার সূত্রপাত এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে কবি লেখকরা সেখানেও সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নুরুল হুদা থেকে তরুণ রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ সামাদ, মোহন রায়হান, তারিক সুজাতরা এই আন্দোলন-জাত প্রতিবাদের কবিতা উৎসবে বিভিন্ন সময়ে জড়িত থেকেছেন। এই কবিতা উৎসবের সূচনায় আমরা কবি আসাদ চৌধুরীকে বলতে শুনেছি, অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালিত্বের চেতনাকে লালন করে দেশের সব ক্রান্তিকালে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে তাঁদের কবিতা পরিষদ। আলোচকদের মুখে আমরা শুনেছি, উৎসবের পৃথক চরিত্রটি ধরে রাখতে কখনও কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মুহম্মদ নূরুল হুদা স্পষ্ট করেছেন, স্মরণপূর্ব কাল থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালি টিকে আছে নিদেনপক্ষে তার ব্যক্তিপরিচয়ে।
এর পরে আমরা শাহবাগে বড় মাপের ছাত্র-আন্দোলন দেখতে পেয়েছি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের জঘন্যতম যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ায় ক্ষুব্ধ জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। রাষ্ট্রের শাস্তির পরোয়া না করা সেই তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের অভিঘাত সারা বিশ্ব দেখেছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আবেগজাত অসংগঠিত আন্দোলনকে সুযোগান্বেষীরা ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং কখনও কখনও সফলও হয়। কিন্তু তার পাশে আবারও জায়গা করে নেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের শুভ ইচ্ছাকে আমরা খাটো করে দেখতে পারি না। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির বিচার নয়, নাগরিক সমাজ, ছাত্রদল ও বুদ্ধিজীবীর এই উপস্থিতি আমাদের আস্থা জোগায়।
আজ প্রতিবেশী দেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নির্যাতন, মন্দির ভাঙা নিয়ে চতুর্দিক স্বাভাবিক ভাবেই উত্তাল। মৌলবাদীদের এই উৎপীড়ন ও ধ্বংস এখন দিকে দিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা কত অসহায়। এই মৌলবাদী ধর্মান্ধতার সামনে কোনও নিন্দাই যেন যথেষ্ট নয়। বারংবার এই ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে যাচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই মৌলবাদের দাপট আজ প্রবল আকার নিয়েছে। নব্য নাৎসি আর মৌলবাদীদের আগ্রাসী আক্রমণে বহু দেশেই সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে। এই ইতর সময়ে ক্রমশই আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে দেখছি প্রতিবেশী আত্মীয়বন্ধুদেরও। পেশি মদমত্ততার আস্ফালনই যেন একমাত্র পথ, বাকি সব আদর্শ আজ বিস্মৃত।
এমতাবস্থায় প্রতিবাদীদের দেখে যদি নিজেকে প্রশ্ন করি যে, অনুরূপ ঘটনায় আমরা কি এ দেশে এমনটা করতে পারছি? আদৌ কি প্রশ্ন করার মতো, পথে নেমে যাওয়ার মতো সাহস আমাদের আছে? যে কোনও সঙ্কটকালেই কবি লেখক বুদ্ধিজীবীদের দিকে আঙুল ওঠে। তাঁদের অবস্থান নিয়ে কটাক্ষ চলে। বর্তমানের ভার্চুয়াল পৃথিবীতে প্রত্যেককেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়ে যেতে হয়। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ কি খুবই সহজ? মির্জ়া গালিবের মতো সংবেদনশীল কবিও ভারত ইতিহাসের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে শম্বুকনীতি গ্রহণ করে হৃদয় দ্বার রুদ্ধ রেখেছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় লাঞ্ছনা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করার পরেও দস্তম্বুতে শুধু ইংরেজ সরকার নয়, ইংরেজ সৈন্যদের প্রশংসা করে, মহারানি ভিক্টোরিয়ার দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক ‘কসিদা’ লিখে গ্রন্থটি সমাপ্ত করেন।
আজ আমরা সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের কবি-লেখকদের পথে নামতে দেখছি। শাহবাগে জড়ো হতে দেখছি দলে দলে ছাত্র-সহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে। মন্দির ধ্বংসের যত ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে, তার সঙ্গে জড়ো হচ্ছে প্রতিবাদের দলিলও। আজও রাজনৈতিক নেতা নন, বাংলাদেশের আলোর ফুলকি তরুণ ছাত্রদল ও কবি লেখক বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজই। পারলে তাঁরাই পারবেন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম অন্যায়ের বিরুদ্ধে দলে দলে পথে নেমেছেন যে সব ছাত্র কবি শিল্পী বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ, তাঁদের তো অদৃশ্য-প্রায় মানুষের মতো উড়িয়ে দিতে পারি না! তাঁরা হয়তো সংখ্যালঘু, কিন্তু ক্রমশই তাঁদের দল ভারী হতে দেখছি।
অবশ্য, যদি তাঁদের আমরা দেখতে চাই, তবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy