বাংলাকে বাঁচাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১০০ রানের পার্টনারশিপ গড়েছেন এক মুসলিম এবং এক হিন্দু যুবক। ছবি: পিটিআই।
প্রথম সেশনেই বাংলার ৫ উইকেট ডাউন! রান তখন বোধহয় টেনেটুনে তিরিশের কোঠায়। ক্লাব হাউসের লোয়ার টায়ারের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে দুই পেশাগত সহকর্মী অগ্নি পাণ্ডে আর রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে হা-হুতাশ করছি। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে গেলেন, ‘‘ম্যাচ এখনও ওপেন।’’
তেত্রিশ বছর আগে এই মাঠে এমনই একটি ফাইনালে যাঁর বদলে তাঁর ভাইয়ের রঞ্জি অভিষেক হয়েছিল এবং কালক্রমে যে ভাই ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়ক হয়েছিলেন, তাঁকে বলা যেত, সিএবি সভাপতি হলে এবং ঘরের মাঠে ঘরের টিম রঞ্জি ফাইনাল খেলতে নেমে এতটাই কাঁপু হয়ে পড়লে এ সব বলবর্ধক কথা বলতে হয় বটে। কিন্তু ‘ওপেন’ নয়, প্রথম দু’ওভারে তিন উইকেট চলে যাওয়ার পর এই ম্যাচ, আইনি পরিভাষায় যাকে বলে, ‘ওপেন অ্যান্ড শাট কেস’! শুরুর আগেই খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে।
বহু দিন পর ইডেনে গেলাম খেলা দেখতে। শেষ কবে গিয়েছিলাম মনে পড়ে না। সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজের লাল্লু-পাঞ্জু টিমের বিরুদ্ধে সচিন তেন্ডুলকরের ১৯৯তম টেস্ট ম্যাচে। না কি তা-ও নয়? তা হলে কি ১৫ বছর আগে আইপিএলের জন্মবছরে কেকেআরের ম্যাচ কভার করতে? না কি তার পরে কখনও গিয়েছি? তিন-চার বছর আগে রঞ্জি সেমিফাইনাল দেখতে গিয়েছিলাম কি? কে জানে! মোদ্দা কথা, কবে শেষ গিয়েছি মনে পড়ে না।
এ বার গিয়েছিলাম। কারণ, ৩৩ বছর পর ইডেনে রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল খেলছে বাংলা। ‘জয় বাংলা’, ‘জাগো বাংলা’ স্লোগানে ফেসবুক উত্তাল। ১৯৮৯ সালে এর আগে শেষ বার ইডেনে রঞ্জি ফাইনাল খেলেছিল আমাদের রাজ্য। জিতেছিল। খানিকটা ঘুরপথে যদিও। কোশেন্ট-ফোশেন্ট কী সব নিয়মের গুবলু ছিল। বৃষ্টি পড়লে এই, বৃষ্টি না পড়লে ওই, বৃষ্টি থেমে থেমে পড়লে আরও কী যেন। ওটা সবচেয়ে ভাল বুঝতেন অরুণ লাল। তিনিই চাবি-টাবি ঘুরিয়ে ফাইনাল জিতিয়ে দিলেন বাংলাকে। যে জন্য তাঁর নামই হয়ে গেল ‘কোশেন্ট লাল’! তার বছর আষ্টেক পরে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের ফলাফল নির্ণয়ের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে প্রথম ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড চালু হল। গোটা ক্রিকেটবিশ্ব যখন সেটা বুঝতে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন একটি কালজয়ী মন্তব্য করেছিলেন বাংলার সেই রঞ্জিজয়ী টিমের অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘‘ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডের ডাকওয়ার্থটা একা ডাকওয়ার্থ বোঝে। লুইসটা শুধু লুইস বোঝে। দুটোই বোঝে একমাত্র অরুণ লাল!’’
দুর্ঘটনাচক্রে, সম্বরণই স্বাধীন ভারতে বাংলার ইতিহাসে একমাত্র রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক হয়ে রয়ে গেলেন। এখনও পর্যন্ত। যখন ইডেনে তিনি ট্রফি জিতছেন, তখন আমি কুড়ির যুবক। এই পেশায় আসিনি (যদিও ঘটনাচক্রে তার এক বছর পরেই ‘শিক্ষানবিশ সাংবাদিক’ হয়ে কলম চিবোতে আসব)। কিন্তু ইডেনে রঞ্জি ফাইনালটা দেখতে গিয়েছিলাম। কারণ, তখনও ভাবতাম ক্রিকেট খেলে বড় হব। বাংলা সেই ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ঘরোয়া প্রতিযোগিতার ফাইনালে খেলছে। যাব না?
তেত্রিশ বছর কেটে গিয়েছে। ক্রিকেট এখন ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের নামান্তর। ক্রিকেট এখন ইন্ডাস্ট্রিও বটে। যাকে ঘিরে একটা সমান্তরাল ক্রীড়া অর্থনীতি চলে। ময়দান মার্কেটের ছোটখাটো দোকানে ইংলিশ উইলোর ছড়াছড়ি। কিট ব্যাগের বিবর্তন হয়েছে। কত স্মার্ট! আমাদের সময়ে এক পায়ে থাই প্যাড আর বড়জোর একটা এলবো গার্ড ছিল। এখন দু’পায়ে থাই প্যাড। সঙ্গে বুকের খাঁচা বাঁচানোর জন্য চেস্ট প্যাড। হেলমেট তো বাধ্যতামূলক! দিনভর ফিল্ডিং করার সময় রোদের তাতে সোনার বন্ন যাতে কালি-কালি না হয়ে যায়, তার জন্য গালে সান স্ক্রিন, চোখে ওকলের ঝিলিমিলি রোদচশমা। পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প। সেখানে ডাব, সন্দেশ এবং পেল্লাই কিট ব্যাগ নিয়ে বাবা-মায়েরা সন্তানদের ক্রিকেটার বানাতে ভিড় জমান। ইডেনে আইপিএলের ম্যাচে ভিড় উপচে পড়ে। চায়ের দোকান, মেট্রো এবং সমাজমাধ্যমে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের ভিড়।
তারই একটা অংশ কি সক্কাল সক্কাল ইডেনে পৌঁছে গিয়েছিল?
কোচ লক্ষ্ণীরতন শুক্ল এই বাংলা দলটাকে অন্য রকম করে দিয়েছেন বলে সারা মরসুম ধরে শুনেছি। ড্রেসিংরুমে অন্তর্দলীয় রাজনীতি এবং ‘গ্রুপিজ্ম’ বন্ধ করেছেন। সিএবি-র সঙ্গে মৃদু ঝামেলা করে হলেও ঘোষিত অধিনায়ক অভিমন্যু ঈশ্বরনকে সরিয়ে পোড়খাওয়া মনোজ তিওয়ারিকে দলের নেতা করেছেন। নেট প্র্যাকটিসের সময় নিয়ম করে বাংলার পতাকা টাঙানো হচ্ছে (এটা নাকি পাকিস্তান টিমও করে। তাতে দলের সঙ্গে একটা একাত্মতা তৈরি হয়)। গোটা দল নেট করছে ম্যাচের সাদা জার্সি-ট্রাউজার্স পরে। যাতে নেটেও মনে হয় আসলে ম্যাচই খেলছি। আরও আছে। নেটে নো-বল করলে বোলারের হাজার টাকা জরিমানা। ম্যাচে করলে দু’হাজার। আর ম্যাচের সেই নো-বলে যদি উইকেট পড়ে, তা হলে জরিমানা পাঁচ হাজার টাকা!
এই কড়া অনুশাসন, শৃঙ্খলা এবং অভিনবত্বে ভর করেই আবার রঞ্জি ফাইনালে পৌঁছেছেন লক্ষ্ণীছানারা। এই টিমের কাছে তা হলে ট্রফি তো আশা করাই যায়। নাকি?
দেখলাম, নাহ্, যায় না। এখন আর নিয়মিত স্থানীয় ক্রিকেটের খোঁজ রাখা হয় না। কিন্তু দেখা গেল জয়দেব উনাদকট, চেতন সাকারিয়াদের (যাঁরা আইপিএলে বেধড়ক ঠ্যাঙানি খেয়ে থাকেন) সামনে ঠকঠক করে কাঁপছে বাংলার ব্যাটিং। মনে হচ্ছে গ্রিন টপে ম্যাকগ্রা-গিলেসপি বল করছেন! দেখতে দেখতে ৬৫/৬ হয়ে গেল বাংলা। মনে হচ্ছিল গ্যালারি থেকে পোঁ-পোঁ শাঁখের আওয়াজ, ক্লাবহাউসে কিছু এবং তার দু’পাশের দু’টি ব্লকে আরও কয়েক হাজার অত্যুৎসাহীর সামনে ১০০-র আগেই না বান্ডিল হয়ে যান মনোজ-অনুষ্টুপেরা!
সন্দিগ্ধু মন বলছিল, খেলা আর নেই। রসিকতা করে প্রাক্তন সহকর্মী, বাংলা ক্রিকেটের অন্ধিসন্ধির খবর-রাখা বিশ্বজিৎ দাসকে বলেই ফেললাম, এত নিশ্চিন্তে হারবে যে, এই বাংলা দল প্রমাণ করে ছাড়বে, ক্রিকেট একেবারেই ‘মহান অনিশ্চয়তার খেলা’ নয়। টস হারলেই ম্যাচ হারা নিশ্চিত (রবিবার ইডেনে বাংলা এবং কোটলায় অস্ট্রেলিয়া প্রায় একই সময়ে যুগপৎ ভূপতিত হওয়ার পরে এই ফিচলেমিটা আরও পরিশোধিত হয়ে দাঁড়াবে— এর পর ইডেনে বাংলা বনাম অস্ট্রেলিয়া একটা ম্যাচ হোক। দেখা যাক কারা জেতে)!
সেখান থেকে প্রথম ইনিংসে বাংলার স্কোর যে খানিকটা ভদ্রস্থ জায়গায় পৌঁছল (১৭৪ রানে অলআউট), তার কৃতিত্ব দু’জনের। দিনের শেষে ধ্বস্ত দলকে নকড়া-ছকড়া হয়ে পড়ার গাড্ডা থেকে টেনে তুললেন শাহবাজ আহমেদ এবং অভিষেক পোড়েল। ১০১ রানের পার্টনারশিপ। তাতে অবশ্য শেষরক্ষা হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি। কিন্তু তাঁদের জুড়ি ইডেনকে সাময়িক অক্সিজেন দিয়েছিল বৈকি!
কিন্তু সেই সম্মানরক্ষার ক্রিকেট ছাপিয়েও মধ্যবয়সি ক্রিকেটামোদীর চোখে লেগে রইল দু’টি খণ্ডদৃশ্য। যার একটি অন্যটির সঙ্গে গাঁথা।
হাফসেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে দস্তানাবদ্ধ দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলেন শাহবাজ। তার কিছু পরে ৫০ পূর্ণ করলেন অভিষেক। হেলমেট-পরা মাথা ঈষৎ পিছন দিকে ঝুঁকিয়ে দু’হাত জোড় করে তাঁর ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, চুলোয় যাক হারজিত। এই পৃথিবীতে একমাত্র খেলার মাঠই পারে এই অনুপম সব দৃশ্য তৈরি করতে। বিশ্বকাপ জয়ের পর মরাঠি চিৎপাবন ব্রাহ্মণ সচিন তেন্ডুলকরকে কাঁধে তুলে নিয়ে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভিকট্রি ল্যাপ দিতে থাকেন বডোদরার জামা মসজিদের মুসলিম কর্মচারীর পুত্র ইউসুফ পাঠান। জার্মানিকে জেতাতে মুসলিম বংশোদ্ভূত মেসুট ওজিলকে গোলের পাস বাড়ান খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী টমাস মুলার। করিম বেঞ্জেমার সঙ্গে রিয়েল মাদ্রিদে ওয়াল খেলে গোলের মুখ খোলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। একাই সাত উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে শেষ করে দেওয়ার পর অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে রাজপুত রবীন্দ্র জাডেজার পিঠে চড়ে পড়েন নিজামের শহরের মুসলিম মহম্মদ সিরাজ। বাংলাকে বাঁচাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১০০ রানের পার্টনারশিপ গড়েন এক মুসলিম এবং এক হিন্দু যুবক। ব্যক্তিগত মাইলস্টোনে পৌঁছে দু’জনেই নিজের নিজের ধর্মাচরণ করে কৃতজ্ঞতা জানান নিজের নিজের আরাধ্যকে। তার পর আবার নতুন করে গার্ড নেন। একই লক্ষ্যে।
রঞ্জি ফাইনালে ইনিংসে হারটা কোনও ক্রমে বাঁচিয়েছে বাংলা। ম্যাচের আগে বাংলার অধিনায়কের লপচপানি (একপেশে ম্যাচ হবে। বাংলাই জিতবে। বলেছিলেন মনোজ) কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দিয়েছে সৌরাষ্ট্র। কারণ, তারা বেশি বকম-বকম না-করে ক্রিকেটটা খেলেছে। ম্যাচ হারার পর যখন বাংলার ক্রিকেটারেরা মুহ্যমান, কাঁধ ঝুলে গিয়েছে, দৃষ্টি শূন্য, তখন তাঁদের বলতে ইচ্ছে করছিল, গত সওয়া তিন দিন ধরে আপনাদের অধিকাংশ লুডো বা ব্যাগাটুলি খেলার মতো করে রঞ্জি ট্রফি ফাইনালটা খেলেছেন। যে গ্যালারি সমর্থন করতে গলা ফাটাচ্ছিল, সেখান থেকেই আওয়াজ উড়ে এসেছে, ‘‘ওরে! রঞ্জি ফাইনাল খেলছিস! সেটা তো অন্তত মনে রাখ!’’ ফলে এখন কান্নাকাটি করে কী লাভ!
তেত্রিশ বছর আগে রঞ্জি ট্রফি নিয়ে ফিরেছিল যে যুবক, তেত্রিশ বছর পরে মধ্যবয়সে পৌঁছে তা হলে কী নিয়ে সে ফিরল ইডেন থেকে?
ফিরল ওই দুই খণ্ডদৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। ফিরল ওই দু’টি দৃশ্যের মালা গেঁথে। বাংলাকে বাঁচাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১০০ রানের পার্টনারশিপ গড়ছেন এক মুসলিম এবং এক হিন্দু যুবক। তাঁদের একজনের হেলমেটে ঝলমল করছে জাতীয় পতাকা। ব্যক্তিগত মাইলস্টোনে পৌঁছে দু’জনে নিজের নিজের ধর্মাচরণ করে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন নিজের নিজের আরাধ্যকে। তার পর নতুন করে গার্ড নিচ্ছেন। একই লক্ষ্য সামনে রেখে।
ওটাই ট্রফি! জীবনের ট্রফি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy